শুক্রবার রাত ৯:০৩, ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ৯টি উপজেলার নামকরণের ইতিকথা

২৪৯৩ বার পড়া হয়েছে
মন্তব্য ০ টি

নাম দিয়ে কী হয়? নামের মাঝে লুকিয়ে আছে আসল পরিচয়। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী খ্যাত ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার রয়েছে ৯টি বৈচিত্র্যপূর্ণ উপজেলা। প্রিয় পাঠক আসুন আমরা আমাদের প্রাণের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সকল উপজেলা সমূহের অলিখিত ইতিহাস জানি।তবেই আমার এ শ্রম সার্থক হবে।

০১ ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা
০২ কসবা উপজেলা
০৩ নাসিরনগর উপজেলা
০৪ সরাইল উপজেলা
০৫ আশুগঞ্জ উপজেলা
০৬ আখাউড়া উপজেলা
০৭ নবীনগর উপজেলা
০৮ বাঞ্ছারামপুর উপজেলা
০৯ বিজয়নগর উপজেলা


০১ ব্রাহ্মণবাড়িয়া (সদর) উপজেলার নামকরণের ইতিকথা:

প্রাচীন জনপদ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রাচীনত্ব সম্পর্কে বহু প্রমাণ পাওয়া যায়।বাণিজ্যিক নৌপরিচালনার সুবিধার্থে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জরিপবিদ ও প্রকৌশলী জেমস রেনেলকে বঙ্গীয় নদীব্যবস্থার জরিপ ও এর মানচিত্র প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। রেনেল ১৭৬৩ থেকে ১৭৭৩ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকারের তরফে বাংলার এক সেট মানচিত্র প্রস্তত করেন। তাঁর ১৭৭৯ সালে মুদ্রিত বেঙ্গল এ্যাটলাস (Bengal Atlas) বাণিজ্যিক, সামরিক ও প্রশাসনিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক দিয়ে একটি অতিমূল্যবান কাজ। শিক্ষামূলক, প্রশাসনিক ও নৌ-পরিচালনা- প্রতিটি ক্ষেত্রেই মধ্য উনিশ শতকে পেশাগত মানচিত্রের আত্মপ্রকাশের পূর্ব পর্যন্ত রেনেলের মানচিত্রই একমাত্র নির্ভরযোগ্য নির্দেশক ছিল।”রেনেলের এই মানচিত্রে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বেশ কিছু স্থান ও নদীর নাম গুরুত্বের সাথে উল্লেখ রয়েছে।মহাভারত প্রণেতা বেদব্যাসের ‘পদ্মপুরান’ গ্রন্থে জনশ্রুতি আছে, কালিদহ সায়র বা কালিদাস সাগরের তলদেশ থেকে ধীরে ধীরে স্থল ও জনপদে রূপান্তরিত হয় জেলার বৃহত্তর অংশ, একাদশ থেকে ষোড়শ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে। কালিদহ সায়র বা কালিদাস সাগর এর নামকরণেই এ অঞ্চলে হিন্দু আধিক্য ছিল বলে অনেকটা প্রমাণ মিলে। জেলার প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এর সত্যতা নিরূপণ করা যায়। হিন্দু আধিক্যের কারণে এই এলাকার কর্তৃত্ব তৎকালীন ত্রিপুরায় ব্রাহ্মণ্যবাদের বিস্তার ঘটে। ব্রাহ্মণ আধিক্য বা ‘ব্রাহ্মণদের বাড়ি’ থেকেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উৎপত্তি হয়েছে বলে অনেকেরই ধারণা। তবে এ কথা অনস্বীকার্য, ব্রাহ্মণ শব্দ থেকে ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া’ নামকরণ হয়েছে।প্রাচীনকালে বর্তমান শহরের “পৌর মিলনায়তন” এর পশ্চিম দিকটায় “ব্রাহ্মণবাড়ি” নামে অভিজাত ব্রাহ্মণদের একটা বাড়ি ছিল। এ ‘ব্রাহ্মণবাড়ি’ থেকেই তৎকালীন মহকুমার নামকরণ করা হয় ‘ব্রাহ্মণবাড়ি’ তথা ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া’।বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া চট্টগ্রাম বিভাগের অধীন একটি জেলা। প্রাচীনকালে এটি সমতট জনপদের অন্তর্গত ছিল এবং পরবর্তীতে এটি ত্রিপুরা রাজ্যের অংশ হয়েছিল।চৈনিক পরিব্রাজক ওয়াং চোয়াঙ কর্তৃক সমতট রাজ্য পরিভ্রমণের বৃত্তান্ত ও এ অঞ্চলে প্রাপ্ত প্রাচীন নিদর্শন‍াদি থেকে যতদূর জানা যায় খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দী থেকে ত্রিপুরা গুপ্ত সম্রাটদের অধিকারভুক্ত ছিল। ঐতিহাসিকদের মতে সপ্তম থেকে অষ্টম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত এ অঞ্চলে বৌদ্ধ দেববংশ রাজত্ব করে। নবম শতাব্দীতে হরিকেলের রাজাগণের শাসনাধীনে আসে। প্রত্নপ্রমাণ হতে পাওয়া যায় যে, দশম হতে একাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত প্রায় দেড়শ বছর এ অঞ্চল চন্দ্র রাজবংশ দ্বারা শাসিত হয়েছে।মধ্যবর্তী সময়ে মোঘলদের দ্বারা শাসিত হওয়ার পরে ১৭৬৫ সালে এটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অধীনে আসে। রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে কোম্পানী ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দ প্রদেশে একজন তত্ত্বাবধায়ক (Superintendent) নিয়োগ করে। ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে কুমিল্লাকে কালেক্টরের অধীন করা হয়। ১৭৯০ সালে ত্রিপুরা জেলা গঠনের মাধ্যমে ত্রিপুরা কালেক্টরেটের যাত্রা শুরু হয়।পূর্ব ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্ত সংলগ্ন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১৮৬০ ইং সালে মহকুমা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৭৫ সালে নাসিরনগর মহকুমার নাম পরিবর্তন করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা করা হয়। তৎপূর্বেই ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর পৌরসভায় উন্নীত হয়।ভারত বিভাগের পর ১৯৪৭ পরবর্তীসময়ে কুমিল্লা জেলার একটি মহকুমা হিসেবে থাকে।১৯৭১ সালে বাংলাদেশ এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতা উত্তর প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের সময় ১৯৮৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে জেলা ঘোষণা করা হয়।

মুঘল আমলে ব্রাহ্মণবাড়ীয়া মসলিন কাপড় তৈরির জন্য বিখ্যাত ছিল।ঈসা খাঁর প্রথম ও অস্থায়ী রাজধানী ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর থেকে ১০ কিমি উত্তরে সরাইলে।১৮২৪ সালে ব্রিটিশ সৈন্যদের মুনিপুর অধিকারের সময়ে তাদের সামরিক সদর দফতর ছিল এ শহরে।১৯২১ সালে সমগ্র মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার সৈয়দ শামসুল হুদা (১৮৬২-১৯২২) এবং ব্যারিষ্টার আবদুর রসুল (১৮৭৪-১৯১৭) ছিলেন কংগ্রেস তথা ভারতবর্ষের প্রথম সারির একজন নেতা। উল্লাসকর দত্ত (১৮৮৫-১৯৬৫), সুনীতি চৌধুরী, শান্তি ঘোষ, গোপাল দেবের মত অনেক ত্যাগী ও মহান নেতাদের জন্ম দিয়েছে এই ব্রাহ্মণবাড়ীয়া।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলায় বর্তমানে ১টি পৌরসভা (পৌরসভায় ৯টি ওয়ার্ড রয়েছে), ১১টি ইউনিয়ন, ১৪২ টি মৌজা ও ১৪৬ টি গ্রাম রয়েছে।এটি জাতীয় সংসদের ২৪৫নং নির্বাচনী এলাকা(বিজয়নগর উপজেলা সহ) ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ এর আওতাধীন।

🏔 প্রত্নসম্পদ ও উল্লেখযোগ্য নিদর্শন সমূহ:
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর প্রতিষ্ঠার পূর্বে তিতাস তীরবর্তী মেড্ডা পঞ্চবটের জন্য বিখ্যাত ছিল। এখানে শ্রী শ্রী কালভৈরব” মন্দিরে রয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে উঁচু চোঁখ ধাঁধানো কালভৈরব মূর্তি।২৮ ফুট উচ্চতার এই মূর্তিটি ১৯০৫ সালে তৈরী করা হয়।মন্দিরের মূল কালভৈরবের বয়স প্রায় তিনশ বছর।শ্রীশ্রী কালভৈরব মূর্তিটির পাশে ছিলো ১১ কেজি ওজনের কষ্টি পাথরের শ্রীশ্রী কৈলাশ্বেশ্বর শিবলিঙ্গ,যা ১০৫ বছরের পুরনো।

♦ ভাদুঘর শাহী মসজিদ

এটি প্রাচীন সমতট অঞ্চলের অন্তর্গত ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরে অবস্থিত। মুঘল শাসকগণের মধ্যে জিন্দাপীর বলে খ্যাত মহিউদ্দিন মুহাম্মদ আওরঙ্গজেব আলমগীর (১৬৫৮-১৭০৭) এর রাজত্বকালে ১০৮৪ হিজরি আনুমানিক ১৬৬৩ খ্রিষ্টাব্দে সে সময়কার সরাইল পরগণার জমিদার নুর এলাহী ইবনে মজলিশ শাহবাজের তত্ত্বাবধানে ঐতিহাসিক ভাদুঘর শাহী মসজিদ নির্মিত হয়।ভাদুঘর শাহী মসজিদের প্রথম ইমাম হিসেবে দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত হন বাদশাহ আলমগীরের শিক্ষক, তাফসীরাতে আহমদিয়া এবং নুরুল আনোয়ার এর মত বিখ্যাত গ্রন্থসমুহের লেখক শায়খ আহমদ ইবনে আবু সাঈদ ইবনে ওবায়দুল্লাহ আল হানাফী আস সিদ্দিকী [শায়খ মোল্লাজিউন (রহ)] এর যোগ্য উত্তরসূরি মাওলানা মোল্লা নাসিরউদ্দিন (রহ)।

♦ কাঙাল নাথ জমিদার বাড়ি:

প্রায় ২২০ বছরের পুরনো (১৭৯৯ সাল কিংবা কাছাকাছি একটি সময়ে নির্মিত।) জানা যায়,শহরের “মুন্সেফপাড়া” তে অবস্থিত জীর্ণ কায় সুন্দর দ্বিতল বাড়িটি “কাঙাল (কাঙালি) দেবনাথ” নামক এক ব্যক্তির।তাঁর কাপড়ের ব্যবসা ছিল।সেই সময়কালে লোকজন বাড়িটিকে “নোয়াবাড়ি” বলতো বা এই নামে সবার কাছে পরিচিত ছিল বলে জানা যায়।

♦উলচাপাড়া মসজিদ:

সদর থানার অধীনে উলচাপাড়া গ্রামে অবস্থিত প্রত্নসম্পদ। এটি উলচাপাড়া উত্তর পাড়া শাহী জামে মসজিদ নামেও পরিচিত। মসজিদটিতে যেসব শিলালিপি পাওয়া গেছে তা থেকে অনুমান করা যায় সপ্তদশ শতাব্দীতে অর্থাৎ ১৭২৭-২৮ খ্রিস্টাব্দে এটি নির্মাণ করা হয়েছে। এটির প্রতিষ্ঠাতা পশ্চিম দেশীয় বনিক শাহ সৈয়দ মো: মুরাদ।যাঁকে মসজিদের পাশেই সমাহিত করা হয়েছে।

♦ সুহিলপুর মসজিদ:

সদর উপজেলার সুহিলপুর গ্রামের মধ্যপাড়ায় অবস্থিত সুন্দর এই মসজিদটি।সুহিলপুর জামে মসজিদ ১৯১০ সালে নির্মিত শতবর্ষী অর্থাৎ ১০৮ বছর পুরনো।

♦সোহাতা বড় জামে মসজিদ

উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি তথা চল্লিশের দশকে সদর উপজেলার সোহাতা গ্রামে নির্মিত আধুনিক স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন সোহাতা বড় জামে মসজিদ।১৩৬১ হিজরি তথা ১২ ই জ্যৈষ্ঠ,১৩৪৯ বঙ্গাব্দে মসজিদের ভিত্তি প্রস্থর স্থাপন করেন তৎকালীন সোহাতা গ্রামের ধনাঢ্য ভূমি অধিপতি “মোঃ হাফিজ উদ্দিন”।

♦তিতাস গ্যাসক্ষেত্র;

