শুক্রবার রাত ৯:০৫, ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং

জয়পুরহাটের জহুরুল এখন দুনিয়াসেরা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষক

২১৩৯ বার পড়া হয়েছে
মন্তব্য ০ টি

জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার মুড়াইল গ্রামের এক কৃষক পরিবারের সন্তান ড. মো: জহুরুল ইসলাম এখন একজন অনুজীব বিজ্ঞানী ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক । বর্তমানে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট-ডক্টরাল গবেষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী অধ্যাপক পদে শিক্ষাছুটিতে কর্মরত ।

মুড়াইল গ্রামের মো: হযরত আলী ও মোছা: বিউটি বেগম দম্পত্তির সুযোগ্য সন্তান জহুরুল ইসলামের বেড়ে ওঠা কালাইয়ের গ্রামীন জনপদে। একডালা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে হারুন্জা নমিজন আফতাবী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০০০ সালে স্টার মার্কস পেয়ে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ২০০৩ সালে বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন বগুড়া সরকারী আযিযুল হক কলেজ থেকে । ২০১০ সালে চট্রগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় হতে পাঁচ বছর মেয়াদি ‘ডক্টর অব ভেটেরিনারি মেডিসিন (DVM)’ ডিগ্রি অর্জন করেন । একই বিশ্ববিদ্যালয় হতে ‘মাইক্রোবায়োলজি’ বিষয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন ২০১২ সালে । অনার্স এবং মাস্টার্স উভয় ডিগ্রিতেই সর্বোচ্চ ভাল ফলাফল করায় পৃথকভাবে রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদকে ভূষিত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন তিনি ।

এরপর ৩০তম বিসিএস-এ অংশ নিয়ে ১ম চাকরির সুযোগ পেলেও নিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের সুযোগ পাওয়ায় ২০১১ সালে মাস্টার্স এর  ছাত্র থাকা অবস্থায় প্রভাষক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। ২০১৪ সালে সহকারি অধ্যাপক হন এবং ২০১৮ সালে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়ে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো কর্মরত ।

মাস্টার্স শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতার পাশাপাশি বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য প্রস্তুতি চলতে থাকে । কিন্তু কোন আত্মীয় স্বজন বা পরিচিত কেউ এ বিষয়ে সাহায্য করার ছিলনা, তাই তাকে ‘গুগল’ এর উপর নির্ভর করে সামনে এগুতে হয়। এখান থেকেই তিনি বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও বৃওি প্রাপ্তির বিভিন্ন দিকনির্দেশনা পান। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী প্রথমে IELTS পরীক্ষা দেন এবং ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকদের সাথে ই-মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ শুরু করেন । অল্প কিছুদিনের ব্যবধানে কানাডা ও ডেনমার্কের বিশ্বখ্যাত দুটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাক্ষাৎকার প্রদানের ডাক আসে । সেখানে সাক্ষাৎকার দেয়ার দু’সপ্তাহের মধ্যে ফলাফল প্রকাশ হয়। সেই ফলাফলে তিনি দেখতে পান  দুটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই স্কলারশিপসহ ডক্টরেট করার সুযোগ পেয়েছেন । ২০১৫ সালে  ডেনমার্কের কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে সেদেশের অর্থায়নে ফুল স্কলারশিপে পিএইচডিতে ভর্তি হন। পরবর্তিতে তার স্ত্রী ড. শাহানা আহমেদও একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রিতে ভর্তি হওয়ায় পরিবারসহ ডেনমার্কে বসবাস করার সুযোগ পান । ২০১৮ সালে ডক্টরেট শেষে ডেনমার্ক থেকে বাংলাদেশে এসে আবার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতাই যোগদান করেন। পরে একটি আন্তর্জাতিক ফেলোশিপ প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়ে ২০১৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্টডক্টরাল বিজ্ঞানী হিসেবে যোগদান করেন । বর্তমানে অনুজীব, মানুষ ও পশুপাখির নিবিড় সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে কিভাবে বিভিন্ন জটিল রোগের চিকিৎসা আবিষ্কার করা যায় সে বিষয়ে গবেষনা করছেন  ।

