শুক্রবার সন্ধ্যা ৬:০৭, ২২শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ৬ই ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং

মার্কিন-তালেবান শান্তি চুক্তি: পেছনে রয়েছে অর্থনীতির জটিল খেলা

৭০১ বার পড়া হয়েছে
মন্তব্য ০ টি

দীর্ঘ ১৮ বছর প্রাণঘাতি যুদ্ধের পর গত ২৯ ফ্রেব্রুয়ারি ২০২০ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও আফগানিস্তানের তালেবান শান্তি চুক্তি সই করেছে। কাতারের রাজধানী দোহায় এ চুক্তি সই করা হয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবান যে চুক্তি স্বাক্ষর করলো, সেটার মাধ্যমে গেরিলা গ্রুপ ও কাবুল সরকারসহ অন্যান্য আফগান গ্রুপের মধ্যে আলোচনার দরজা খুলে খুলবে বলে মনে করছেন অনেকে।

বিশ্লেষকরা এ চুক্তি নিয়ে নানারকম বিশ্লেষণ করছেন। যদিওবা ট্রান্স-আফগান পাইপ লাইন এ চুক্তি স্বাক্ষরে অন্যতম ভূমিকা রেখেছে। ১৮০০ কিমি দীর্ঘ ট্রান্স আফগান পাইপ লাইনের কাজ এরই মধ্যে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তুর্কমেন অংশ নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আফগানিস্তান অংশে কাজ চলছে । পাকিস্তান দ্রুত কাজ শুরু করে দেবে। কাস্পিয়ান সাগরের তলদেশের বিপুল প্রাকৃতিক গ্যাস এ পাইপলাইন হয়ে প্রবেশ করবে গুজরাট, মহারাস্ট্র এবং নর্দার্ণ ইন্ডিয়ার ইন্ডাস্ট্রিয়াল অঞ্চল সমুহে। আপাতত বৃহত্তম ব্যবহারকারী হবে ইন্ডিয়ান শিল্প ও ইন্ডিয়াতে বিপুল বিনিয়োগ করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশসমুহ।

গ্যাস কেনার সুযোগ পাবে পাকিস্তান এবং সেখানে বড় বিনিয়োগ করা চায়না। আফগান ও পাকিস্তান আপাতত পাবে পাইপলাইনের ট্রানজিট ফি।

আফগান-মার্কিন শান্তি চুক্তি সেন্ট্রাল ও সাউথ এশিয়ার সব স্টক হোল্ডারদের কথা মাথায় রেখেই করা হয়েছে। সবাই লাভের কথাই চিন্তা করেছে।

আগামী নির্বাচনের আগেই আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করার ট্রাম্পের দেয়া প্রতিশ্রুতিও এ চুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

চুক্তির শর্তসমূহ:

১. ধারাবাহিক মার্কিন সেনা প্রত্যাহার শুরু হবে। এ মুহূর্তে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ১২ হাজার সেনা রয়েছে। তাদের সাথে রয়েছে ন্যাটো মিত্র বাহিনীর আরো কয়েক হাজার সেনা। আগামী পাঁচ মাসে ৫০০০ সেনা প্রত্যাহার হবে।

২. এ ১৫ মাস মার্কিন সেনারা আফগানিস্তানের বর্তমান সরকারকে নিরাপত্তা দেবে।

৩. তালেবান আল কায়েদা ও অন্যান্য গ্রুপগুলোকে আফগান ভূমি ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র বা তার মিত্রদের বিরুদ্ধে কোন হামলা পরিচালনা করতে দেবে না।

৪. যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবান কাতারে একটি যৌথ পর্যালোচনা কমিটি গঠন করবে এবং এ কমিটি চুক্তির বিভিন্ন অগ্রগতি পর্যালোচনা করবে।