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের “ঘাটুরা” ও “সুহিলপুর” এলাকাজুড়ে অবস্থিত এই গ্যাসক্ষেত্রটি। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে ‘পাকিস্তান শেল অয়েল কোম্পানি’ এটি আবিষ্কার করে এবং ১৯৬৮ সাল থেকে গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়।৬৪ বর্গ কিলোমিটার ব্যাপী বিস্তৃত এই গ্যাসক্ষেত্রটির ভূগঠন গম্বুজাকৃতির।তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড(১৯৬৪)” বৃহত্তর ঢাকা,বৃহত্তর ময়মনসিংহ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলে গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ‘তেল,জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়’ এর আওতায় এবং ‘পেট্রোবাংলা’ এর অধীনে এই কোম্পানি তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।

♦ অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়:
ঐতিহ্যবাহী এ বিদ্যালয়টি ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত।১৮৭৫ সালে ৭.৩৮ একর এলাকা জুড়ে প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যালয়টির নামকরণ করা হয় রাজা রায় বাহাদুর অন্নদা প্রসাদ এর নাম অনুসারে।

 

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ৯টি উপজেলার নামকরণের ইতিকথা: এস এম শাহনূর

♦ পুরাতন কাচারী (আদালত ভবন) ভবন:
সদর উপজেলায় শহরের কেন্দ্র “কাচারীরপাড়”-এ অবস্থিত এই ঐতিহ্যবাহী ভবনটি।কুমিল্লার তিনটি সাব-ডিভিশন থেকে “ব্রাহ্মণবাড়িয়া” মহকুমা সৃষ্টি হয় ১৮৬০ সালের বৃটিশ আইনে।১৮৬৮ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া “পৌর শহর” হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
তার ঠিক ১৩ বছর পর,১৮৮১ সালে নির্মিত হয় এই কাচারী (আদালত) ভবনটি।বর্তমানে এটি একটি পরিত্যক্ত ভবন।

♦ দানবীর লোকনাথ রায় চৌধুরী ময়দান কমপ্লেক্স:

জেলা শহরের “পাইকপাড়া”-তে অবস্থিত এটি একটি পার্ক।এলাকাবাসী একে “টেংকের পাড়”(লোকনাথ দীঘি) বলেই বেশি চেনেন।কোনো এক কালে এই এলাকার মানুষের পানীয় জলের সমস্যার কারণে হবিগঞ্জের মাধবপুর এর জমিদার ‘লোকনাথ রায় চৌধুরী’ এটি খনন করিয়েছিলেন।

★ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামকরণ:
ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামকরণের ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে।ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামকরণের আগে এই জনপদ কি নামে পরিচিত ছিল তা রহস্যাবৃত। তবে অধ্যাপক হাফিজ উদ্দিন আহম্মদ এক প্রবন্ধে ঐতিহাসিক প্রমান এবং বস্ত্তনিষ্ঠ তথ্য ছাড়া ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া’ শহরের পূর্ব নাম ‘রং’ শহর উল্লেখ করেছেন। এই রং শহর কিভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামাঙ্খিত হল এ সম্পর্কে দুটি প্রচলিত জনশ্রুতি আজ প্রতিষ্ঠিত।

এক. (প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে)ঐতিহাসিকদের মতে, ভারতের কর্ণাটকের আদিবাসি সেন ব্রাহ্মণদের শাসনাধীনে ছিল এ অঞ্চল। তখনো এই অঞ্চলে মুসলমানদের আগমন ঘটেনি।বাংলাদেশে সেন রাজবংশের (১০৯৭-১২২৫ খ্রিষ্টাব্দ) শাসনামলে এদেশে কোন ব্রাহ্মণ পরিবার না থাকার কারণে হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজা পার্বন অনুষ্ঠান পরিচালনায় অসুবিধা সৃষ্টি হতো। এ অসুবিধা দূর করার লক্ষ্যে রাজা বল্লাল সেন (১১৫৮-১১৭৯ খ্রিস্টাব্দ,তাঁর রাজ্য পূর্বে পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমে মগধ, উত্তরে দিনাজপুর থেকে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত প্রসারিত ছিল।) তার শাসনাধীন আদিশূর, উত্তর প্রদেশের কান্যকুব্জ [(আধুনিক কনৌজ) প্রাচীনকালে এটি হর্ষবর্ধনের(৫৯০ – ৬৫৭) সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। কথিত আছে,কান্যকুব্জ ব্রাহ্মণদের আদি নিবাস ছিল]থেকে কয়েকটি(পাঁচটি)অভিজাত ব্রাহ্মণ পরিবার এ অঞ্চলে এনে বসতি স্থাপন করেছিলেন।
ভিন্ন মতে, এদেশে বৃটিশ রাজত্ব পূর্বকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাধীন সরাইলের প্রভাবশালী জমিদার দেওয়ান মোস্তফা আলি অন্যস্থান থেকে কটি অভিজাত ব্রাহ্মণ পরিবার হিন্দুদের পূজা পার্বনের সুবিধার জন্য এ এলাকায় এনেছিলেন। ধারণা করা হয়, আগত ব্রাহ্মণদের বাড়ি ও আস্তানা থেকে এ জেলার নামকরণ হয় ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া’।

দুই. ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামকরণের ব্যাপারে সমধিক প্রচলিত জনশ্রুতি হল,অনেকের মতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামকরণের সাথে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের স্থপতি বলে কথিত কাজী মাহমুদ শাহ(রাঃ) এর নাম জড়িত ।এ আল্লাহর ওলী মোঘল শাসনামলে ইসলাম প্রচারে সুদূর দিল্লি থেকে ষোড়শ অথবা সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে তিতাস পাড়ের বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকাধিন ৮নং ওয়ার্ডের কাজীপাড়া দরগাহ্ মহল্লা নামে পরিচিত এলাকায় আসেন। তাঁর নামানুসারে ওখানে একটি মাজার রয়েছে। শহরের ব্রাহ্মণেরা উক্ত দরবেশের অলৌকিক ক্ষমতায় বিষ্ময়াবিষ্ট হয়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন এবং তাদের বিরোধিতা জনিত অপকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে নবীনগর থানার বিদ্যাকুট গ্রামে চলে যান।যাবার প্রাক্কালে ব্রাহ্মণেরা কাজী সৈয়দ মাহমুদ শাহ(রাহঃ) কে এ মর্মে অনুরোধ করেন যে, দীর্ঘদিন রং শহরে তাদের প্রাধান্য ছিল। তাই তিনি যেন এ রং শহরের নামকরণে তাদের স্মৃতিকে সম্পৃক্ত রাখেন। ওলীয়ে কামেল সৈয়দ মাহমুদ শাহ (রাহঃ) তাদের অনুরোধ রক্ষা করেন এবং ‘ ব্রাহ্মণ বেড়িয়ে যাওয়া থেকে’ ব্রাহ্মণবেড়িয়া আবার ব্রাহ্মণবেড়িয়া থেকে ‘ ব্রাহ্মণবাড়িয়া ’ নামকরণ করেন।আবার,এও জনশ্রুতি রয়েছে, যারা দীক্ষিত হননি তাদের প্রতি রুষ্ট হয়ে সাধক কাজী মাহমুদ শাহ (র:) বলেন, ‘ব্রাহ্মণ বেরিয়ে যাও’। তাঁর এই উক্তি থেকেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামের উৎপত্তি, যা আজকের ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামে পরিচিত।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আঞ্চলিক উচ্চারণ ‘বাউনবাইরা’ (বা ‘ব্রাহ্মণ বেরিয়ে যাও’)। ধারণা করা হয় সেখান থেকেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামের উৎপত্তি। উল্লেখ্য বহুল প্রচারের ফলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামটি পরিবর্তিত হয়ে বি-বাড়িয়া ধারণ করতে থাকে।তাই ২০১১ সালে নামের অস্তিত্ব ঠিক রাখার জন্য জেলা প্রশাসন কর্তৃক এক প্রজ্ঞাপন জারি করে যে, এখন থেকে কেউ বি-বাড়িয়া নামটি ব্যবহার করতে পারবে না, সবাইকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামটি ব্যবহার করতে হবে।ধন্যবাদ জেলা প্রশাসনকে।

✪ পাদটীকা:
➤ ↑বল্লালচরিত।।আনন্দভট্র রচিত
➤ ↑তবকৎ-ই-নাসিরি।।মিনহাজউদ্দিন সিরাজ
➤ ↑নামকরণের ইতিকথা।। এস এম শাহনূর
➤ ↑উপজেলা তথ্য বাতায়ন।
➤ ↑নামকরণেরর ইতিকথা।। ৫স এম শাহনূর
➤ ↑প্রথম আলোঃ
http://archive.prothom-alo.com/detail/news/282274
➤ ↑কালের কণ্ঠঃ
http://www.kalerkantho.com/print-edition/culture/2011/07/08/169753

================================

০২ কসবা উপজেলার নামকরণের ইতিকথা:

কসবা একটি ফরাসি শব্দ। কসবা শব্দটির আভিধানিক অর্থ জনপদ অথবা উপশহর।ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনামলে এ নামকরণ করা হয়।অনেক ঐতিহাসিকের মতে কসবার আদি নাম ছিল কৈলাগড়।কিল্লা শব্দের অর্থ সেনানিবাস যা সামান্য পরিবর্তিত হয়ে হয়েছে কৈলা।গড় অর্থ দুর্গ।মুসলমানদের শাসনামলে এ কসবা ছিল একটি কিল্লা বা সেনানিবাস।আর এভাবেই কৈলাগড় থেকে কসবার উৎপত্তি।ভারতবর্ষে মুসলমান শাসনামলে ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ রেল স্টেশনের পশ্চিম পাশে কৈলাগড় নামে একটি দূর্গ নির্মাণ করেছিলেন। ঐ দূর্গের আশে পাশে প্রথম দিকে জনবসতি এবং পরবর্তীতে আস্তে আস্তে ছোট শহর কসবা গড়ে ওঠে।”কৈলাগড় নামের পরে এতদ্ অঞ্চলের নাম রাখা হয় নূরনগর।১৬১৮ সালে মোঘল সেনাপতি মির্জা নূরউল্লাহ খাঁ (বেগ)উদয়পুর রাজধানী দখল করে ত্রিপুরিদের বিতাড়িত করেন।১৬২৩ সালে তার নামে নূরনগর পরগণা নামকরণ করেন।’তদানিন্তন মোঘল শাসনকর্তা হিউং,বিউং ও কৈলাগড় নামক প্রদেশত্রয়কে সম্মিলিত করে স্বীয় নামানুসারে ‘নূরনগর পরগণা’ গঠন করেন।” (সুত্র: রাজমালা- কৈলাসচন্দ্র সিংহ, পারুল প্রকাশনী-২০০৯,পৃ.৪৪১)।

ত্রিপুরা রাজ্যের ইতিহাস গ্রন্থ “রাজমালা”থেকে জানা গেছে কোন এক সময়ে এই কসবা ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী ছিল।তাই সোনালী ইতিহাসের উজ্জ্বল সাক্ষী কসবা উপজেলার অধিবাসী হিসেবে আমরা সত্যিই গর্বিত।

 

 

★এক নজরে কসবা উপজেলা :
১। আয়তনঃ ২০৯.৭৬০ বর্গ কিলোমিটার
২। লোক সংখ্যাঃ ৩,১৯,২২১ জন
ক) পুরম্নষঃ ১,৫১,৮৫২ জন
খ) মহিলাঃ ১,৬৭,৩৬৯ জন
৩। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে লোকসংখ্যাঃ ১৫২১ জন
৪। ইউনিয়নের সংখ্যাঃ১০টি
৫। পৌরসভার সংখ্যাঃ০১টি
৬। গ্রামের সংখ্যাঃ২৩৭টি
৭। মৌজার সংখ্যাঃ১৫২টি
৮। সীমান্ত এলাকার আয়তনঃ ১৯ কিলোমিটার
৯। রেল লাইনের দৈর্ঘ্যঃ ১৮কিঃমিটার
১০। রেল স্টেশনের সংখ্যাঃ ৩ টি(মন্দভাগ,কসবা, ইমামবাড়ী)
১১। মোট ভূমির পরিমাঃ ৫১৮৭০ একর
১২। মোট খাস জমিঃ ২,৩৪৯.২২ একর
১৩। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা সুবিধাভোগীঃ ৮৯০ জন
১৪। পোস্টাল কোডঃ ৩৪৬০
১৫। শিক্ষার হার ৫০.৭% এবং সাক্ষরতার হার ৭৫%
( ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী)

