দিনের পর রাত আসে, রাতের পর দিন। এভাবেই আমাদের জীবন সফরের সময় চলে যাচ্ছে। আমরা দিনদিন আখেরাতমুখী হচ্ছি। পরকালমুখী হচ্ছি। হয়ত আমরা অনুধাবন ও করছি না। জীবন ফুরিয়ে যাচ্ছে। দিনদিন হায়াত কমে যাচ্ছে। মানুষের বয়স বাড়ে না বরং কমে। সময় চলে গেলে কিংবা মাস বা বছর চলে গেলে আনন্দিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ অতিবাহিত সময় আর কখনো ফিরে আসবে না।
আল্লাহ রব্বুল আলামীন সময়ের শপথ করেছেন পবিত্র কুরআনুল কারিমে সময়ের গুরুত্ব বুঝানোর জন্য। মানুষকে সময়ের প্রতি সচেতন করার জন্য। মানবজীবনে সময় অতি মূল্যবান। মানুষ সময়কে কাজে লাগিয়ে সফলতার উঁচু শিখরে পৌঁছতে পারে। পক্ষান্তরে যারা সময়কে কাজে লাগায় না তারা সফলতার ছোঁয়াও পায় না। এজন্যই তো বলা হয়, “যারা সময়কে কাজে লাগায় সময় তাদেরকে দামী বানিয়ে দেয়”।
জান্নাতীরা জান্নাতে পৌঁছার পর দুনিয়ার যে সময় দয়াময় রবের যিকির ব্যতিত কেটেছে তার জন্য আফসোস করবে। আরবের একজন কবি যথার্থ বলেছেন,
“রাতসমূহের অতিক্রম মানুষকে আনন্দিত করে,উল্লাসিত করে,অথচ রাতসমূহের চলে যাওয়া মানে চলে যাওয়া”।
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। ইসলাম মুসলমানদেরকে আনন্দ উদযাপন করার জন্য নির্ধারিত দু’টি দিবস দিয়েছে। একটি ঈদুল ফিতর অপরটি হচ্ছে ঈদুল আযহা। আনন্দ উদযাপন করার জন্য ভিন্ন ধর্মের অপসংস্কৃতি আমদানী করার বৈধতা দেয় না ইসলাম।
যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি তা হলো, থার্টি ফাস্ট নাইট। ৩১ শে ডিসেম্বর রাত ১২.০১ মিনিটকে থার্টি ফাস্ট নাইট বলা হয়। যাকে আমরা ইংরেজি নববর্ষ নামে জানি। মূলত এর সাথে মিশে আছে খ্রিস্টানদের ধর্ম ও সংস্কৃতি।
যে সব কারণে বারণ করে ইসলামঃ
১. বিজাতীয় অনুকরণ।
আল্লাহ রব্বুল আলামীন ও তাঁর রাসুল সা. বিজাতীয় সংস্কৃতি উদযাপন করতে নিষেধ করছেন।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,
وَلَا تَرْكَنُوا إِلَى الَّذِينَ ظَلَمُوا فَتَمَسَّكُمُ النَّارُ
অর্থাৎ তোমরা জালিমদের প্রতি ঝুকে যেওনা।(ঝুকলে) জাহান্নামের আগুন তোমাদেরকে স্পর্শ করবে।
সূরা হুদ- আয়াত নং ১১৩
উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত আবুল আলিয়া রহিমাহুল্লাহ বলেন,
.
وقال أبو العالية : لا ترضوا أعمالهم .
অর্থাৎ তোমরা তাদের কাজকর্মে সম্মতি প্রকাশ করোনা।
তাফসিরে ইবনে কাসির -৪.২০৩
উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসিরকারক ইকরিমা রহিমাহুল্লাহ বলেন
لاتطيعوهم
তথা তোমরা তাদের অনুসরণ করো না।
তাফসিরে মাযহারী ৪. ৪২০
উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম কুরতুবী রহিমাহুল্লাহ বলেন,
تحرقكم بمخالطتهم ومصاحبتهم وممالاتهم على إعراضهم وموافقتهم في أمورهم.
