শনিবার রাত ২:০০, ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং

জীবিকার তাগিদে শিক্ষক‌দের চিন্তা-গ‌বেষণায় মন নেই

শরীফ উদ্দীন রনি

“অ‌ভিভাবকরা শিক্ষার্থী‌দের শিক্ষার চে‌য়ে ফলাফ‌লের উপর নির্ভরশীল হ‌য়ে প‌ড়ে‌ছে। তাই শিক্ষার্থীরা প্রকৃত শিক্ষালা‌ভের সু‌যোগ পায় না। তারা হ‌য়ে পড়‌ছে অ‌নৈ‌তিক ও যন্ত্রমানব। প্রতি‌টি অ‌ভিভাবকের র‌য়ে‌ছে অসীম বস্তুবাদী প্র‌তি‌যোগিতার মন-মান‌সিকতা। সন্তান‌দের তারা মান‌বিক শিক্ষায় শি‌ক্ষিত কর‌তে ব্যর্থ। জী‌বিকার তা‌গি‌দে তা‌দের‌কে গ‌ড়ে তুল‌ছে ‘শি‌ক্ষিত’ হি‌সে‌বে।”

মানু‌ষের জন্মগতভা‌বে কিছু মৌ‌লিক অ‌ধিকার র‌য়ে‌ছে। শিক্ষা তেম‌নি অন্যতম প্রধান এক‌টি মৌ‌লিক অ‌ধিকার। যা দ্বারা সে তার নি‌জে‌কে প‌রিবর্তন ক‌রে যোগ্য মানুষ হি‌সে‌বে গ‌ড়ে তুল‌তে পা‌রে। ‌শিক্ষা‌ সকল শ্রে‌ণির মানু‌ষের মা‌ঝেই বিদ্যমান থা‌কে, যা‌কে নানা প্র‌ক্রিয়া ও কৌশল দ্বারা বিক‌শিত কর‌তে হয়। নিয়ম না মে‌নে চাষ করাটা যেমন ক‌ষ্টের, তেম‌নি শিক্ষা‌কে গ্রহণ করে নেওয়া ও‌ দেওয়ার ব্যবস্থাপনা স‌ঠিক ও আদ‌র্শিক না হ‌লে তার ফলাফল ভোগ করা দুরূহ।

প্রথ‌মেই শিক্ষার যে দিক আমা‌দের লক্ষ্য কর‌তে হয় সে‌টি হল, সম্পূর্ণ অর্থ‌কে কেন্দ্র ক‌রে গ‌ড়ে উ‌ঠে‌ছে বিশেষ করে আজকের শিক্ষাদান পদ্ধ‌তি। অর্থ ব্যতীত কো‌নো কিছু চো‌খের সাম‌নে ধরা প‌ড়ে না শিক্ষক ও শিক্ষার্থী‌দের। যার ফ‌লে তারা তা‌দের শারী‌রিক ও মান‌সিক চা‌হিদা নির্ণয় কর‌তে ব্যর্থ হয়। যখন যে চা‌হিদা তা পূর‌ণের তা‌গি‌দে অ‌বিরাম ছু‌টে চ‌লে, যে চলার অন্ত নেই ম‌নে হয়। একটা সময় চা‌হিদা তীব্র থে‌কে তীব্রতর হ‌তে থা‌কে, যা মেটা‌তে না পে‌রে নি‌জে‌কে পরা‌জিত এক সৈ‌নি‌কে গ‌ড়ে তো‌লে। হতাশার গ্লা‌নি ব‌য়ে বা‌কি জীবন কা‌টি‌য়ে যায়। তারা ভু‌লে যায় মানু‌ষের চা‌হিদার দিকগু‌লোর কথা, যে দি‌কে দৃ‌ষ্টি দি‌লে এসব সমস্যার সমাধান সহজ হয়ে যায়।

আরো পড়ুন> শিক্ষাব্যবস্থায় আদর্শিক সংকট তীব্র হচ্ছে

দ্বিতীয়: দিক‌টি হ‌লো, বি‌চ্ছিন্নতা। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মা‌ঝে সমন্বয়ধর্মী চিন্তা-ভাবনার অভাব র‌য়ে‌ছে, যে কার‌ণে সার্বিকভা‌বে তারা যেমন অগ্রসর হ‌তে পার‌ছে না, তেম‌নি রাষ্ট্রও নয়। ব্য‌ক্তি নি‌জে যে দিকটা‌কে উন্নয়‌নের ম‌নে ক‌রে সাম‌নে অগ্রসর হ‌চ্ছে তা সাম‌গ্রিক কর‌তে না পারায় বারবার ব্যর্থ হ‌চ্ছে ও রা‌ষ্ট্রের উন্নয়‌নে বাধাগ্রস্ততা গ‌ড়ে তুল‌ছে। সমস্যাপূর্ণতা‌কে আ‌রো বে‌শি সমস্যাপূর্ণ ও জ‌টিল ক‌রে তুল‌ছে। শিক্ষকরা এক‌চে‌টিয়া আধু‌নিক শিক্ষার সমস্যার কথা ব‌লে বেড়া‌চ্ছেন। অপর‌দি‌কে ছাত্ররাও এমন‌কি শিক্ষা বিষয়ক বি‌শেষজ্ঞরাও। তারা যেসব সমস্যা চি‌হ্নিত কর‌ছেন তা হ‌লো- গোড়া‌য় শিকড় রে‌খে আগায় গি‌য়ে শেকড় অনুসন্ধান করার ম‌তো। অথচ শিক্ষার স‌ঙ্গে জ‌ড়িত সক‌লের সম্ম‌ি‌লিত প্র‌চেষ্টা এসব সমস্যার সমাধান অনা‌য়ে‌সে দি‌তে পা‌রে।