★কসবার সোনালী ইতিহাসঃ
কসবা ছিল সুলতানি আমলের উপবিভাগীয় প্রশাসনিক কেন্দ্র। প্রশাসনিক উপ-বিভাগগুলোর মধ্যে ইকলিম, ইকতা, মুকতা, ইরতা, সোয়ার,ও কসবা নামের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত মোট ৩৭টি কসবার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। কসবাগুলির অধিকাংশই বর্তমান জেলা শহরের মধ্যে বা অদুরে অবস্থিত ছিল। একটি কসবার অবস্থান থেকে অন্যটির দূরত্ব ও একটি বিষয়। এসব নামের সঙ্গে অনেক রাজকীয় আমলার পদবির সংযুক্তি লক্ষ করা যায়, যেমনঃ কাজূর কসবা, কতোয়ালের কসবা, শহর কসবা, নগর কসবা ইত্যাদি।
কসবাগুলোর অবস্থান, একটির সঙ্গে অপরটির দূরত্ব, রাষ্ট্রীয় কিংবা প্রাদেশিক রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগব্যবস্থা এবং নামের সঙ্গে যুক্ত রাজকীয় পদবি ও অন্যান্য বিষয় বিচেনা করে কসবাকে সুলতানি আমলের একটি উপ-বিভাগীয় প্রশাসন কেন্দ্র বলা যেতে পারে।
সুলতানি আমলের ‘কসবা’ কে জেলা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। কসবার দায়িত্বে ছিলেন একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা, একজন কাজি ও একজন কতোয়ালী। মূঘল আমলের অধিকাংশ কসবাই পূর্বের গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে।
কয়েকটি কসবার নাম নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ
মুন্সিগঞ্জ জেলার কাজীর কসবা ও নগর কসবা
* টাঙ্গাইল জেলার কসবা আটিয়া
* ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলা,
* লক্ষ্মীপুর জেলার শহর কসবা
* বৃহত্তর রংপুরের কসবা নূরপুর
* দিনাজপুরের কসবা
* সাগরপুর কসবা
* খুলনার পয়গ্রাম কসবা
* বৃহত্তর রাজশাহী জেলার চোয়ারা কসবা
* আমর’ল কসবা
* কিসমত কসবা ও কসবা মান্দা
* গৌরনদী উপজেলার বড় কসবা
* লাখেরাজ কসবা
* যশোর কসবা ইত্যাদি।
ইতিহাস সাক্ষী দেয় যে, মহারাজ প্রতীত আনুমানিক একাদশ শতাব্দীতে কৈলাগড় (কসবা) অস্থায়ী রাজধানী স্থাপন করেন। এ পূর্বাঞ্চলে খলংমা, ধর্ম্মনগর, কৈলাসহর ও কৈলাগড়ে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন সময়ে রাজধানী স্থাপিত হয়েছিল। কসবার আদিনাম কৈলাগড়। কিল্লাগড় থেকে বিবর্তিত হয়ে কৈলাগড়। বর্তমান বিজনা নদীর (বিজয়) পূর্ব পাড়ে টিলাময় অঞ্চলে ত্রিপুরী সৈন্যরা কাঠ ও বাঁশ দিয়ে কিল্লা বানাতো। কিল্লাগড় মানে বিল্লাদুর্গ। পশ্চিম পাড়ে আজকের কেল্লাবাড়ি, নাপিতের বাজার, মইনপুর, শাহপুর এ অঞ্চলে কিল্লা তৈরি করেছিল মুঘল সৈন্যরা। ১৮৫৭ সালে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামে (যাকে ইতিহাসে বলে সিপাহি বিদ্রোহ) চট্টগ্রাম থেকে সিপাহিদের একটি দল ত্রিপুরা পাহাড় শ্রেণি দিয়ে সিলেটে পালিয়েছিল। তখন ত্রিপুরার মহারাজ ইংরেজদের পক্ষে দালালি করে সিপাহিদের দমন করে। এর এক বছর পর ত্রিপুরা রাজ্যে ইংরেজদের পরামর্শে ১১টি থানা স্থাপিত হয়। তিন ভাগে বিভক্ত। যেমন হিউং, বিউং ও কৈলাগড়। ১৯০৮ সাল কসবা থানা স্থাপিন হয়। পুরাতন অফিসের মধ্যে একটি তহশিল অফিস ছিল পেয়ারী যাহার বাজারে (কসবা)। গরিব কৃষকদের সুদখোররা শোষণের জন্য ১৮৪৩ সালে তা স্থাপন করে। ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর ১৪ তারিখে কসবা থানাকে উপজেলায় উন্নীতকরা হয়।কসবা পৌরসভা গঠিত হয় ১৯৯৯ সালে।পৌরসভা প্রতিষ্ঠার এক যুগ পর ১২ জুন ২০১১ সালে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

কসবা উপজেলার যত দর্শনীয় স্থান,
সৌন্দর্যে ও গৌরবে সত্যিই অম্লান।
প্রায় দুইশত দশ বর্গ কিলোমিটার বিস্তীর্ণ সমভূমি,নিচু ভূমি,জলাধার,উচু নিচু পাহাড়,লাল মাটির পাহাড়,নদী -নালা,খাল বিল পরিবেষ্টিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লিলাভূমি কসবা উপজেলা।তিতাস,সালদা, সিনাই,সাংগুর,বিজনা,কালিয়ারা,হাওড়া,রাজার খাল,অদের খাল,বুড়ি প্রভৃতি নদী এই প্রাচীন জনপদের উপর দিয়ে অতিক্রম করেছে।
মহান মুক্তি যুদ্ধের সময় কসবা দুই নম্বর সেক্টরের অধীনে ছিল। ১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর লতোয়ামুড়া ও চন্দ্রপুরে পাকবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং কোল্লাপাথরে অপর এক লড়াইয়ে ৪৯ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাছাড়া এসময় উপজেলার আকছিনা, আড়াইবাড়ী, হরিয়াবহ, ক্ষীরণাল, চারগাছ ও বায়েক অঞ্চলে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াই হয়।এই উপজেলার দর্শনীয় স্থানের মধ্যে মুক্তি যোদ্ধাদের সমাধিস্থল দুটি এবং গণকবর সাতটি। (লক্ষ্মীপুর, কোল্লাপাথর, শিমরাইল ও জমশেরপুর)।

★কসবার ঐতিহাসিক নিদর্শন ও স্থানসমূহঃ
কমলা সাগর কালিমন্দিরঃ
দিঘির পূর্ব দিকে উঁচু টিলার ওপরে কমলাসাগর কালিমন্দির। ঐ পাড়ে কসবা নাম বদলে ফেললেও কসবেশ্বরী মন্দির কথাটি এখনো লেখা আছে মূল ফটকের ওপরে। ১৫ শতকের শেষ দিকে মহারাজা ধন্যমানিক্য (১৪৯০-১৫১০) এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। সামনে বিশাল দিঘি খনন করে কমলাসাগর নাম দেন মহারাণী কমলাবতীর নামে। ভারতীয় অংশে কসবা নামটি চাপা পড়ে যায় কমলাসাগর নামের আড়ালে। তবে স্থানীয়রা এখনো এ এলাকাকে কসবা নামেই সম্বোধন করেন।

★সীমান্ত হাটঃ
কমলা সাগর দিঘির উত্তর-পূর্ব কোণায় উঁচু উঁচু কাঁটাতারে ঘেরা বর্ডার হাট। ২০১৫ সালের ১১ জুন প্রথম সীমান্ত হাট বসতে শুরু করে এখানে। শুরুর দিকে প্রতি বৃহস্পতিবার এখানে হাট বসলেও এখন বসে রোববার করে। সকাল ১০টা থেকে শুরু করে সন্ধ্যা অবধি বিকিকিনি চলে হাটে।২০৩৯ নম্বর সীমান্ত পিলার লাগোয়া এ বর্ডার হাট গড়া হয়েছে উভয় দেশের ১৪০ শতক জমির ওপর।

★কোল্লাপাথর শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থলঃ
এখানে ৪৯ জন মুক্তিযোদ্ধার সমাধি আছে। অজ্ঞাত তিনটি সমাধি। কোনাবন সাব সেক্টরের কমান্ডার আব্দুল গাফফার হাওলাদার (খুলনা) নির্দেশে, কোল্লাপাথরের বিনুফকিরের আন্তরিক সহযোগিতায় তাঁর পারিবারিক কতক জায়গায় ৭১-এর জুন মাসে এ সমাধি স্থাপন করা হয়। ৭১-এর অক্টোবরে কসবা অঞ্চলে যুদ্ধ বেড়ে যায়। শহীদ যোদ্ধারা আসতে থাকে তখন তাদের এখানে কবর দেয়া হয়।

★লক্ষ্মীপুর মুক্তিযোদ্ধা সমাধিস্থলঃ
১২ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সমাধিস্থল এখানে আছে। স্থাপিত ৭১-এর অক্টোবর-৯, লক্ষ্মীপুর সীমান্ত অঞ্চল। অক্টোবর ৯-২২ অক্টোবর পর্যন্ত কসবা যুদ্ধের ৪টি লাশ ও ২১ নভেম্বর চকচন্দ্রপুর চানমোড়ার যুদ্ধে নিহত ৮টি লাশ নিয়ে এ সমাধিস্থল। ক্যাপ্টেন হুমায়ুন কবির, স্বাধীনতা বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আবদুল কাইয়ুম, সদস্য সচিব এম এইচ শাহআলম, কসবা প্রেসক্লাবের সভাপতি সোলেমান খান, সাধারণ সম্পাদক নেপাল চন্দ্র সাহা, জহিরুল ইসলাম স্বপন এবং হুমায়ুন খাদেম (রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান), সাবেক এমপি শাহ আলম, তৎকালীন ইউএনও, শাহ মোকসেদ আলী ও সাবেক সচিব মিনাজুর রহমান এই সমাধি তৈরিতে আরও অনেকেই আন্তরিক সহযোগিতা করেছেন।

★দেশের প্রথম কুরআন ভাস্কর্যঃ
সৌদি আরবের জেদ্দা বিমানবন্দর নেমে পবিত্র নগরী মক্কার প্রবেশদ্বারে কুরআনের আদলে তৈরি যে বিশাল তোরণ রয়েছে। সে তোরণের ডিজাইনের আলোকেই কসবা উপজেলা সদরের ব্যস্ততম কদমতলা মোড়ে তৈরি করা হয়েছে এ ভাস্কর্যটি।কসবা পৌরসভার মেয়র এমরানুদ্দীন জুয়েলের তত্ত্বাবধানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের মেধাবী ছাত্র ভাস্কর কামরুল হাসান শিপন এ ভাস্কর্যটি ডিজাইন করেন।উন্নতমানের গ্লাস ফাইভার দ্বারা তৈরি নান্দনিক ভাস্কর্যটির উচ্চতা ১৬ ফুট এবং প্রস্থ ৮ ফুট।২০১৬-১৭ অর্থবছরের এডিবির অর্থায়নে প্রায় ৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ১ জুন এই প্রকল্পের কাজ শুরু করে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স সান কমিউনিকেশন।কাজ শেষ হয় ৩০ ডিসেম্বর ২০১৭।৩১ ডিসেম্বর ১৭ তারিখে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম নির্মিত এই ভাস্কর্যটির উদ্বোধন করেন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক।

★শ্রী শ্রী আনন্দময়ী জন্মভিটা ও আশ্রমঃ
হিন্দু বা সনাতনী ধর্মের কেউ কেউ বলে সাধিকা, আবার গুণীজন ও সাধকরা বলেন অংশাবতার। সবার কাছে প্রিয়তমা ‘মা’। জন্ম এপ্রিল ৩০, ১৮৯৬, মৃত্যুঃ আগস্ট-২৭, ১৯৮২। জন্ম স্থান ঃ কেওড়া, কসবা। ১৯২৫ সালে ঢাকা সিদ্ধেশ্বরী শ্রীযুক্ত জ্যোতিষ চন্দ্র রায় (ভাইজী) কর্তৃক ‘শ্রী শ্রী আনন্দময়ী’ উপাধী পায়। ১৯২৭ সালে শাহবাগে ফকিরের কবরে নামাজ পড়েন। ১৯২৯ সালে রমনা আশ্রমের জমিতে পদার্পণ করেন। ১৯৩৭ সালে খেওড়া কসবা কালিমন্দিরে আসেন শ্রীমতি ইন্দিরা ভারতের উপ রাষ্ট্রপতি জি এস পাঠকসহ ভারত বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব তার শিষ্যত্ব বরণ করেন। শ্রী শ্রী আনন্দময়ী আশ্রম, খেওড়া ১৩৩৮ বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৫ সালে তার পাশেই দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপিত হয়। খেওড়া আনন্দময়ী উচ্চ বিদ্যালয়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া আনন্দময়ী স্কুল (নিতাই পাল) তাঁরই নামে প্রতিষ্ঠিত।আগস্ট-২৭, ১৯৮২ সালে কৃষ্ণপুর আশ্রম, দেরাদুনে ৭-টা ৪৫ মিঃ মৃত্যুবরণ করেন।