তাদের সাথে মেলা- মেশা, উঠা বসা, ধর্মের প্রতি বিমুখী হওয়ার পরেও তাদের সাথে আন্তরিকতা ও তাদের কাজকর্মের অনুসরণ তোমাদেরকে জাহান্নামের আগুন জালিয়ে দিবে।
আহকামুল কুরআন (কুরতুবী) ৫.১০৮
এ প্রসঙ্গে রাসুল সা. ইরশাদ করেন,
عَنِ ابْنِ عُمَرَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم “ مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ ” .
ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি কোন কাওমের (সম্প্রদায়ের) অনুসরণ-অনুকরন করবে, সে তাদের দলভুক্ত হবে।
সুনানে আবু দাউদ হাদিস নং ৩৯৮৯
জামে তিরমিজি হাদিস নং ২৬৯৫
উক্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় হযরত তিবী রহিমাহুল্লাহ বলেন,
هذا عام في الخلق والخلق والشعار
অর্থাৎ হাদিসটি স্বভাব- রীতি, পোশাক ও নিদর্শনের ক্ষেত্রে ব্যাপক।
অর্থাৎ যে কেউ কথা ও কাজে,পোশাকে বা যে-কোন ভাবে বিজাতীদের অনুসরণ করে, সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।
মিরকাতুল মাফাতীহ – ৮.২২২
অন্য আরেকটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
من رضي عمل قوم كان شريكا في عمله
অর্থাৎ যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের কাজে সন্তুষ্ট, সে তাদের কাজে অংশীদার।
কানজুল উম্মাল – হাদিস নং ৩৪৭৩
আরেকটি হাদিস লক্ষ্যণীয়,
مالك بن دينار قال : أوحى الله إلى نبي من الأنبياء أن قل لقومك : لا تدخلوا مداخل أعدائي ، ولا تطعموا مطاعم أعدائي ، ولا تلبسوا ملابس أعدائي ، ولا تركبوا مراكب أعدائي ، فتكونوا أعدائي كما هم أعدائي
হযরত মালেক বিন দীনার রহিমাহুল্লাহ বলেন,
রব্বুল আলামীন তাঁর কোন একজন নবীর নিকট ওহি পাঠালেন যে,আপনি নিজ কওমের লোকদেরকে বলুন, তোমরা আমার শত্রুদের প্রবেশপথ দিয়ে প্রবেশ করোনা,তাদের খাবার খেওনা,তাদের পোশাক পরিধান করোনা,তাদের বাহন ব্যবহার করোনা।
এসব করলে তোমরা তাদের মত আমার শত্রু হয়ে যাবে।
আয যাওয়াযের আন ইকতিরাফিল কাবায়ের – ২৫
মুহাক্কাক ওয়া মুদাল্লাল জাদীদ মাসাইল -১.৯৪-
২. অর্থের অপচয়। এ রাতকে কেন্দ্র করে অনেক অনৈতিক ও হারাম কাজে অর্থের অপচয় হয়।
আল্লাহ তায়ালা অর্থের অপচয় করতে পবিত্র কালামুল্লাহতে নিষেধ করেছেন।
إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ ۖ
নিশ্চয়ই অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই।
[সুরা বনী ঈসরাইল. ২৭]
৩. গান বাজনা। এ রাতকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মোড়ে কিংবা রাস্তায় গানের কনসার্ট করা হয়। যাতে নারী পুরুষ একসঙ্গে গান বাজনা ও নৃত্য করে।
অথচ আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূল সা. এমন গর্হিত কাজ থেকে বারণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে রব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন,