৫. আগামী ১৪ মাসের মধ্যে আফগানিস্তানের সরকার, বিভিন্ন আফগান পক্ষ এবং তালেবানদের সাথে ক্ষমতা কিভাবে শেয়ার করবে সে ব্যাপারে একটা চূড়ান্ত চুক্তিতে আসবে সকল পক্ষ মিলে। এ ব্যাপারে আগামী ১০ দিনের মধ্যেই সব পক্ষ আলোচনা শুরু করবে।

৬. আফগান সরকারের কাছে থাকা ৫ হাজার তালেবান বন্দি আছে তাদের মুক্তি দিতে যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা করবে। সে সাথে নিজেদের হাতে আটক ১ হাজার আফগান বন্দিকে মুক্তি দেবে তালেবান।

তালেবানের সাবেক প্রধান মোল্লা ওমরের সহযোদ্ধা ছিলেন আবদুল গনি। তিনি ২০১০-এর ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের করাচিতে আটক হয়েছিলেন। সিআইএর অনুরোধে তাকে আট বছর পর ছেড়ে দেয়া হয়। চুক্তির কথাগুলো সব পরস্পর সম্পর্কিত ও শর্তসাপেক্ষ।

বিশ্লেষণ:
চুক্তির ভাষা থেকে যা বুঝা যায়-তা হলো বর্তমান সমঝোতা কেবল একটা সম্ভাব্য শান্তিচুক্তির প্রাথমিক শর্ত মাত্র। এটা কোনো শান্তিচুক্তি নয়। চুক্তির একটি ধাপ মাত্র। এ চুক্তির কারণে দেশটি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা তাৎক্ষণিক ভাবে প্রত্যাহার হবে না। তালেবানও এখনই তাদের হারানো ‘ইসলামিক আমিরাত অব আফগানিস্তান’ আবার গড়তে পারছে না। দুটিই অনেক সময় সাপেক্ষ বিষয়। এমনকি চুক্তিতে বার বার বলা হয়েছে, তালেবানের ‘ইসলামিক আমিরাতকে’ যুক্তরাষ্ট্র কোনো বৈধ সরকার বলে স্বীকার করছে না।

তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরণের শান্তি চুক্তি অথবা চুক্তির নামে তামাশা নতুন কিছু নয়।  আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই ২০০৭ সালে তালেবানের সাথে শান্তি আলোচনার হাত বাড়িয়েছিলেন। আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রধান শর্ত হলো মার্কিন সেনা প্রত্যাহার। শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য কাজ করতে হবে আফগানদের। আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা হলে যুক্তরাষ্ট্রের সে দেশে ঠাই হবে না। তাই অশান্তি জিইয়ে রাখাই তাদের আসল উদ্দেশ্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন ভাব দেখায় যেন তাদের কোনো দোষ নেই। তারা শান্তির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। দোষ শুধু আফগানদের। তারা শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হচ্ছে।

এর আগেও শান্তি প্রক্রিয়া কার্যকর করার কাজ করেছিলেন সাবেক আফগান প্রেসিডেন্ট বুরহান উদ্দিন রাব্বানী। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা চুক্তি বাস্তবায়নের সদিচ্ছা প্রমাণ করতে তাৎক্ষণিক দু’হাজার সেনা প্রত্যাহার করেছেন। শান্তি চুক্তির প্রক্রিয়াও এগিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু খুবই দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, ২০১১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর একদল তালেবান প্রতিনিধির সাথে নিজ বাড়ীতে আলাপ-আলোচনার সময় আত্মঘাতী বোমা হামলায় মারা যান বুরহান উদ্দিন রাব্বানী। এরপর থেমে যায় শান্তি আলোচনা। এ সুযোগে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে আরো বাড়তি সেনা পাঠায়।