★আনন্দ ভুবনঃ
মেহারী ইউনিয়নের অন্তর্গত বল্লভপুর গ্রামের পশ্চিম পাশে রাজার খালের উপর নির্মিত অপূর্ব সৌন্দর্যের হাতছানি ”বড় ভাংগা ব্রীজের দু’পাশ যা বাংলাদেশের দর্শনীয় স্থান সমূহের তালিকায় ‘অানন্দ ভুবন’ নামে খ্যাত।

★সালদা গ্যাস ক্ষেত্রঃ
বাংলাদেশের ১৯তম গ্যাস ক্ষেত্র (সালদা গ্যাস ক্ষেত্র) কসবার বায়েক ইউনিয়ন্থ সালদা নদীর তীরে অবস্থিত। মোট গ্যাসের মজুদ ৩০০ বিলিয়ন ঘনফুট। কূপ সংখ্যা ৩।

★মহেশ ভট্টাচার্য্য ব্রিজঃ
দানবীর মহেশ ভট্টাচার্য্য নামে কসবা বিজয় নদীর ওপর ব্রিজ তিনি স্থাপন করেন। জন্ম ১২৬৫ বাংলা মৃত্যু ১৩৫০ বাংলা। কসবা পুরাতন বাজারে প্রবেশ পথে নদীর উপর সুদৃশ্য ব্রীজ। কসবা সদরের কোন বদরাগী নৌকোমাঝি ভাংতি পয়সা দিতে পারেনি বলে, তাঁর ছাতা রেখে দেয়। তাই খেয়া পারের পর কুমিল্লায় গিয়ে একটি লোহা ব্রিজ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। হোমিওপ্যাথিক ঔষধ কোং স্থাপন, বিনা পয়সায় চিকিৎসা করিয়েছেন।

★গোঁসাইস্থল মন্দির গুচ্ছঃ
গোপীনাথপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ নোয়ামোড়া গ্রামে মন্দিরগুলো অবস্থিত। আনুমানিক ৫শত বছর পূর্বে এলাহাবাদের জমিদার সনাতন গোঁসাই সন্ন্যাসী বেশে পূর্ব ভারতের পথ ধরে এ গ্রামে উপস্থিত হন। সাথে ছিল দুইজন ভাবশিষ্য। একজন গোঁপাল গোসাই ও অন্যজন জীবন গোসাই। স্থানীয় রাখাল ও জেলেদের সহযোগিতায় একটি উঁচু মোড়ার ওপর পুণ্যকুটির স্থাপন করেন। মোড়ার উত্তর প্রান্তে সনাতন ও গোপাল গোঁসাইর সমাধি। উত্তর-পশ্চিম কোণে শ্রী শ্রী বৈকুণ্ঠের সমাধি, দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে জীবন গোঁসাইর সমাধি। এ গোঁসাই হিন্দু না মুসলিম তার কোনো প্রমাণ নেই। প্রতি বছর বৈশাখ মাসের ১ তারিখে মেলা হয় ও ১৪ ভাদ্রতে বসে হিন্দুদের উৎসব।

*পুড়া রাজার জাঙ্গালঃ
তিন লাখ পীর(তিলক পীর)থেকে বল্লভপুর পর্যন্ত।পাঁচ শত বছরের পুরনো।

*নবীজির অনুসারী সুফি সাধক শায়খুল বাঙাল ছৈয়দ অাবু মাছাকিন লাহিন্দী অাল কাদেরী(রঃ) এর অাব্বাজান বহু ভাষাবিদ মরহুম আলহাজ্ব মুকছদ আলী মৌলানা সাহেবের সমাধী(বল্লভপুর)

*আড়াইবাড়ির দরবার শরীফ।কসবা ।

*পুরকুইল দরবার শরীফ।

*১২৬৯ হিজরীতে মরহুম আজমত আলী প্রতিষ্ঠিত

*মইনপুর মসজিদ।মইনমপুর কসবা।

*ভিন্ন ধর্মী ব্যবসার আড়ৎ কুটি বাজার।

★কসবার ঐতিহাসিক সাগর ও দিঘিসমূহঃ

*কল্যাণ সাগরঃ
মহারাজ মশোধর মানিক্য তাঁকে কৈলাগড় সেনাপতি নিযুক্ত করেন। মহারাজ কল্যাণ মানিক্যের (১৬২৬-৬০) খ্রিঃ সময়ে একটি উদয়পুরে অন্যটি কসবায় তাঁর নামে এ দিঘি খনন করেন। দিঘিকে প্রতীকী অর্থে সাগর বলে। রাজার হৃদয় সাগর ও বিশালত্ব নিয়ে এ যেন দিঘিই সাগর। এ সমস্ত দিঘিগুলো মূলতঃ সামরিক প্রয়োজনে খনন করা হয়েছিল। কসবায় এ সাগরের আয়তন ১২ একর।

★কমলা সাগরঃ
রাজা ধন্যমানিক্য (১৪৯০-১৫২০) খ্রিঃ কসবায় এ দিঘি খনন করেন। রানী কমলাবতীর নামে কমলা সাগর। রাজার মৃত্যু হলে তিনিও সহমরণে যান। দক্ষিণ দেশের আমরাবাদ পরগণায় রাজা হরিশচন্দ্র। আমানতপুর গ্রামেও একটি কমলা দিঘি আছে।

★রাম সাগরঃ
মহারাজ রামদের মানিক্যের (১৬৭৬-১৬৮৫) খ্রিঃ মাইজখার গ্রামে রামসাগর নামে দিঘি খনন করেন।আয়তন ৮ একর।

*মহারাজ দ্বিতীয়ত মানিক্যের দীঘি -ধর্মসাগর কসবা।
*মহারাজ গোবিন্দ মানিক্যের স্ত্রী -গুনবতী মহাদেব্যার নামে -গুনসাগর, জাজিয়ারা,কসবা।
**আরো আছে পদ্মদিঘী (বাউরখন্ড),রাজার দিঘী(মূলগ্রাম),শ্রী দীঘি (শ্রীপুর),কৈলাস দীঘি, আন্ধাদীঘি (খেওড়া),পদ্মা পুকুর (বল্লভপুর গ্রামের পূর্ব পাশে), জুগি পুকুর(বল্লভপুর)

”নেই সেই দিন,মুক্ত জীবন আর হরিণ গতি;
এত সখী আর খেলার মাঝে রইল শুধু স্মৃতি ।
জুগি পুকুরের অবাঁধ সাঁতার, জল থৈ থৈ খেলা;
ছুঁয়ে যায় মোরে,এখনো প্রাণে দিয়ে যায় দোলা।”
(স্মৃতির মিছিলে কাব্যগ্রন্থ /এস এম শাহনূর )।

★বরেণ্য ব্যক্তিত্বঃ
*অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক – বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলার প্রধান কৌসুলী ও ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কৌসুলী।বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য,মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক,সাবেক সংসদ সদস্য।

*মুহাম্মদ গোলাম রহমান -তত্বাবধায়ক সরকারের যোগাযোগ উপদেষ্টা (সাবেক)।

*মরহুম হযরত গোলাম হাক্কানী (রঃ) – আড়াইবাড়ীর প্রখ্যাত আলেম , ইসলামি চিন্তাবিদ ও রাজনীতিবিদ। তিনি ছিলেন ইসলামি জ্ঞানচর্চায় একজন নিবেদিতপ্রাণ ও সমাজসেবক। মরহুম হযরত মাওলানা আসগর আহমদ (রঃ) এর সন্তান।

*তোফাজ্জল হোসেন (টি.অালী) – বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও আইনজীবি।

*মরহুম হাজী আব্দুল জব্বার -ছতুরা দরবার শরীফের পীর প্রফেসর আব্দুল খালেক (রঃ)র মাস্তান খেতাবে ভূষিত শিষ্য। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক ঘুমজাগানিয়া একজন ধর্ম প্রচারক।

*মিয়া আব্দুল্লাহ ওয়াজেদ – বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সাবেক সংসদ সদস্য। নকল নির্মূল কমিটির প্রধান।
রাজনীতিবিদ।

*এডভোকেট আনিসুল হক – রাজনীতিবিদ, আইন মন্ত্রী; এডভোকেট সিরাজুল হক বাচ্চু’ র সুযোগ্য সন্তান।

*সৈয়দ আব্দুল হাদী – বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী।

*শায়খুল বাঙ্গাল আলহাজ্ব হযরত মাওলানা শাহ্ সুফি সৈয়দ আবু মাছাকিন মোহাম্মদ মতিউর রহমান গোলাম কাদির (রাহ্) [প্রকাশ দুদু মিয়া পীর]।বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন জীবন নিবেদিত মোবাল্লিগ- ইসলাম প্রচারক, বুজুর্গ,সুফি সাধক।

*খন্দকার আশোক শাহ – উনি ছিলেন
সুফি সাধক, যিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন ইয়েমেন থেকে ধর্ম প্রচারের জন্য। উনি শায়িত আছেন গোপীনাথ পুর গ্রামের মধ্য পাড়ায়। বীর মুক্তি যোদ্দা, চিকিৎসক, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, সংস্ক্রিতিক ব্যাক্তিত্ব, জ্ঞান সাধক ও সুফি সাধক, ডঃএম.এ. রহমান উনার বংশ ধর।

★বিলঝিলঃ হাতনীর বিল, শিমরাইলের বিল ও কুটির বিল উল্লেখযোগ্য।

★মেলাঃ চৌমূহনী মেলা, মনকাসাইর মেলা ও মেহারি মেলা উল্লেখযোগ্য।
প্রাচীন কাল থেকে সকল ধর্ম বর্ণের মানুষের সহাবস্থানের এক নৈসর্গিক জনপদ কসবা।আসুন সকলে মিলে কসবার উন্নয়নে অবদান রাখি।

===============================

০৩ নাসিরনগর উপজেলার নামকরণের ইতিকথা:

মেঘনা,লঙ্গন,বলভদ্র,বেমালিয়া,হারাল,তিতাস বিধৌত ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার সর্ব উত্তরে অবস্থিত হাওরবেস্টিত নাসিরনগর উপজেলার অতীত ইতিহাস নদী তীরের বাড়িঘরের মতই ক্ষনস্থায়ী।জানা যায়,১৭৬৫ সালে দেওয়ানী লাভের সময় নাসিরনগর বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হস্তগত হয়। ১৮৩০ সালে সরাইল,দাউদপুর,হরিপুর,বেজুরা ও সতরকন্ডল পরগনা ময়মনসিংহ হতে ত্রিপুরা জেলার কাছে হস্তান্তরিত হয়। নাসিরনগর উপজেলাটি বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত (যার পূর্বনাম নাসিরনগর মহকুমা ছিল)। ১৮৬০ সালে তৎকালীন ত্রিপুরা জেলার (১৭৯০ সালে ত্রিপুরা জেলা গঠিত হয় ;,১৯৬০ সালে ১ অক্টোবর কুমিল্লা নাম রাখা হয়) অধীনে নাসিরনগর মহকুমা সৃষ্টি হয়। ১৮৭৫ সালে নাসিরনগর মহকুমাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা নামকরণ করা হয়। ১৭৯২ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি জেলাকে থানায় বিভক্ত করার নির্দেশ দেন। সিদ্ধান্ত হয় যে প্রতি ৪০০ বর্গমাইল পরিমিত এলাকা নিয়ে থানা গঠন করা হবে। ১৮৮৫ সালে ত্রিপুরা জেলাকে (বর্তমান নাম কুমিল্লা) এগারটি থানায় ভাগ করা হয়। তখন এ জেলাতে ১৫টি পুলিশ ফাঁড়িও ছিল। ১৮৭৫ সালে নাসিরনগর মহকুমার নাম পরিবর্তন করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রাখা হয় এবং পুলিশ ফাঁড়ির সংখ্যা কমিয়ে দুটি করা হয়। পুলিশ ফাঁড়ি দুটি হলো- নাসিরনগর এবং মরিচাকান্দি। ফৌজদারি কার্যক্রমের সুবিধার জন্য ১৯১০ সালে নাসিরনগর পুলিশ ফাঁড়িকে থানা হিসাবে ঘোষণা করা হয়।১৯৮৩ সালে ১ আগষ্ট নাসিরনগর থানাকে উপজেলায় রূপান্তরিত করা হয়।বর্তমানে ১৩টি ইউনিয়ন নিয়ে এর আয়তন ৩১১.৬৬ বর্গ কিলোমিটার।

