বৃহস্পতিবার বিকাল ৫:২১, ২১শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ৫ই ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং

রাজনী‌তি‌তে বিশ্বাসঘাতকতা

৪৩০ বার পড়া হয়েছে
মন্তব্য ০ টি

রাজনী‌তি শ‌ব্দের আ‌ভিধা‌নিক অর্থ হ‌চ্ছে- রাজ‌্য বা রাষ্ট্র প‌রিচালনার কৌশল। রাজনী‌তির উ‌দ্দেশ‌্য হ‌চ্ছে নী‌তি ও নৈ‌তিকতার আ‌লো‌কে জনগণ‌কে প‌রিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করা। সমাজজীব‌নের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হ‌লো রাজনী‌তি। মানুষ যে‌দিন থে‌কে রাষ্ট্রব‌্যবস্থা গ‌ড়ে তু‌লে‌ছে,সে‌দিন থে‌কে তার জীবন ধারার অপ‌রিহার্য বিষয় হ‌য়ে উ‌ঠে‌ছে রাজনী‌তি। প্রাচীন গ্রিসে রাজনী‌তি বল‌তে নগররাষ্ট্র ও তার শাসনব‌্যবস্থার বস্তগত ও দর্শনগত দিকগু‌লোর অধ‌্যয়ন‌কে বোঝাত। ত‌বে সাধারণভা‌বে রাজনী‌তি বল‌তে দলীয় রাজনী‌তি বা রাজ‌নৈ‌তিক দলগু‌লোর ক্ষমতা দখ‌লের লড়াই বা কৌশল‌কে বোঝায়।

রাজনী‌তির ময়দান এমন বন্ধুর জায়গা যেখা‌নে সততা, উদারতা, নৈতিকতা, দেশ‌প্রেম ও স‌হিষ্ণ‌ু‌তার পাশাপা‌শি অসততা, কু‌টিলতা, উগ্রতা, দেশ‌দ্রো‌হিতা ও ‌নৈ‌তিকতা অবস্থান ক‌রে। যে নেতা মান‌বিকমূল‌্যবোধ সম্পণ্ন উদার ম‌নের সে আজীবন ই‌তিহা‌সের পাতায় স্মরণীয় হ‌য়ে থা‌কেন। কিন্তু যে নেতা নিজস্বার্থ হা‌সি‌লের জন‌্য হিংসার পথ বে‌ছে নেয় বা নি‌জের ভিন্নমত প্রতিষ্ঠার জন‌্য গণতা‌ন্ত্রিক পদ্ধ‌তির প‌রিব‌র্তে জোড় ক‌রে বা অভ‌্যত্থা‌নের মাধ‌্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল ক‌রে নেয়, সেই নেতা ই‌তিহা‌সের আস্তাকু‌ড়ে নি‌ক্ষিপ্ত হয়। সুতরাং ই‌তিহাস থে‌কে শিক্ষা নি‌য়ে খুব সাবধা‌নে রাজ‌নৈ‌তিক নেতা-কর্মী‌দের‌কে এ‌গো‌তে হয়। রাজনী‌তির মঞ্চ দুস্কর ও ক‌ঠিন। এখা‌নে কেউ কাউ‌কে ছাড় দি‌তে চায় না।

এই ম‌ঞ্চে কে যে কখন কার শত্রু‌তে প‌রিণত হ‌বে,তা যেমন বলা যায় না, তেম‌নিভা‌বে কে যে কখন কার বন্ধ‌ু হ‌য়ে ও‌ঠে, তাও নি‌শ্চিত হওয়া দুস্কর। পু‌রো বিষয়‌টি নির্ভর ক‌রে পারস্পা‌রিক স্বার্থের উপর। সে স্বার্থ কখ‌নো ব‌্যক্তিগত, কখ‌নো দলীয়,আবার কখ‌নো রাষ্ট্রীয় ব‌্যাপারও হয়। প্রয়োজ‌নের সময় সেই মিত্রকে বাহু‌ডো‌রে বেধে নেওয়া হয় এবং প্রয়োজন শেষ হ‌য়ে গে‌লে তা‌কে কাগ‌জের ম‌তো ছু‌ড়ে ফেলা হয়। এমন‌কি ক্ষমতা বা রা‌জ্যের সিংহাস‌নের লালসায় ঘ‌নিষ্ঠ ও অ‌তি বিশ্বস্ত মানুষ‌টিও চরম শত্রু‌তে প‌রিণত হয়!পৃ‌থিবীর ই‌তিহাস পার্যা‌লোচনা কর‌লে এমন অহরহ ন‌জির পাওয়া যা‌বে। আপাতত ভারত উপমহা‌দেশের ই‌তিহাস অধ‌্যয়ন কর‌লে রাজনী‌তিতে আপন জন‌দের বিশ্বাসঘাতকতার ভয়াবহ চিত্র দেখ‌তে পা‌বো।