এরমধ্যে তার ঝুলিতে আসে আন্তর্জাতিক নানা পুরস্কার ও সম্মাননা। ইউরোপিয়ান সোসাইটি ফর ক্লিনিক্যাল মাইক্রোবায়োলজি এন্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস হতে প্রাপ্ত কনফারেন্স এটেন্ডেড গ্রান্টসের মাধ্যমে ২০১৫ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মাননা অর্জন করেন।পরের বছর ২০১৬ সালে আমেরিকান সোসাইটি ফর মাইক্রোবায়োলজি (ASM) কর্তৃক আয়োজিত আন্তর্জাতিক আগার আর্ট (Agar Art) প্রতিযোগিতায় সারা পৃথিবীর মধ্যে সেরা প্রতিযোগী হিসেবে পুরস্কৃত হন ।  এ পুরস্কারের খবর পৃথিবীর নামকরা নানা সংবাদ মাধ্যম ও বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়।  এরমধ্যে বৃটেনের ‘দি গার্ডিয়ান’, জার্মানির ‘bild der Wisenchaf’, বিজ্ঞান সাময়িকী ‘সায়েন্স’ ও ‘নেচার’ উল্যেখযোগ্য। ২০১৭  সালে আমেরিকান সোসাইটি ফর মাইক্রোবায়োলজি কর্তৃক বাংলাদেশের জন্য তিন বছর মেয়াদে সায়েন্স এম্বাসেডর হিসেবে নিযুক্ত হন । এছাড়া ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ-ওরলিন্সে ও ২০১৯ সালে সানফ্রান্সিসকোতে ASM কর্তৃক প্রদত্ত ‘ASM microbe’ কনফারেন্স ট্রাভেল এওয়ার্ড পান । আর ২০১৯ সালে ডেনমার্কের লুন্ডবেক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রদত্ত বহুল প্রতিযোগিতামুলক ‘আন্তর্জাতিক পোস্টডক্টরাল ফেলোশিপ’ অর্জন করেন যার অর্থায়নে বর্তমানে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষনা কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছেন ।

ইতোমধ্যে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করেছেন। ভারতের মাদ্রাজ ভেটেরিনারি কলেজ ও তামিলনাড়ু ভেটেরিনারি এন্ড এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ে দেড়-মাস ব্যাপী DVM-ইন্টার্ণশিপ ট্রেইনিং-এর উদ্দেশ্যে ২০০৯ সালে প্রথম বিদেশ গমনের সুযোগ হয়  । ২০১৫ সালে ডেনমার্কে পিএইচডি চলাকালীন ও তৎপরবর্তী সময়ে পৃথিবীর ২৫টি দেশ ভ্রমন ও অনেক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনের অভিজ্ঞতাও রয়েছে তার। এরমধ্যে জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স, সুইডেন, হাংগেরী, অস্ট্রিয়া, ইতালী, দক্ষিন কোরিয়া, ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় উল্যেখযোগ্য । এছাড়াও দক্ষিন কোরিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি, ও যুক্তরাষ্ট্রে আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে গবেষনা উপস্থাপনা করেন ।

ক্যরিয়ারের শুরু থেকেই তার গবেষনার মূল বিষয় ছিল অনুজীবের সাথে মানুষ-পশুপাখির সম্পর্ক ও অনুজীবঘটিত রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি আবিস্কার । এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক জার্নালে তার  গবেষনা প্রকাশনার সংখ্যা ১৫টি ।

গবেষক ড. জহুরুল ইসলাম বলেন, বাবা-মার প্রচন্ড আগ্রহই ছিল আমার পড়া-লেখার মূল অনুপ্রেরণা । বাংলাদেশের ছোট একটা গ্রামের স্কুলে পড়ালেখা শুরু করে পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা আমার কাছে এখনো স্বপ্নই মনে হয়। আমার
বিজ্ঞান গবেষনার হাতেখড়ি মূলত মাস্টার্স পড়ালেখার সময় থেকেই । মাস্টার্সের গবেষনা ফলাফল প্রকাশ হয় ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসের জার্নাল ‘এপিডেমিওলজি এন্ড ইনফেকশন’ এ । বর্তমানে আমি অনেক কিছুই অর্জন করেছি। আমার ভবিষ্যত পরিকল্পনা  যুক্তরাষ্ট্রে গবেষনা শেষে বাংলাদেশে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বড় পরিসরে গবেষনা করা ও অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে দেশের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় অবদান রাখা । নতুন প্রজন্মদের উদ্দেশ্যে তিনি আরো বলেন, কোন বিষয়ে পড়ালেখা করছি, শহর না গ্রামে, ছেলে না মেয়ে এসব বিষয় কখনোই লক্ষ্যে পৌঁছার অন্তরায় নয় । আত্মবিশ্বাস, চেস্টা আর কঠোর পরিশ্রম অভিষ্ঠে পৌঁছার মূলমন্ত্র । নিজের আগ্রহ, কঠোর পরিশ্রম আর কাজের প্রতি ভালবাসাই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য খুব জরুরী ।

Some text

ক্যাটাগরি: আত্মজীবনী, খবর, নাগরিক সাংবাদিকতা

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply

আমি প্রবাসী অ্যাপস দিয়ে ভ্যাকসিন…

লঞ্চে যৌন হয়রানি