 

প্রাচীন নিদর্শনাদি ও প্রত্নসম্পদের মধ্যে জগন্নাথ মন্দির (১৯১৭), হিন্দুমন্দির (ফান্দাউক, মুঘল আমল),১৮শ শতাব্দীতে জমিদার “গৌরীপ্রসাদ রায় চৌধুরী” এবং “কৃষ্ণপ্রসাদ রায় চৌধুরী (১৮৭০-১৯৩৬)” কর্তৃক নির্মিত হরিপুর বড়বাড়ি (জমিদার বাড়ি/রাজবাড়ি), উমা ও মহেশ্বরের আলিঙ্গন মূর্তি (বর্তমানে জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত)উল্লেখযোগ্য।

★নাসিরনগর নামকরণঃ
নাসিরনগর নামের উৎপত্তি সম্পর্কে লোকমুখে বহুধরণের কথন প্রচলিত রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, হযরত শাহজালাল(রহ.) সাথে একজন যোদ্ধা ছিলেন, যার নাম নাসির উদ্দিন চেরাগ দেহলভী যিনি এ উপজেলায় খানকা স্থাপন করে ইসলাম ধর্ম প্রচার করেছিলেন।জানা যায়,নাসিরনগর পুরোটাই একসময় হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল ছিল। কথিত আছে তিনিই নাসিরনগরে ইসলামের বাতিকে জ্বালিয়ে রেখেছিলেন।সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন সিলেট বিজেতা হযরত শাহ জালালের অন্যতম সঙ্গী অনুসারী ও সিলেট অভিযানে প্রেরিত মুসলিম বাহিনীর প্রধান সেনাপতি ছিলেন। সিলেটের ইতিহাসে বহুল আলোচিত তরফ রাজ্য ১৩০৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মাধ্যমে বিজিত হয়। সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলায়
মুড়ারবন্দ নামক স্থানে সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনের মাজার অবস্থিত।
[১] তাঁর জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ সম্পর্কে জীবনী গ্রন্থে আনুমানের ভিত্তিতে ১২৫০ সালে জন্ম হয়েছে এবং শাহ জালালের মৃত্যুর পূর্বে (১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দের পুর্বে ) তিনি মৃত্যুর বরণ করেন বলে উল্লেখ্য রয়েছে। [২]এই নাসিরউদ্দিনের নামানুসারে নাসিরনগরের নামকরণ হয় নাসিরনগর।

➤অন্য একটি জনশ্রুতি হল,মোগল সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালে ঈশা খাঁ বংশের জনৈক মজলিশ গাজীকে সরাইল পরগনার দেওয়ান নিযুক্ত করা হয়। সেই বংশের জনৈক নাসির মাহমুদ দেওয়ানের নামানুসারে নাসিরনগরের নামকরণ করা হয়েছে।

তথ্যসূত্রঃ
১. ↑ সিলেটঃ ইতিহাস ঐতিহ্য ডঃ শরিফ উদ্দীন আহমদ, (শামস উদ্দীন আহমদ লিখিত প্রবন্ধ – মুসলিম শাসন ব্যবস্থা), ২০৯ পৃঃ, গ্রন্থ প্রকাশনায়- বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতি, প্রকাশকাল ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দ ।
২. ↑ তরফ বিজেতা সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন ও মুড়ারবন্দ দরগাহ শরিফ। সৈয়দ মোস্তফা কামাল। প্রকাশনায়-সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন স্মৃতি পরিষদ মুড়ারবন্দ দরগাহ শরিফ। প্রকাশ কাল জানুয়ারি ২০০৯ খ্রিস্টাব্দ।
৩. নামকরণের ইতিকথা।। এস এম শাহনূর
৪. উপজেলা তথ্য বাতায়ন।

================================

০৪ সরাইল উপজেলার নামকরণের ইতিকথা:

মেঘনা, তিতাস, বগদিয়া ও ভৈরব নদী বিধৌত, আকাশী বিল ও শাপলা বিলের নান্দনিক সৌন্দর্যে সুহাসিনী উপজেলা সরাইল।ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক অভূতপূর্ব মেলবন্ধন ঘটেছে এখানে। যুগ যুগ ধরে এর কৃষ্টি কালচার, শিক্ষা ও সংস্কৃতি উপমহাদেশে উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে।
মোঘল আমলে(১৩৩৮-১৫২৬) প্রায় দুইশত বৎসর এ নামটি সরাইল পরগণা হিসাবে চিহ্নিত হয়ে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে । বারো ভুঁইয়াদের অন্যতম ঈসা খাঁর জন্ম ১৫২৯ সালে সরাইল পরগণায়। তিনি সরাইলে অস্থায়ী রাজধানী স্থাপন করেছিলেন।ঈসা খাঁর দাদা রাজপুত বংশীয় ‘ভাগিরথ’ অযোধ্যা হতে বাংলায় এসে বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহের (১৫৩৩-৩৮) অধীনে দেওয়ান এর চাকরি লাভ করেন । তার পুত্র কালিদাস গজদানী পিতার মৃত্যুর পর দেওয়ানি লাভ করেন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে সোলায়মান খাঁ নাম গ্রহন করেন । সোলায়মান খাঁ সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহের কন্যা সায়েদা মোমেনা খাতুনকে বিয়ে করে সরাইল পরগনা ও পূর্ব মোমেনশাহীর জমিদারি লাভ করেন । সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদের মৃত্যুর পর সোলায়মান খাঁ নিজেকে সুলতানের উত্তরাধিকারি হিসেবে ঘোষণা দেন এবং সম্রাট শের শাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন । তিনি স্বাধীনভাবে তার জমিদারি পরিচালনা শুরু করেন এবং তার জমিদারির প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল সরাইল । ১৫৪৫ সালে শের শাহের মৃত্যুর পর তার পুত্র ইসলাম শাহ দিল্লীর সিংহাসন লাভ করেন এবং সোলায়মান খাঁকে তার আনুগত্য মেনে নিতে বলেন । সোলায়মান খাঁ তা প্রত্যাখ্যান করলে ইসলাম শাহ তার দুই সেনাপতি তাজ খান কররানী ও দারিয়া খান কে যুদ্ধের জন্য পাঠান । যুদ্ধে সোলায়মান খাঁর পরাজয় হয় ও তিনি মৃত্যুবরন করেন । তার দুই পুত্র ঈসা ও ইসমাইল কে বন্দি করে দাস হিসেবে ইরানি বণিকদের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয় । তারপর তাজ খান কররানী অধিকৃত এলাকার দখল লাভ করেন ও ঈসা খাঁর চাচা কুতুব খানকে তার আদালতে নিয়োগ দেন । তিনি ঈসা ও ইসমাইল কে ইরানি বণিকদের কাছ থেকে মুক্ত করেন । তারপর ঈসা খাঁ তার চাচা কুতুব খানের সাহায্যে সরাইলের জমিদারী দখল করেন । ১৫৬৫ সালে তাজ খান কররানীর মৃত্যুর পর আফগান শাসকদের সাথে মিলে মোগলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন । ১৫৮০ সালের দিকে তিনি তার প্রশাসনিক কেন্দ্র সরাইল থেকে স্থানান্তর করে সোনারগাঁতে নেন । প্রাচীনকালে এটি ভাটি (জলাবদ্ধ নিম্ন ভাগ) অঞ্চল হিসেবে পরিচিত ছিল । ১৮৩০ সালের পূর্বে সরাইল পরগণা ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল ।
১৮৩০ সালে সরাইল পরগনা ময়মনসিংহ হতে বিচ্ছিন্ন করে ত্রিপুরা জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয় ।ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে পরগনার পরিবর্তে জেলা ও মহকুমা ব্যাবস্থার প্রচলন করে । যার কারণে সরাইল পরগনা ভেঙ্গে দেয়া হয় । ১৮৬০ সালে ত্রিপুরা জেলা ভেঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার সৃষ্টি করার পর সরাইল পরগনাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার সাথে যুক্ত করা হয়। স্বাধীনতা উত্তর প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরনের সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে জেলা ঘোষণা করা হয় এবং ১৯৮২ সালের ৭নভেম্বর সরাইল উপজেলা হিসেবে ১০টি ইউনিয়ন নিয়ে কার্যক্রম শুরু করে। পরবর্তী পানিশ্বর(দঃ) ইউনিয়নটি নবগঠিত আশুগঞ্জ উপজেলায় চলে যায়।ফলশ্রুতিতে ১৯৯০ সালে সরাইল উপজেলা পুনর্গঠন করা হয়।।বর্তমানে এই উপজেলাটি ৯টি ইউনিয়ন ও ৭৬ টি মৌজা আর ১৪৬ টি গ্রাম নিয়ে গঠিত। এর নির্বাচনী এলাকা – ২৪৪ (ব্রাহ্মণবাড়িয়া – ২)।

 

★প্রাচীন নিদর্শনাদি ও প্রত্নসম্পদের মধ্যে হাটখোলা জামে মসজিদ (সপ্তদশ শতাব্দী), সরাইল শাহী জামে মসজিদ (মুগল আমল), আরিফাইলের সাগরদীঘি মসজিদ (ষোড়শ শতাব্দী), জোড়া কবর (জাতীয় জাদুঘরের তত্ত্বাবধানে), বারিউরার হাতিরপুল জামে মসজিদ (মুগল আমল), হাবলিপাড়ার ইদারা (মুগল আমল) উল্লেখযোগ্য। ।

*বিকাল বাজার শাহী মসজিদ – বিকাল বাজারে অবস্থিত ১০৭৪ হিজরি তথা ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দে মুঘল আমলে প্রতিষ্ঠিত।এটি”সরাইল শাহী জামে মসজিদ” – নামেও পরিচিত।

*সকাল বাজার (প্রাতঃবাজার) জামে মসজিদ -আওরঙ্গজেব (১৬৫৮-১৭০৭) এর শাসনামলে সরাইলের দেওয়ান নূর মোহাম্মদের স্ত্রী আরফান নেছা কর্তৃক ১৬৬২ খ্রিস্টাব্দে সরাইল উপজেলা চত্বরের নিকটে নির্মিত সকাল বাজারে অবস্থিত। মসজিদটি “হাটখোলা মসজিদ”, “আরফান নেছার মসজিদ”, ” প্রাতঃবাজার মসজিদ” প্রভৃতি নামেও পরিচিত।
ভিন্নমতে, মজলিশ শাহরাজের পুত্র নূর মোহাম্মদ কর্তৃক ১০৭৩ খ্রিস্টাব্দে মসজিদটি নির্মিত হয় বলেও জানা যায়।

*আরিফাইল মসজিদ ও মাজার –
সরাইল উপজেলা সদরের আরিফাইল গ্রামে সাগরদিঘীর পাশে অবস্থিত আরিফিল মসজিদ (আড়িফাইল মসজিদ নামে পরিচিত)। বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক স্থাপত্য। এটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এর তালিকাভুক্ত একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা। স্থানীয়ভাবে এটি “আইড়ল বা আড়িফাইল মসজিদ” নামে পরিচিত। স্থানীয় জনশ্রুতি অনুসারে ১৬৬২ সালে দরবেশ “শাহ আরিফ” এই মসজিদটি নির্মাণ করেন এবং তার নামানুসারে এই মসজিদের নামকরণ করা হয়।মসজিদের দক্ষিণ পাশে শাহ আরিফ সাধকের নামানুসারে সমাধি রয়েছে।

*হাতিরপুলঃ
ঐতিহাসিকগণ মনে করেন,’সরাইল’ ও ‘শাহবাজপুর’-কে যুক্ত করার জন্য ইট ও চুন-সুরকি ব্যবহার করে ১৬শ শতাব্দীতে অর্থাৎ ১৬৫০ সালে দেওয়ান শাহবাজ খান তার দেওয়ানি কালে প্রাচীন এ পুলটি নির্মাণ করেন। পুলটি বিশেষতঃ হাতি চলাচলের জন্য খালের উপর নির্মিত হয়, তাই লোকমুখে এটি ‘হাতির পুল’ নামে পরিচিতি লাভ করে।এটি মুঘল পুল, ‘বাড়িউড়া প্রাচীন পুল’ নামেও পরিচিত।