“শিক্ষক‌দের চিন্তা গ‌বেষণার মন-মান‌সিকতার অভাব। প্র‌তি‌টি শিক্ষকই জী‌বিকা নির্বা‌হের এক একটা যন্ত্র। জী‌বিকার অনুসন্ধান কর‌তে গি‌য়ে তারা শিক্ষার বিষয়বস্তু, শিক্ষার্থী‌দের মেধা বিকা‌শের কৌশল, মান‌বিক মূল্য‌বো‌ধে উৎসা‌হিতকরণ ইত্যা‌দি বিষ‌য়ের দি‌কে নজরদা‌রি কর‌তে ব্যর্থ হ‌চ্ছে। শুধু গৎবাধা কিছু বস্তুবা‌দী বিষয় প‌ড়ি‌য়ে ভ‌বিষ্যৎ নাগ‌রিকদের গ‌ড়ে তুল‌ছেন আর নি‌জের অর্থ‌নৈ‌তিক পাল্লা ভারী কর‌ছেন।”

তৃতীয়: দিক‌টি হ‌লো, মতামত বি‌রোধিতার স‌ঠিক কৌশল না থাকা। জোর যার মুল্লুক তার- এই নী‌তি‌ প্রকৃত আদ‌র্শিক শিক্ষার কা‌ছে মার খায়। কিন্তু বর্তমান সম‌য়ে গণতা‌ন্ত্রিক প‌রি‌বেশ এমন হ‌য়েছে যে, শিক্ষা হওয়ার কথা ক্ষমতা আর রাজনী‌তিমুক্ত। অথচ যে শিক্ষ‌কের জন‌প্রিয়তা বে‌শি তার তৃতীয় শ্রে‌ণির মতামতও সহ‌জে গ্রহণ ক‌রে নেওয়া হয়। অন্যদি‌কে প্রথম শ্রে‌ণির মতাম‌টি আম‌লেই নেওয়া হয় না, কারণ এ‌টি তা‌দের অজানা-অ‌প্রিয় বিষয় ব‌লে। তার‌চে‌য়ে বড় কথা হ‌লো, ক্ষমতার আস‌নের পাশাপা‌শি নি‌জে‌র চিন্তা-‌চেতনা আর স্বার্থ‌কে উজ্জী‌বিত রাখা। তাই নানা সময় তা‌দের সত্য ও স‌ঠিক মতাম‌তের বিরু‌দ্ধে অপপ্রচারণা চা‌লি‌য়ে তা‌দের দমা‌নো হয়। যার ফলাফল খুবই ভয়াবহ জা‌তির জন্য।

লেখকের সব কলাম

চতুর্থত: প্রা‌য়ো‌গিক অদক্ষতা। মুখস্থ আর পরীক্ষায় পাস করাকে‌ন্দ্রিক পড়াশুনা ক‌রে তারা শিক্ষার প্রা‌য়ো‌গিক দিক থে‌কে ব‌ঞ্চিত হ‌য়েছেন। এ‌ক্ষে‌ত্রে ছাত্র‌দের চে‌য়ে শিক্ষক এবং অ‌ভিভাবকরাই দায়ী বে‌শি। কারণ তা‌দের প্র‌তি‌যোগিতামূলক ম‌নোভাব। যে কার‌ণে শিক্ষার্থীরা অ‌ধিকাংশ‌ক্ষে‌ত্রে এমন প‌রি‌স্থি‌তির সম্মু‌খীন হয়, তা‌দের পাঠ্য বিষয় এক আর বাস্তবতা আ‌রেক। আর তারা তখন হ‌য়ে প‌ড়ে অবাধ্য।

পঞ্চমত: অ‌ভিভাবক‌দের ফলাফলমুখিতা। অ‌ভিভাবকরা শিক্ষার্থী‌দের শিক্ষার চে‌য়ে ফলাফ‌লের উপর নির্ভরশীল হ‌য়ে প‌ড়ে‌ছে। তাই শিক্ষার্থীরা প্রকৃত শিক্ষালা‌ভের সু‌যোগ পায় না। তারা হ‌য়ে পড়‌ছে অ‌নৈ‌তিক ও যন্ত্রমানব। প্রতি‌টি অ‌ভিভাবকের র‌য়ে‌ছে অসীম বস্তুবাদী প্র‌তি‌যোগিতার মন-মান‌সিকতা। সন্তান‌দের তারা মান‌বিক শিক্ষায় শি‌ক্ষিত কর‌তে ব্যর্থ। জী‌বিকার তা‌গি‌দে তা‌দের‌কে গ‌ড়ে তুল‌ছে ‘শি‌ক্ষিত’ হি‌সে‌বে।