সেই ১৭৫৭ সা‌লে বাংলা-‌বিহার-উ‌রিষ‌্যার শাসনকর্তা নবাব সিরাজ‌দ্দৌলার সা‌থে ইং‌রেজ‌দের যুদ্ধ হ‌য়ে‌ছি‌লো ভাগীরথী নদীর তী‌রে পলাশীর আম্রকান‌নে। সেই যু‌দ্ধের প্রধান‌ সেনাপ‌তি ও নবাবের ফুফা মীর জাফর আলী খা‌নের উপর শতভাগ বিশ্বাস ও আস্থা রে‌খে‌ছিলেন সিরাজ‌দ্দৌলা। কিন্তু তার বিশ্বাসঘাতায় মাত্র তিন হাজার সৈন‌্য নি‌য়ে ইং‌রেজ সেনাপ‌তি লর্ড ক্লাইভ পরা‌জিত কর‌তে পে‌রে‌ছিল পঞ্চাশ হাজার সৈ‌ন্যের নবাব বা‌হিনী‌কে। পলাশী যু‌দ্ধের নির্মম পরাজ‌য়ের পর মির জাফ‌রের পুত্র মীরান কর্তৃক মু‌র্শিদাবা‌দে নবাব সিরাজ‌দ্দৌলা নিহত হন। সিরাজ‌দ্দৌলার মৃত‌্যুর পর বাংলার নবা‌বের আস‌নে অ‌ধিষ্ঠত হন মির জাফর আলী খান। ম‌হিশূ‌রের সিংহ না‌মে ই‌তিহাসখ‌্যাত বীর ছি‌লেন মহীশূ‌রের শাসনকর্তা টিপু সুলতান। ইং‌রেজ‌দের সা‌থে তার তিন থে‌কে চার বার যুদ্ধ সংগ‌ঠিত হ‌য়ে‌ছি‌লো।

প্রতি‌টি যু‌দ্ধেই তি‌নি জয়ী হ‌য়ে‌ছি‌লেন। কিন্তু ১৭৯৯ সা‌লে সংগ‌ঠিত শ্রীরঙ্গপট্ট‌মের যু‌দ্ধে তার পরাজয় ঘ‌টে এবং তি‌নি রন‌ক্ষে‌ত্রে নিহত হন। সেই যু‌দ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা ক‌রে‌ছি‌লেন প্রধান সেনাপ‌তি ও টিপু সুলতা‌নের চাচাশ্বশুর মির সা‌দিক। পা‌কিস্তা‌নের প্রথম রাষ্ট্রপ‌তি সৈয়দ ইস্কান্দার আলী মির্যা ১৯৫৬ সালে থে‌কে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত এই প‌দে থে‌কে রাষ্ট্রীয় দা‌য়িত্ব পালন করেন। নি‌জের শাসন কা‌র্যের সু‌বিধা‌র্থে বিশ্বস্ত ভে‌বে দু`জন সি‌নিয়র‌কে ডি‌ঙ্গি‌য়ে মেজর জেনা‌রেল আইয়ুব খান‌কে ব‌সি‌য়ে‌ছি‌লেন পা‌কিস্তা‌নের প্রধান সেনাপ‌তির প‌দে। সেই বিশ্বস্ত আইয়ুব খানই ১৯৫৮ সা‌লের ৮ অ‌ক্টোবর বন্দু‌কের ন‌লের ভয় দে‌খি‌য়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল ক‌রেন এবং ইস্কান্দার মির্যা‌কে সপ‌রিবা‌রে দেশ থে‌কে বিতা‌রিত ক‌রেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মু‌জিবুর রহমান স্বাধীন বাংলা‌দেশ রা‌ষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। তি‌নি বাঙ্গালী জা‌তিরও জনক। তি‌নি স্বাধীন বাংলা‌দে‌শে সেনাবা‌হিনীর কিছ‌ু্ উশৃঙ্খল জু‌নিয়র অ‌ফিসার কর্তৃক ১৯৭৫ সা‌লের ১৫ আগস্ট সপ‌রিবা‌রে নির্মমভা‌বে নিহত হন।