★সরাইলের নামকরণঃ
সরাইল নামকরণ নিয়ে দুটো মত প্রচলিত রয়েছে।আভিধানিক এবং ঐতিহাসিক বিচারে এলাকার লোকজনের নিকট দুটো মতই গ্রহনযোগ্যতা পেয়েছে। সর অর্থ সরোবর বা হ্রদ । এটাকে ব্যাখ্যা করলে বুঝায় বিশাল জলাশয় অার অাইল শব্দের অর্থ বাঁধ বা উচুভূমি । অর্থাৎ প্রাচীনকালে এ এলাকা ছিল বিশাল জলরাশিতে ভরা এক জলমগ্ন স্হান । কালের বিবর্তনে এখানে ধীরে ধীরে বেশ কিছু চর পড়তে থাকে যা দূর থেকে জমির অাইল বা বাঁধের মত দেখাত। এতে করে বিশাল জলাশয়ের সরঃ জেগে উঠা আইলে বা ভূখন্ডে জনপদ গড়ে উঠতে থাকে অার তাই অর্থাৎ বিশাল জলরাশিতে জেগে উঠা ভূখন্ডে সরঃ + আইল = সরাইল নামে পরিচিতি পায়। ওই বিশাল জলরাশিকে কালীধর সায়র বা কালীদহ সাগর বলে গবেষকরা চিহ্নিত করেছেন,যা প্রাচীনকাল থেকে এ এলাকার বিভিন্ন অঞ্চলে কবি গান ও পুঁথি পাঠ অাসরের গাওয়া বন্দনা- গীতির শুরুতেই উল্লেখ পাওয়া যায় ।

★ অন্য একটি মতে,সরাইখানা শব্দের অর্থ ক্ষণস্হায়ী বসবাস । ফার্সী ঈল শব্দের অর্থ বিদ্রোহী বন্ধু । সরাইখানার সরাই ও ঈল শব্দ মিলে (সরাই+ঈল) সরাইল শব্দের উৎপত্তি । অর্থাৎ বিদ্রোহী বন্ধুর বাসস্হান । ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ, বাহরাম খানের শিলহদর( বর্মরক্ষক) অর্থাৎ দেহরক্ষী হিসেবে বিদ্রোহী হয়ে তিনি যে স্হানে সামরিক প্রস্ততির জন্য ক্ষণস্হায়ী রাজধানী স্হাপন করেছিলেন সেই স্হানটি দিল্লীর সুলতান ও সভাসদগণ এবং স্থপতিগণ কর্তৃক সরাই+ঈল = সরাইল নামে আখ্যায়িত হয়েছিল । দিল্লী থেকে প্রচারিত হতে হতে এটাই কালের অাবর্তে পরবর্তী শাসন আমলে সরাইল নামে পরিচিত ও গৃহীত হয়েছিল বলে মনে করা হয়

================================

০৫ আশুগঞ্জ উপজেলার নামকরণের ইতিকথা:

প্রমত্ত মেঘনার জলধারায় প্লাবিত উর্বর পলিমাটি দিয়ে গড়ে উঠেছে আশুগঞ্জ উপজেলা।মহাভারত প্রণেতা বেদব্যাসের পদ্ম পুরাণ গ্রন্থে ও জনশ্রুতিতে যে কালিদহ সায়র(কালিদাস সাগর)এর উল্লেখ পাওয়া যায় সেই কালিদহ সায়রের তলদেশ থেকে ধীরে ধীরে স্থল ও জনপদে পরিণত হয় আশুগঞ্জ।জানা যায়,১৮৯৮ খ্রিঃ সলিল কন্যা মেঘনার তটস্থিত সুপ্রাচীন জনপদ আশুগঞ্জের গোড়াপত্তন হয়।মূলতঃ চরচারতলা, আড়াইসিধা, যাত্রাপুর, বড়তল্লা, সোনারামপুর, তালশহর, সোহাগপুর, বাহাদুরপুর গ্রামকে ঘিরে গড়ে উঠা এ জনপদ সুপ্রাচীনকাল থেকেই শিল্প, কৃষি, শিক্ষাসহ সকল ক্ষেত্রে অনন্য সাধারন ভূমিকা রেখে আসছে।১৯৮৪ সালের ২৮ নভেম্বর আশুগঞ্জ থানার কার্যক্রম শুরু হয়।পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালের ১৮ জুলাই ৭টি ইউনিয়ন নিয়ে আশুগঞ্জ উপজেলা বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ শুরু হয়।২০০০ সালের ২৫ জুলাই আশুগঞ্জ থানাকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয়।একই বছর ২৩ অক্টোবর থেকে শুরু হয় উপজেলার প্রশাসনিক কার্যক্রম।মেঘনা নদীর বদ্বীপ আশুগঞ্জ দেশের একটি উল্লেখযোগ্য বন্দর ও শিল্প নগরী।বৃটিশ শাসনামলে ইংরেজদের পাট ক্রয় কেন্দ্র ও পাটের বড় বাজার হিসেবে আশুগঞ্জের পরিচিতি ছিল।সময়ের ব্যবধানে ইংরেজরা এখানে অসংখ্য পাটকল স্থাপন করে।আশুগঞ্জের পাট সে সময় ইংল্যান্ডের শিল্পনগরী ডান্ডিতে রপ্তানি হতো।দেশের অন্যতম বৃহৎ সেচ প্রকল্প ‘‘আশুগঞ্জ সবুজ প্রকল্প’,’ বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র,ভারতীয় ট্রানজিটের আন্তর্জাতিক নৌবন্দর এখানেই অবস্থিত।এই উপজেলায় বর্তমানে ৩০টি মৌজা,৪১টি গ্রাম, ৮ টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা রয়েছে। আশুগঞ্জ উপজেলাটি জাতীয় সংসদের নির্বাচনী এলাকা ২৪৪(ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২)এর অধীন।

 

 

★প্রাচীন নিদর্শনাদি ও প্রত্নসম্পদের মধ্যে মেঘনা নদীর উপর অবস্থিত(ভৈরব ও আশুগঞ্জের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী)সেতুটি,যা ভৈরব রেলওয়ে সেতু নামে সমধিক পরিচিত, এটি ১৯৩৭ সালে উদ্বোধন করা হয়।আশুগঞ্জ তহশিল অফিস (১৯০৪ সাল) উল্লেখযোগ্য।

★মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলীঃ ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল আশুগঞ্জে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াইয়ে মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন, শাহজাহান, ল্যান্স নায়েক আঃ হাই, সুবেদার সিরাজুল ইসলাম এবং সিপাহী আব্দুর রহমান শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী সন্দেহভাজন লোকদের ধরে এনে সাইলো বধ্যভূমিতে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করত। পাকবাহিনী ৯ ডিসেম্বর সকালে আশুগঞ্জ-ভৈরব রেলসেতুর আশুগঞ্জের দিকের একাংশ ডিনামাইট দিয়ে ধ্বংস করে। সেতু ধ্বংস করার পর পাকবাহিনী আশুগঞ্জ ছেড়ে চলে গেছে এমন ধারণা থেকেই যৌথবাহিনী আশুগঞ্জ দখল করতে অগ্রসর হয়। আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রায় ৫০ গজের মধ্যে আসামাত্র পাকবাহিনী অগ্রসরমান ১৮ রাজপুত বাহিনীর উপর প্রচন্ড হামলা চালায়। হামলায় মিত্রবাহিনীর ৪ জন সেনাঅফিসারসহ প্রায় ৭০ জন শহীদ হন। ১০ ডিসেম্বর রাতে পাকবাহিনী আশুগঞ্জ ত্যাগ করে।

★মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্নঃ
*গণকবর ১টি (লালপুর বাজার);
*বধ্যভূমি ২টি (আশুগঞ্জ সাইলো)।

★আশুগঞ্জ নামকরণঃ
সবুজ শ্যামল পাখি ডাকা ছায়া সুনিবিড় মেঘনা পাড়ের আজকের বিখ্যাত আশুগঞ্জের প্রতিষ্ঠাকাল প্রায় একশত একুশ বছর পূর্বে।আশুগঞ্জ পতিষ্ঠার পূর্বে মেঘনার পূর্ব পাড়ের জনগণ ভৈরব বাজারে গিয়েই তাদের দৈনন্দিন কেনাবেচা করত। প্রতি বুধবার বসত ভৈরবের সপ্তাহিক হাট। ভৈরব বাজারের তদানীন্তন মালিক ভৈরব বাবু কর্তৃক আরোপিত করভারে মেঘনার পূর্ব পাড়ের ক্রেতা-বিক্রেতারা অতিষ্ট হয়ে মেঘনার পূর্ব পাড়ে সৈকতের বালিকণা তথা সোনারামপুর মাঠের উপর হাট বসিয়ে নেয়। প্রতি বুধবারে নদী সৈকতের চিকচিক বালিকণার উপর হাট বসেই চললো। তখন অত্র এলাকা সরাইল পরগনার জমিদারের অধীন ছিল।তৎকালীন সরাইল পরগনার জমিদার কাশিম বাজারের মহারাজা আশুতোষ নাথ রায় আশাব্যঞ্জক এ সংবাদ জানতে পেরে তিনি উদ্যোক্তাদের ডেকে পাঠান। উদ্যোক্তাগণ মহারাজার ডাকে সাড়া দিয়ে নিজেদের দুর্গতি অবসানের জন্য মহারাজার নামের সাথে মিল রেখে ঐ হাটকে ‘‘আশুগঞ্জ’’ নামকরণ করেন।

★তথ্যসূত্রঃ
১.নামকরণের ইতিকথা।।এস এম শাহনূর
২.ইতিহাস ও ঐতিহ্যে আশুগন্জ,মোহাম্মদ কামাল হোসেন,পলাশ শিমুল ১৯৯৪,আশুগন্জ পলাশ শিমুল কচি-কাচার মেলা।
৩.উপজেলার নাম আশুগঞ্জ,মোহাম্মদ কামাল হোসেন, বিকাশ ২০০৮,সমন্বিত সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র,আশুগঞ্জ।
৪.সমতট, ইতিহাস বিভাগের ৮ম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী স্মারক (২০১০-২০১৮), ফিরোজ মিয়া কলেজ,আশুগঞ্জ,ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

================================

০৬ আখাউড়া উপজেলার নামকরণের ইতিকথা:

ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী স্থানে অবস্থিত আখাউড়া উপজেলা এক সময় পূর্ববঙ্গের প্রবেশদ্বার বলে পরিচিত ছিল।হাওড়া,তিতাস নদী এবং পিপুলি বিলের আখাউড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ উভয়ের জন্য একটি ঐতিহাসিক শহর।ঐতিহাসিক তথ্যসূত্র থেকে প্রতীয়মান হয় তারও আগে কোন এক সময় এই অঞ্চলটি হরিকেল নামক জনপদের অংশ ছিল।কালক্রমে এটি ত্রিপুরা রাজ্যের জমিদার মহারাজা বীর বিক্রম রাধা কিশোর মানিক্য বাহাদুরের(১৮৫৭-১৯০৯) জমিদারির অংশে পরিণত হয়।[১৮৯৭ খৃষ্টাব্দে (১৩০৭ ত্রিপুরাব্দে) মহারাজ রাধাকিশোর মাণিক্য প্রায় ৪০ বৎসর বয়ঃক্রম কালে সিংহাসন আরোহণ করেন।১] এই জমিদারের চাকলা রৌশনাবাদ এষ্টেটের মোগড়া রাজকাচারী ও আখাউড়াস্থ তহশীল কাচারী ছিল বর্তমান আখাউড়া সদর থেকে ৪ কিলোমিটার দক্ষিণে। এই কাচারী দুটির মাধ্যমে এই অঞ্চলের জমিদারীর যাবতীয় খাজনাদি আদায়সহ জমিদারী ব্যবস্থা ও কার্যাদি পরিচালিত হত। ব্রিটিশ আমলে আখাউড়া থেকে প্রচুর পাট সুদূর বিলেতের শিল্পনগরী ডাণ্ডিতে রপ্তানি হতো।ফলে ব্রিটিশ শাসনামলেও আখাউড়া রেলস্টেশনটি(১৮৯৭-৯৮ সালে আখাউড়া হয়ে বদরপুর পর্যন্ত রেলপথ স্থাপিত হয়) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।বর্তমানে আখাউড়া বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ রেলওয়ে জংশন। এ জংশনের সঙ্গে চট্টগ্রাম, সিলেট, ঢাকা ও ময়মনসিংহের রেলযোগাযোগ রয়েছে।তৎকালীন বৃটিশ আমল অর্থাৎ ইংরেজ শাসনামলে আখাউড়া (৫টি ইউনিয়ন) কসবা থানার অন্তর্গত ছিল। এই সময় একটি পুলিশ ফাঁড়ির মাধ্যমে প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হত।স্বাধীনতাত্তোরকালে ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২০শে জুন তারিখে মনিয়ন্দ, ধরখার, মোগড়া, আখাউড়া উত্তর ও আখাউড়া দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদ নিয়ে আখাউড়া থানা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।অত:পর ১৯৮৩ সনে তৎকালীন সরকারের প্রশাসন বিকেন্দ্রিকরণের অংশ হিসেবে ১৪.০৯.১৯৮৩খ্রিঃ তারিখে উপজেলায় উন্নীত করা হয়। আখাউড়া পৌরসভা সৃষ্টি হয় ১৯৯৯ সালে।
এই উপজেলাটি ৫টি ইউনিয়ন, ১০৭টি মৌজা ও ২২৫টি গ্রাম নিয়ে গঠিত।