“প্রথ‌মেই শিক্ষার যে দিক আমা‌দের লক্ষ্য কর‌তে হয় সে‌টি হল, সম্পূর্ণ অর্থ‌কে কেন্দ্র ক‌রে গ‌ড়ে উ‌ঠে‌ছে বিশেষ করে আজকের শিক্ষাদান পদ্ধ‌তি। অর্থ ব্যতীত কো‌নো কিছু চো‌খের সাম‌নে ধরা প‌ড়ে না শিক্ষক ও শিক্ষার্থী‌দের। যার ফ‌লে তারা তা‌দের শারী‌রিক ও মান‌সিক চা‌হিদা নির্ণয় কর‌তে ব্যর্থ হয়। যখন যে চা‌হিদা তা পূর‌ণের তা‌গি‌দে অ‌বিরাম ছু‌টে চ‌লে, যে চলার অন্ত নেই ম‌নে হয়।”

ষষ্ঠত: শিক্ষক‌দের চিন্তা গ‌বেষণার মন-মান‌সিকতার অভাব। প্র‌তি‌টি শিক্ষকই জী‌বিকা নির্বা‌হের এক একটা যন্ত্র। জী‌বিকার অনুসন্ধান কর‌তে গি‌য়ে তারা শিক্ষার বিষয়বস্তু, শিক্ষার্থী‌দের মেধা বিকা‌শের কৌশল, মান‌বিক মূল্য‌বো‌ধে উৎসা‌হিতকরণ ইত্যা‌দি বিষ‌য়ের দি‌কে নজরদা‌রি কর‌তে ব্যর্থ হ‌চ্ছে। শুধু গৎবাধা কিছু বস্তুবা‌দী বিষয় প‌ড়ি‌য়ে ভ‌বিষ্যৎ নাগ‌রিকদের গ‌ড়ে তুল‌ছেন আর নি‌জের অর্থ‌নৈ‌তিক পাল্লা ভারী কর‌ছেন।

শিক্ষা‌কে মান‌বিক শিক্ষামুখী কর‌তে হ‌লে প্রচুর চিন্তা গ‌বেষণা প্রয়োজন। শিক্ষ‌কদের এ দিকটা‌তে নজর দেওয়া বি‌শেষ জরু‌রি। এভা‌বে হাজারও সমস্যা চি‌হ্নিত করা যা‌বে ঠিকই কিন্তু মৌ‌লিক বিষ‌য়ের দি‌কে নজর না দি‌লে এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এক‌টি রা‌ষ্ট্রে সুষ্ঠু ও প‌রিক‌ল্পিত শিক্ষা ব্যবস্থা না থাক‌লে জা‌তি‌কে ক‌স্মিকা‌লেও উন্নত আর সভ্য করার চিন্তা করা যায় না।

বর্তমান সম‌য়ে আমরা এক অমান‌বিক বি‌শ্বে বসবাস কর‌ছি। যেখা‌নে শিক্ষার বিষয়বস্তু মানুষ‌কে শুধু ভোগবা‌দিতা আর ক্ষমতার দি‌কেই আকৃষ্ট ক‌রে। নেই কোনো মান‌বিক গুণাব‌লি বিকা‌শের সু‌যোগ। জী‌বিকা নির্বা‌হেই পু‌রোটা জীবন কে‌টে যায় ক‌থিত শিক্ষায় ‘শি‌ক্ষিত’ হ‌য়ে। অথচ কথিত বা তথাকথিত শিক্ষা নয়, প্রকৃত ও মান‌বিক শিক্ষাই মানুষ‌কে এ‌নে দি‌তে পা‌রে চিন্তাগত, অর্থনৈতিক, ভোগলিক, মানবিক ও মানসিক মু‌ক্তি।

লেখকের ব্লগ

শরীফ উদ্দীন রনি : শিক্ষক, কলামিস্ট

sharifuddin420953@gmail.com

ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম

ট্যাগ: শরীফ উদ্দীন রনি

[sharethis-inline-buttons]

২ responses to “জীবিকার তাগিদে শিক্ষক‌দের চিন্তা-গ‌বেষণায় মন নেই”

  1. খায়রুল আকরাম খান says:

    এক জন শিক্ষার্থীর ভাল ফলাফল ও যথাযথ জ্ঞান অর্জনে র জ্য অভিভাবক, ছাত্র ওশিক্ষক দের মাঝে সুস্পর্ক স্থাপন হতে হবে। যা এখানে উল্লেখ করা হয়নি।

    • শরীফ উদ্দীন রনি says:

      সমন্বয় সা‌ধিত হ‌লে স্বয়ং‌ক্রিয়ভা‌বে সুসম্পর্ক গ‌ড়ে ওঠ‌বে। দ্বিতীয় দিক‌টি‌তে সমন্বয় ও বি‌চ্ছিন্নতা নি‌য়ে বলা হ‌য়েছে।

Leave a Reply