‘একশ্রেণীর লোক আছে যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে গোমরাহ করার উদ্দেশ্যে অবান্তর কথাবার্তা সংগ্রহ করে অন্ধভাবে এবং উহাকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে। এদের জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি।’( সূরা লুকমান – ৬)
এ প্রসঙ্গে রাসুল সা. ইরশাদ করেন,
عَنْ جَابِرٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ:الْغِنَاءُ يُنْبِتُ النِّفَاقَ فِى الْقَلْبِ كَمَا يُنْبِتُ الْمَاءُ الزَّرْعَ
অর্থাৎ জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ গান-বাজনা মানুষের অন্তরে কপটতা উৎপাদন করে, যেভাবে পানি শস্য উৎপাদন করে।
শুআবুল ঈমান হাদিস নং ৫১০০
৪. আতশবাজি ও পটকা-বাজিঃ মধ্য রাতেই শুরু হয় আতশবাজি ও পটকা-বাজি। যা মানুষের মনে ভয় – ভীতি সৃষ্টি করে। মানুষের ইবাদতে সমস্যা হয়।ঘুম নষ্ট করে। যার কারণে মানুষের কষ্ট হয়।
আর প্রকৃত মুসলমান তো সেই যার কৃতকর্মের জন্য অপর ভাইয়ের কষ্ট না হয়।
এ প্রসঙ্গে রাসুল সা. ইরশাদ করেন,
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ সেই ব্যক্তি মুসলিম যার হাত ও মুখ হতে অপর মুসলিম নিরাপদ থাকে।
জামে তিরমিজি হাদিস নং ২৬২৭
তাছাড়া আতশবাজি ও পটকা-বাজি আরো দুটি কারণে নিষিদ্ধ।
১. হাত- পা পুড়ে যাওয়ার ভয় থাকে। ঘরে আগুন লাগার ভয় থাকে। আল্লাহ তায়ালা নিজের জীবন ও সম্পদকে হুমকির মুখে ফেলতে নিষেধ করেছেন।
وَلَا تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ ۛ
তোমরা নিজেদের জীবনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিওনা।
[সুরা বাকারা. ১৯৫]
২. অধিকাংশ সময় লেখাবিশিষ্ট কাগজ আতশবাজির জন্য ব্যবহৃত হয়। অক্ষর সম্মানের বিষয়। তা এমন কাজে ব্যবহার করা নিষেধ।
৫. যুবক – যুবতীর অবাধ মেলামেশাঃ
এ রাতে বিভিন্ন স্থানে, নাইট ক্লাবে, সমুদ্র সৈকতে ও আবাসিক হোটেলে যুবক -যুবতীরা একত্রিত হয়।
যুবক – যুবতীর অবাধ মেলামেশা মানেই কুকর্মে লিপ্ত হওয়া। কারণ তৃতীয় পক্ষ শয়তান ছলেবলে কৌশলে খারাপ কাজে লিপ্ত করবেই।
কারণ নারী ঘরে থাকবে। যখনই সে ঘর থেকে বের হবে শয়তান তাকে পুরুষের সামনে সাজিয়ে গুছিয়ে প্রকাশ করবে।
এ প্রসঙ্গে রাসূল সা. ইরশাদ করেন,
ইবনু মাস্‘ঊদ (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ রমণী মাত্রই আবরণীয় (বিষয়), যখন সে বের হয় তখন শায়ত্বন তাকে সুশোভিত করে তোলে।
জামে তিরমিজি হাদিস নং ১১৭৩
আর একটি হাদিস দেখুন,
‘একজন স্ত্রীলোকের সাথে একজন পুরুষ একাকী থাকলে তাদের মধ্যে শাইতান তৃতীয় ব্যক্তি হিসাবে যোগ দেয়”।
জামে তিরমিজি হাদিস নং ১১৭১
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে দ্বীনের সহিহ বুঝ দান করুন। দ্বীনের পথে পরিচালিত করুন। সিরাতে মুস্তাকিমের উপর অবিচল থাকার তাওফিক দান করুন। আমীন।
Some text
ক্যাটাগরি: মতামত
[sharethis-inline-buttons]