এ চুক্তির পর খুব হাসিখুশি দেখা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। তবে সাধারণ আফগানরা কিছুটা খুশি। উভয়ের খুশির বিষয় অভিন্ন নয়। সামনে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ট্রাম্প তার জাতির কাছে উপস্থাপন করবেন-আমি যুদ্ধ বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছি। তালেবান স্বীকার করে নিয়েছে আল কায়েদা সন্ত্রাসী এবং তারা আল কায়েদাকে হোস্ট করবে না। কিছু সেনা প্রত্যাহার হবে। সে প্রত্যাহার ট্রাম্পের নির্বাচনের ভালো প্রচারণা হবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, আফগানিস্তানের শান্তির চেয়েও ট্রাম্পের জন্য জরুরি ছিল এ চুক্তি। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ যুদ্ধ চায় না। তারা যুদ্ধের ব্যয়ভার বহন করতে নারাজ।

এ চুক্তিতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো। চুক্তির পর ন্যাটো সৈন্যদের আফগানিস্তান ছাড়তে হচ্ছে না। তালেবানকে এখন তারা বর্তমান আফগান সরকারের দিকে ঠেলে দিলো। ফলে ভবিষ্যতের যেকোনো সহিংসতার দায় ওয়াশিংটন দু’পক্ষের ঘাড়ে চাপাতে পারবে। এ চুক্তিতে শান্তি আসার সম্ভাবনা কতটুকু সে কথা বলা মুশকিল। তালেবানরা আফগানিস্তানের প্রভাবশালী পক্ষ। এরা পশতুনদের একটা গ্রুপ। পশতুনদের আরো একটি গ্রুপ-এর নাম হিজবে ইসলাম। এর বাইরে আছে তাজিক, হাজারা ও উজবেক জনগোষ্ঠী। এসব গোষ্ঠীর মধ্যে তালেবানের সাপোর্ট কম। পশতুনদের মধ্যে যারা দেওবন্দের অনুসারী তারাই বেশিরভাগ তালেবানের সাপোর্টার।

ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে দেশটিতে শান্তি আনতে চাইলে আফগানিস্তানের পাঁচ প্রতিবেশীকেও শান্তি প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত করা দরকার। তবে সবচেয়ে জরুরি হলো আফগান নেতাদের ঐক্যমতে পৌঁছা। অনেকেই বলেন, তালেবানরা একেবারে গোঁড়া স্বভাবের। গোঁড়ামী দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা কঠিন। তালেবানের সাথে আলোচনায় বর্তমান সরকারকে ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে হবে এবং একই সাথে যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করতে হবে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, তালেবান নেতার সাথে তার ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। ফোনকলের পরপর নিউজ মিডিয়াগুলোতে খবর এসেছে যে, আফগানিস্তানের ৩৪টি প্রদেশের মধ্যে ১৫টিতে ৩০টি হামলা চালিয়েছে তালেবান। এর মধ্যে কুন্দুজ প্রদেশে ১০ আফগান সেনা, ৪ আফগান পুলিশ ও ৬ আফগান বেসামরিক নাগরিক হত্যা করেছে তারা। এর প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্র হেলমান্দে বিমান হামলা চালিয়েছে।

শান্তির জন্যই যদি চুক্তি হয় তাহলে এতো দ্রুত হামলার ঘটনা ঘটে কিভাবে? চুক্তি অনুযায়ী যদি যুক্তরাষ্ট্র আফগান ছাড়ে তবে সেটা দেশটির জন্য ভাল ফল বয়ে আনবে। আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রধান শর্ত হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তরিকতা। দেশটি আন্তরিক না হলে শান্তির প্রত্যাশা দুরাশা ছাড়া আর কিছুই নয়।

সাইয়েদ ইকরাম শাফী

তরুণ সাংবাদিক, গল্পকার ও কলাম লেখক

E-mail: s.iquram03@gmail.com   

Some text

ক্যাটাগরি: খবর, সমকালীন ভাবনা

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply

আমি প্রবাসী অ্যাপস দিয়ে ভ্যাকসিন…

লঞ্চে যৌন হয়রানি