এই নির্মম সেনাঅভ‌্যুত্থা‌নের পর পরই খন্দকার মোস্তাক আহমেদ রাষ্ট্রপ‌তির দা‌য়িত্ব গ্রহন ক‌রেন এবং তৎকালীন আওয়ামী লী‌গের গুরুত্বপূর্ণ সদস‌্যদের নি‌য়ে ২০ সদস‌্য বি‌শিষ্ট মন্ত্রীসভা গঠন ক‌রে দেশ প‌রিচালনা কর‌তে থা‌কেন। ত‌বে খন্দকার মোস্তাক আহম‌দের শাসনকা‌র্যের আয়ুসকাল ছি‌লো মাত্র ৮০ দিন! মূলত এই অভ‌্যুত্থা‌নের মুল হোথা ছি‌লেন খন্দকার মোস্তাক আহ‌মেদ। বঙ্গবন্ধ‌ু শেখ মুজিবুর রহমান কি ঘ‌ুণাক্ষ‌রেও ভে‌বে ছি‌লেন,নি‌জের প‌রে যা‌কে তি‌নি সব‌চে‌য়ে বে‌শি বিশ্বাস কর‌তেন, সেই ঘনিষ্ঠবন্ধু খন্দকার মোশতাক আহ‌মেদ তার বিরু‌দ্ধে গভীর ষরয‌ন্ত্রে লিপ্ত হ‌তে পা‌রে? তিনি কি এটাও চিন্তা কর‌তে পে‌রে‌ছি‌লেন, যে দে‌শের মানু‌ষের সুখ-শা‌ন্তি প্রতিষ্ঠান জন‌্য জীব‌নের সোনালী দিনগু‌লো ব‌্যয় ক‌রে‌ছেন, অমান‌ু‌ষিক কষ্ট-যন্ত্রণা-‌নির্যাতন ভোগ ক‌রে‌ছেন, সেই দে‌শের মানুষই তা‌কে নির্মমভা‌বে হত‌্যা কর‌তে পা‌রে? না, এ রকম ভাবনা তার ম‌নে কখ‌নো আ‌সে‌নি। তাই দে‌শি-বি‌দেশী গো‌য়েন্দা সংস্থা তা‌কে এ বিষ‌য়ে সর্তক কর‌লে তি‌নি উচ্চ স্ব‌রে হে‌সে বল‌তেন, বাঙ্গালী আমা‌কে মার‌বে না। আর এই সরল বিশ্বা‌সের দাম তা‌কে দি‌তে হ‌য়ে‌ছে স্ত্রী-পুত্রসহ জীবন‌ দি‌য়ে।

বাংলা‌দে‌শের অষ্টম রাষ্ট্রপ‌তি,প্রাক্তান সেনাপ্রধান ও বি‌শিষ্ট মু‌ক্তি‌যোদ্ধা জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সা‌লের ৩০ মে এক ব‌্যর্থ সাম‌রিক অভ‌্যুত্থা‌নে চট্রগ্রা‌মে নির্মমভা‌বে নিহত হন। এই অভ‌্যুত্থা‌নের নায়ক ছি‌লেন মেজর জেনা‌রেল মোহাম্মদ আবুল মন্ঞ্জুর। হতবাক হওয়ার বিষয় মেজর জেনা‌রেল মোহাম্মদ আবুল মন্ঞ্জুর ও রাষ্ট্রপ‌তি জিয়াউর রহমান একই সা‌থে মু‌ক্তিযুদ্ধ ক‌রে‌ছেন এবং মু‌ক্তিযু‌দ্ধে বি‌শেষ অবদান রাখার জন‌্য তারা উভ‌য়ে বীর উত্তম খেতা‌বে ভূ‌ষিত হ‌য়ে‌ছেন। ব‌্যক্তিগত জীব‌নে তা‌দের ম‌ধ্যে খুবই ঘ‌নিষ্ঠতা ছি‌লো। অথচ এই ঘ‌নিষ্ঠ বন্ধুর হা‌তেই তা‌কে নিহত হ‌তে হ‌য়ে‌ছে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কি কখ‌নো ভাব‌তে পে‌রে‌ছি‌লেন, তারই ঘ‌নিষ্ঠ বন্ধু মেজর জেনা‌রেল মোহাম্মদ আবুল মন্জুর তা‌কে নৃশংসভা‌বে হত‌্যার প‌রিকল্পনা কর‌তে পা‌রেন? ১৯৮৪ সা‌লের ৩১ অ‌ক্টোবর ভার‌তের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রিমতী ইন্দিরা গা‌ন্ধী তার বিশ্বস্ত দুই দেহরক্ষী সৎবন্ত সিংহ ও বিয়ন্ত সিংহ এর হা‌তে নির্মমভা‌বে নিহত হন।