 

★প্রাচীন নিদর্শনাদি, প্রত্নসম্পদ ও স্থাপনাগুলোর মধ্যে খড়মপুর হযরত সৈয়দ আহমদ গেছুদারাজ কল্লা শহীদ (রঃ) মাযার(১৮০০ শতাব্দী),ছতুরা দরবার শরীফ বড় মসজিদ, মোগড়ার মঠখোলা, মহারাজের কাচারী,আখাউড়া স্থলবন্দর(১৯৯৪ সালে চালু হয়।১৯শে এপ্রিল ২০১১ থেকে এ স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে আনুষ্ঠানিক ভাবে পন্য পরিবহন শুরু হয়), বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের কবর উল্লেখযোগ্য।

★খড়মপুর :যেন এক পৌরাণিক জনপদ।
খড়মপুরে অবস্থিত তৎকালীন আগরতলা রাজ্যের মহারাজার দান করা ২৬০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হজরত সৈয়দ আহম্মদ গেছুদারাজ(র:)-এর দরগাহ যা কল্লা শহীদের দরগাহ নামে সমগ্র দেশে পরিচিত।
মাজার কমপ্লেক্স সংলগ্ন প্রায় ১১শ বছরের পুরাতন মসজিদ।মসজিদের গায়ে লেখা আছে ৩শ ২৩ ত্রিপুরা। ত্রিপুরায় পুরনো বাংলা সন অনুসরণ করা হয়। কাজেই এই মসজিদের বয়স ১১ শ বছরের মতো।

★গঙ্গাসাগর: কথিত আছে, প্রায় পনেরশ বছর আগে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজা বীর বিক্রম ঈশ্বরচন্দ্র মানিক্য বাহাদুর তৎকালীন সময়ে এ অঞ্চলের পানীয় জলের অভাব দূর করতে বিশাল এই দীঘি খনন করে গঙ্গা দেবীর নামানুসারে দীঘির নাম দেন গঙ্গাসাগর। দীঘির উত্তরপাড়ের লাগোয়ো তফসিল কাচারী রাজার কর আদায়ের স্বাক্ষী।অন্ধকার ঘরটির ভেতরের মেঝেতে এখনও কয়েকটি সিন্দুকের শেষাংশের ছাপ ষ্পষ্ট।অতীতে নৌ-পথের গুরুত্ব যখন অধিক ছিল, তখন হাওড়া নদীর তীরবর্তী গঙ্গাসাগর ছিল মূলতঃ আগরতলার নদী-বন্দরস্বরূপ। গঙ্গাসাগরের পূর্বনাম ছিল রাজদরগঞ্জ বাজার। এ বাজার তৎকালীন সময়ের বিশিষ্ট ব্যাংক ‘দি এসোসিয়েটেড ব্যাংক লি. অফ ত্রিপুরা’র প্রধান অফিস হিসেবে স্থাপিত হয়েছিল। তখনো উপমহাদেশে ব্যাংকের প্রচলন সঠিকভাবে হয়নি। তাছাড়া ত্রিপুরা রাজ্যের ভাটি অঞ্চলের খাজনা আদায়ের মহল অফিসও এ রাজদরগঞ্জ বাজারেই ছিল। রাজদরগঞ্জ বাজারের পরবর্তী নাম মোগড়া বাজার। এখানে ‘সেনাপতি বাড়ি’ নামে একটি জায়গা আছে। তাই মনে করা হয়ে থাকে যে, ত্রিপুরা-রাজ্যের কোন এক সেনাপতি এখানে বসবাস করতেন স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে।

★ঘাগুটিয়া পদ্মবিল:
পদ্ম ফুলের বৈজ্ঞানিক নাম Nelumbo nucifera। গোত্রের নাম নিমফেসি।প্রাকৃতিক রুপ লাবণ্য ও অপার সৌন্দর্যে ভরা মনিয়ন্দ ইউনিয়নের বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তবর্তী ঘাগুটিয়া(গ্রাম)পদ্মবিল।শরৎকাল এলেই ঘাগুটিয়ার এ বিলে ফুটে গোলাপি, হলুদ ও সাদা রঙের তিন প্রজাতির পদ্মফুল। তা দেখতে শিশু,কিশোর-কিশোরী,বৃদ্ধ সহ নানা বয়সের মানুষ এখানে প্রতিদিন সকাল বিকাল ভীড় জমায়।দখিনা বাতাসে পদ্ম ফুলের দোলানি দেখে মন ভরে যায় সবার। পদ্ম ফুলের ওপর ওড়াউড়ি করে নানান রঙের প্রজাপতি,হরেক প্রজাতির পাখী। পাখীদের কিচির মিচির শব্দ আর মনোমুগ্ধকর পরিবেশে এসে আপনিও হারিয়ে যাবেন কোন এক অন্যলোকে

★মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলীঃ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আখাউড়া ২নং সেক্টরের অধীন ছিল। এ সেক্টরের গুরুত্বপূর্ণ রণক্ষেত্রগুলো হচ্ছে আখাউড়া, দেবগ্রাম, তারাগণ, চেকপোস্ট সড়ক ও দরুইন। দরুইনে ১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল মুখোমুখি লড়াইয়ে সিপাহী মোস্তফা কামাল শহীদ হন। এ গ্রামেই বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোস্তফা কামালের সমাধি অবস্থিত।

★মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্নঃ
মোগড়া গঙ্গাসাগর দীঘির পশ্চিম পাড়ের (৩৩ জন শহীদ)গণকবর এবং আখাউড়া ত্রিপুরা সীমানাস্থ সেনারবাদী গণকবর।

★আখাউড়া নামকরণঃ
ত্রিপুরা রাজ্যের ইতিহাস গ্রন্থ রাজমালা থেকে জানা যায়,এলাকাটি এক সময় ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। সে সময়ে ত্রিপুরা রাজ্যের মহারাজা রাধাকৃষ্ণ মাণিক্য এই এলাকায় (রাধানগর গ্রামে) একটি রাধাকৃষ্ণের মন্দির স্থাপন করেন, যা স্থানীয় লোকজনের নিকট আখড়া নামে পরিচিত ছিল। কালক্রমে ভাষার বিকৃতি ঘটে আখড়া আখাউড়ায় রুপান্তর হয়।

★নামকরণের পিছনের ইতিহাসঃ
ত্রিপুরা রাজ্যের জমিদার মহারাজা বীর বিক্রম রাধা কিশোর মানিক্য বাহাদুরের জমিদারীর দ্বিতীয় রাজধানী ছিল কুমিল্লা। কুমিল্লার রাজবাড়ীতে যাতায়তের জন্য সে সময় আখাউড়া-আগরতলা সড়ক ব্যবহৃত হতো।এছাড়া আসাম বেঙ্গল রেলপথে চলাচলের জন্য জমিদার সপরিবারে আখাউড়া কাচারীতে অবস্থান করতেন।
তিনি এ অঞ্চলের রাধানগরে রাধামাধবের আখড়া, দুর্গাপুরে দুর্গাদেবীর আখড়া, মোগড়া হাওড়া নদীর পাড়ের আখড়া, মনিয়ন্দের আখড়া ইত্যাদি নিজ খরচে নির্মাণ করেছিলেন। সে সময়ে এ অঞ্চলে আখড়ার আধিক্যের কারণে এটি কালক্রমে আখাউড়া নামে পরিচিতি লাভ করে।

★তথ্যসূত্রঃ
১. রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/পঞ্চম পরিচ্ছেদ/৯
২. নামকরণের ইতিকথা।।এস এম শাহনূর
৩. রাজমালা।।কৈলাস চন্দ্র সিংহ
৪. আখাউড়া উপজেলা সাংস্কৃতিক সমীক্ষা প্রতিবেদন ২০০৭।
৫. মাঠ পর্যায়ে ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা।
৬. ↑ Fida, Quazi Abul (২০১২)। “Railway” ।
Islam, Sirajul ; Jamal, Ahmed A.।
Banglapedia: National Encyclopedia of Bangladesh (Second সংস্করণ)। Asiatic Society of Bangladesh।

=================================

০৭ নবীনগর উপজেলার নামকরণের ইতিকথা:

মেঘনা-তিতাস বিধৌত ঐতিহ্যের সৌরভে আর গৌরবে অনন্য নবীনগর। ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার নবীনগর একটি প্রাচীন জনপদ। বৌদ্ধ শাসনামলে এই এলাকা ছিল সমতট রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। পরে সোনার গায়ের মুসলিম শাসকদের অধীনস্থ হয়। মুসলিম শাসনকালে ৩টি পরগনায় বিভক্ত ছিল বর্তমান নবীনগর উপজেলা। নবীনগর হতে দক্ষিণ মুখী প্রবাহিত বুড়িনদীর(তিতাস নদীর শাখা) পশ্চিম অংশ ছিল রবদাখাত পরগনার্ভুক্ত,পূর্বাঞ্চলের ০৫টি ইউনিয়ন(বুড়ি নদীর পূর্বে) ত্রিপুরা রাজ্যের চাকলা রোশনাবাদ অঞ্চলের নূরনগর পরগনা হিসেবে এবং উত্তর দিকের মেঘনা-তিতাস-পাগলা নদী তীরবর্তী গ্রামগুলিকে শাহবাজপুর জনপদের সরাইল পরগনার আওতাধীন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ইংরেজ শাসনামলে ১৭৭৮ সালে প্রকাশিত ভারতবর্ষের প্রথম ম্যাপ রোনাল্ড রে প্রণীত মানচিত্রে নবীনগরকে খুব গুরুত্বের সাথে চিহ্নিত করা হয়েছে। সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, মলয়া গানের সাধক কবি মহর্ষি মনোমোহন দত্তের জন্মভুমি এ উর্বর পলিমাটি। প্রাচীন কালের কালীদহ সায়র(সাগর)এর উত্তর প্রমত্তা সীমার হাজার বছরের বিবর্তণে জেগে ওঠা বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগের একাংশ-ই আজকের নবীনগর উপজেলা।

নাটঘর গ্রাম থেকে উদ্ধার হওয়া সপ্তম শতাব্দীর শিবমূর্তি, বাঘাউড়া গ্রামের সপ্তম শতাব্দীর কস্টিপাথরের বিষ্ণু মূর্তি ( কলিকাতা যাদুঘরে সংরক্ষিত), সাতমোড় গ্রাম থেকে উদ্ধারকৃত সপ্তম শতাব্দীর কস্টিপাথরের বিষ্ণু মূতি ( ঢাকা জাতীয় যাদুঘরে সংরক্ষিত), শাহপুর গ্রামের মসজিদ,(১৮৭৬ খ্রি:),বিদ্যাকুট গ্রামের সতীদাহ স্মৃতি মন্দির, মুন্সেফ আদালত (১৮৮৪) নবীনগর,বিটঘর,কাইতলা,কৃষ্ণনগর গ্রামের প্রাচীন জমিদার বাড়িসহ রতনপুর গ্রামের দারোগাবাড়ির বিলুপ্তপ্রায় ভবনটি নবীনগর উপজেলার প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে।
নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র থেকে জানা যায়,১৮৭৫ সালে প্রথম নবীনগর থানা প্রতিষ্ঠিত করা হয়। ।একই সময়ে রছুল্লাবাদ গ্রামেও একটি পুলিশ ফাঁড়ি ছিল বলে জানা যায়। ১৯২৬ সালের ১৫ এপ্রিলের কলিকাতা গেজেটের বিজ্ঞপ্তি অনুসারে রছুল্লাবাদ ফাঁড়িটি বিলুপ্তি হয়।ঐ সময় মোট ২৩৪ টি গ্রাম নিয়ে নবীনগর থানা পুনর্গঠিত হয়।
১৮৮৩ সালে নবীনগরে প্রথম মুন্সেফ আদালত চালু হয়।১৯৮৩ সালের ২৪মার্চ নবীনগর থানাকে আনুষ্ঠানিকভাবে উপজেলায় উন্নীত করা হয়।এই উপজেলাটি ১৬১টি মৌজা, ২১টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। এটি জাতীয় সংসদের নির্বাচনী এলাকা ২৪৬ (ব্রাহ্মণবাড়ীয়া ৫)-এর অধীন।পরবর্তী সময় ১৯৯৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর উপজেলা সদর সহ পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকের কয়েকটি গ্রাম নিয়ে নবীনগর পৌরসভা গঠন করা হয়।বর্তমানে নবীনগর পৌরসভা ১ম শ্রেণির পৌরসভার মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে।