তৎকালীন ভার‌তের প্রধানমন্ত্রী ই‌ন্দিরা গান্ধী কি কখ‌নো ভাব‌তে পে‌রে‌ছি‌লেন, অস্ত্র হা‌তে যারা তা‌কে সর্বক্ষন বিরামহীভা‌বে পাহারা দি‌চ্ছেন শত্রুত হাত থে‌কে রক্ষান জ‌ন্যে,তা‌দেরই অ‌স্ত্রের গু‌লি‌তে তার প্রাণ যা‌বে? ১৯৭১ সা‌লের ২৬ মা‌র্চের অপা‌রেশন সার্চ লাই‌টের ইন্ধদাতা জুল‌ফিকার আলী ভু‌ট্টো রাষ্ট্রপ‌তি আইয়ুব খা‌নের মন্ত্রীসভার অ‌ভিজ্ঞ ও চতুর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছি‌লেন। তি‌নি পা‌কিস্তা‌নের(১৯৭১ সা‌লের ১৬ ডি‌সেম্বরের পর) রাষ্ট্রপ‌তি ও দুই মেয়া‌দের প্রধানমন্ত্রী ছি‌লেন। নি‌জের শাসন কা‌র্যের সুবিধা‌র্থে ৪/৫ জন সি‌নিয়ার‌কে ডি‌ঙ্গি‌য়ে জেনা‌লের জিয়াউল হক‌কে পা‌কিস্তা‌নের সেনা প্রধা‌নের প‌দে ব‌সি‌য়ে‌ছি‌লেন। নিয়‌তির কি নির্মম প‌রিহাস! সেই জিয়াউল হকই ১৯৭৭ সা‌লের ৬ জুলাই সাম‌রিক অভ‌্যুত্থা‌নের মাধ‌্যমে জুল‌ফিকার আলী ‌ভু‌ট্টো‌কে স‌রি‌য়ে নি‌জে পা‌কিস্তা‌নের রাষ্ট্রপ‌তির দা‌য়িত্ব গ্রহন ক‌রেন। অতঃপর জিয়াউল হ‌কের প‌রোক্ষ নি‌র্দে‌শে রাজ‌নৈ‌তিক প্রতিপক্ষ আহ‌মেদ রাজা কাসু‌রি‌কে হত‌্যার অ‌ভি‌যো‌গে ১৯৭৮ সা‌লের ১৮ মার্চ ভু‌ট্টো‌কে ফাসিঁ‌তে ঝু‌লি‌য়ে হত‌্যা করা হয়। কি বি‌চিত্র ও রহস‌্যময় উপমহা‌দেশের তথা পৃ‌থিবীর রাজনী‌তির ই‌তিহাস! এখা‌নে খাঁ‌টি মানুষ ও বিশ্বস্ত বন্ধ‌ু পাওয়া খুবই দুস্কর ও ক‌ঠিন ব‌্যাপার।

সেই প্রাচীন কাল থে‌কে আধু‌নিক কাল পর্যন্ত পৃ‌থিবীর বি‌ভিন্ন দে‌শে রাজনী‌তি‌তে আপনজন‌দের দ্বারা বিশ্বস্ততার বিপরী‌তে বিশ্বাসঘাতকতার ভয়াবহ দৃষ্টান্ত স্থা‌পিত হ‌য়ে আস‌ছে। পৃ‌থিবী যত দিন থাক‌বে হয়‌তো তত‌দিন রাজনী‌তি‌তে অসততা,কু‌টিলতা, অ‌নৈ‌তিকতা, উগ্রতা, ইত‌্যাদি ধারাবা‌হিকভা‌বে চল‌তেই থাক‌বে। ত‌বে এ থে‌কে প‌রিত্রান পে‌তে হ‌লে রাজ‌নৈ‌তিক নেতা-কর্মী‌দের‌কে অবশ‌্যই তা‌দের চিন্তা-চেতনায় আমুল প‌রিবর্তন আন‌তে হ‌বে এবং সততা,উদারতা, সহিষ্ণুতা, নৈ‌তিকতা,মান‌বিকতা,নম্রতা ইত‌্যা‌দির চর্চা নিরন্তর কর‌তে হ‌বে এবং প‌রিবার,সমাজ ও রাষ্ট‌্রীয় জীব‌নে তা বাস্তবায়ন কর‌তে হ‌বে।

Some text

ক্যাটাগরি: দর্শন, নাগরিক সাংবাদিকতা

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply

আমি প্রবাসী অ্যাপস দিয়ে ভ্যাকসিন…

লঞ্চে যৌন হয়রানি