 

নবীনগর নামকরণঃ

নবীনগর একটি প্রাচীন জনপদ। তাই এ জনপদের নামকরণও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। নবীনগর নামকরণ নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। এ প্রেক্ষিতে একাধিক ভিন্ন জনশ্রুতি প্রচলিত আছে।

➤প্রথম ধারার জনশ্রুতি:
প্রাচীনকালের জনৈক নবীন চন্দ্র নামক রাজার নামানুসারে নবীন এবং গড় শব্দের অপভ্রংশ(গড়>গর) থেকে নবীনগর নামকরণ হয়েছে।
[কিন্তু এ এলাকার প্রাচীন ইতিহাসে নবীন চন্দ্র নামে কোন রাজা এমনকি জমিদারেরও সন্ধান পাওয়া যায়নি বলে এ জনশ্রুতি মেনে নেয়া যায় না।]

➤দ্বিতীয় ধারার জনশ্রুতি:
কেউ কেউ বলেন , নবীর নামে এই নবীনগর। অনেকেই দাবি করেন,মুসলিম শাসনামলে ঈদে মিলাদুন্নবীর দিন মুসলমানদের নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ‘নবী’ এবং নগর দুটি শব্দের সংমিশ্রণে নবীনগর নামকরণ করা হয়েছে।
[তবে এখানে কোনো নবী না এলেও অসংখ্য সুফি আউলিয়ার পদচারণা ছিল | কালের সাক্ষ্য হিসেবে উপজেলার পূর্বপাশে ‘বার আউলিয়ার বিল’ এখনাে দৃশ্যমান আছে । ফলে সুফি -আউলিয়াদের দ্বারাও এ অঞ্চলের আবাদ হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত সূফি দরবেশ হযরত শাহজালাল (১২৭১ – ১৩৪১) রাহ: ৭০৩ হিজরি মোতাবেক ১৩০৩ ইংরেজী সালে ৩২ বছর বয়সে ইসলাম ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে অধুনা বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে এসেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। হযরত শাহজালাল (র:) ও তার সফরসঙ্গী ওলী আউলিয়ারা এ অঞ্চলের ওপর দিয়ে নদীপথে সিলেট যান বলে জনশ্রুতি আছে। ধারনা করা হচ্ছে, তাঁরা সে সময় যাত্রা বিরতি করে ইসলাম ধর্মের প্রচারের উদ্দেশ্যে এ অঞ্চলে কিছুকাল অবস্থান করেন।বরকন্দাজ তাউলিয়া , শেখ সাদী সফী , ছানাউল্লাহ (রঃ) প্রমুখ আধ্যাত্মিক পুরুষের প্রভাব এ অঞ্চলে অস্বীকার করা যায় না। নদী তীরবর্তী নাসিরাবাদ, শাহবাজপুর,নবীনগরসহ বিভিন্ন গ্রামের ইসলামী নামকরণের প্রবনতা দ্বিতীয় জনমতকেই জোরালো করে।]

➤ তৃতীয় ধারার জনশ্রুতি:
বিখ্যাত ভূমি জরিপকারী জেমস রেনেলের (১৭৬৪- ৭৬ ) মানচিত্রে বলদাখাল পরগনা , নূরনগর পরগনাসহ এই অঞ্চলের কিছু কিছু গ্রামের নাম পাওয়া যায় । কিংবদন্তি আছে , ১০৫০ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সরাইল , দাউদপুর , নূরনগর ও বলদাখাল পরগনা কালিদহ সাগরের অংশবিশেষ ছিল। [চাঁদ সওদাগরের সপ্তডিঙ্গা বা সওদাগরি জাহাজ এই কালিদহ সাগর দিয়ে সিলেট ও ময়মনসিংহের বাণিজ্যিক এলাকায় পণ্যসম্ভার ক্রয়-বিক্রয়ে ব্যস্ত ছিল।] এই অঞ্চলটি কালিদহ সাগরের তলদেশ থেকে ধীরে ধীরে চর জেগে বহুকাল ধরে একটি বসতি স্থাপনের যােগ্য হয়েছে। সে সময় পাটিকারা , গঙ্গামণ্ডল , লৌহগড়া ও চান্দিনার সমতলভূমি আবাসযােগ্য ও জনবসতিপূর্ণ ছিল। সেক্ষেত্রে এটি নিঃসন্দেহে বড় এলাকা। সে হিসেবে ‘ নবীন ’ ও ‘ গড় ‘ এই দুটি শব্দের সমন্বয়ে পরবর্তীকালে লােকমুখে উচ্চারিত হয়েছে নবীনগর। এ রূপান্তর হওয়ার বিষয়টি অমূলক নয় বলে মনে হয় ।

➤ চতুর্থ ধারার জনশ্রুতি:
১৯১০ খ্রিস্টাব্দে নবীনগরের শিবপুরে প্রাপ্ত বিষ্ণুমূর্তির নামফলকের ইতিহাস থেকে অবগত হওয়া যায় যে , (৯৮৮ – ১০৩৮ খ্রিস্টাব্দ) এই অঞ্চলে সমতট রাজ্যের শ্রী মহিপাল দেবের রাজত্ব ছিল। শ্ৰী মহিপাল এর রাজত্বের পরই এই এলাকায় শ্রী নবীনপাল দেব নামে এক পাল বংশীয় শাসকের জনশ্রুতি রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন , ঐ শাসকের নামানুসারেই এ অঞ্চলটি হলাে নবীনপাল দেব এর এলাকা বা নবীনগর যা। পরবর্তী পর্যায়ে আধুনিক নবীনগর ।

➤ পঞ্চম ধারার জনশ্রুতি:
নবীনগর নামকরণ ব্যাপারে আরও একটি তথ্য পরিবেশন করা হয় , ঈদ – ই মিলাদুন্নবীর দিনে এ অঞ্চলে নতুন শাসকের উদ্ভবের সুবাদে এ অঞ্চলটির নামকরণ হয় নবীনগর। বলা হয়, এই অঞ্চলের হিন্দুত্ববাদের পতন ঘটিয়ে মুসলিম বীর সেনাপতি ইখতিয়ারউদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজি(আফগানিস্তানে জন্ম, সাল অজানা- মৃত্য ১২০৬ খ্রিস্টাব্দ) উত্তর বাংলা বিজয়ের পর এ অঞ্চলে সেনাপতি প্রেরণ করেন এবং কোনাে এক মুসলিম শাসক এসে নবীনগর এর সৃষ্টি করেন। সম্প্রতি নবীনগর শব্দের বানান রীতিতেও নবিনগর ‘ । “ ই ‘ কার এর পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে ।বিষয়টি আরও ব্যাপকভাবে গবেষণার দাবি রাখে ।

➤ ষষ্ঠ ধারার জনশ্রুতি:
নানা মহলে এও জনশ্রুতি আছে যে , বলদাখাল বা বরদাখাত পরগনার জমিদার বেগম রওশন আরার কর্মচারী সীতারাম পােদ্দার ওই জমিদারির এক অংশ ক্রয় করে নবীনগরের গােড়াপত্তনে সচেষ্ট হন বিধায় তারই বংশধর নবীন পােদ্দার – এর নাম থেকে নবীনগর নামকরণ করা হয়েছে।

➤ সপ্তম ধারার জনশ্রুতি:
কথিত আছে, অতীতে এই অঞ্চল নদীগর্ভে বিলীন ছিল। পরবর্তীতে পলি জমে এখানে চর পড়ে। কিছু সংখ্যক লোক এখানে এসে বসতি স্থাপনের জন্য নতুন নতুন ঘর (অর্থাৎ নবীন ঘর) নির্মাণ করে। এই নবীন ঘরই কালক্রমে পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান নবীনগর নামের উৎপত্তি।

➤ অষ্টম ধারার জনশ্রুতি:
আবার বলা হয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান এই চরে প্রথমে বসতি স্থাপন করলে তারা নবী হযরত মুহম্মদ (সাঃ) এর পবিত্র নামানুসারে এই জনপদের নাম রাখেন নবীনগর। তুলনামূলকভাবে এ ধারার জনশ্রুতির সত্যতার স্বপক্ষে বেশী লোকের মতামত পাওয়া যায়।

তথ্যসূত্রঃ
➤নামকরণের ইতিকথা।।এস এম শাহনূর

লেখক: এস এম শাহনূর
(কবি ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক)

 

 

=================================

০৮ বাঞ্ছারামপুর উপজেলার নামকরণের ইতিকথা:

প্রমত্তা মেঘনা,শান্তধীর তিতাস বিধৌত,চন্দন বিল ও বামন্ধার বিলের উপজেলা বাঞ্ছারামপুর।নির্ভরশীল তথ্য উপাত্ত থেকে জানা যায়,এক সময় স্থলভাগ থেকে প্রায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এ জনপদে প্রথম দিকে ১৯০৪ সালে অথবা ১৯১২ সালে একটি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপিত হয়। পরবর্তীকালে ১৯২০ সালে ৭টি ইউিনয়ন নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ থানা এবং ১৯৬৫ সালে ১৩টি ইউিনয়ন,৭৪টি মৌজা ও ১২১টি গ্রাম নিয়ে গঠন করা হয় বাঞ্ছারামপুর উপজেলা।এবং তা ১৯৮৩ সালে উপজেলা হিসাবে চুড়ান্ত ও পূর্ণাঙ্গ রূপলাভ করে।

 

 

★প্রাচীন নিদর্শনাদি ও প্রত্নসম্পদের মধ্যে খোশকান্দি জামে মসজিদ,বাঞ্ছারামপুর সদর জামে মসজিদ, ধারিয়ারচর জামে মসজিদ, উজান চর কালীমন্দির, রূপসদী দক্ষিণবাজার কালীমন্দির,রূপসদী জমিদার বাড়ি(১৯১৫ সালে ভারত থেকে নকসা ও রাজমিস্ত্রী এনে জমিদার তীর্থবাসী চন্দ্র রায় ৫ একর জমির উপর বিশাল অট্টালিকা নির্মাণ করেন।সে সময় এ বাড়িতে তিনটি পুকুর ছিল) উল্লেখযোগ্য।

★বাঞ্ছারামপুর নামকরণঃ
জনশ্রুতি আছে, ঢাকার তৎকালীন জমিদার রূপলাল বাবুর একজন বিশ্বস্ত রায়ত বাঞ্ছারাম দাস বর্তমান উপজেলা সদরে বাস করতেন। তার আচার-ব্যবহার এবং কাজকর্মের বিশ্বস্ততা ও আনুগত্যের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তার নামে এই অঞ্চলের নামকরণ করা হয় বাঞ্ছারামপুর।

=================================

০৯ বিজয়নগর উপজেলার নামকরণের ইতিকথা:

ইতিহাসে দক্ষিণ ভারতের একটি মধ্যযুগীয় সাম্রাজ্যের নাম বিজয়নগর।। ১৩৩৬ খ্রিস্টাব্দে (প্রথম) হরিহর ও তাঁর ভ্রাতা (প্রথম) বুক্কা রায় এই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।রাজধানী ছিলো বিজয়নগর। রাজধানীর নামে সাম্রাজ্যের নামও হয় বিজয়নগর সাম্রাজ্য।ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষদিকে দক্ষিণ ভারত যখন ইসলামি রেনেসাঁ শুরু হয়, তখনও দাপটের সাথে টিকে ছিলো বিজয়নগর। কিন্তু ১৫৬৫ সালে দাক্ষিণাত্য সুলতানির নিকট যুদ্ধে পরাজিত হলে শুরু হয় এই সাম্রাজ্যের পতন।১৬৪৬ সাল পর্যন্ত বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব ছিলো।[১]

তিতাস বিধৌত বিজয়নগর উপজেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার একটি নবসৃষ্ট উপজেলা এবং সুপ্রাচীন জনপদ।নিকারের [(National Implementation Committee for Administrative) প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি (নিকার)]১০৩ তম সভায় ৪৮২তম উপজেলা হিসাবে নবসৃষ্ট বিজয়নগর উপজেলার কার্যক্রম ৩ আগষ্ট ২০১০খ্রিঃ তারিখে শুভ উদ্বোধনের মাধ্যমে প্রথম শুরু হয়।চাঁন্দুরা,হরষপুর, চম্পকনগর এবং বেদান্তি এর বৃহত্তম ইউনিয়ন।পূর্বে এটি ত্রিপুরা জেলার একটি অংশ ছিল। ১৬১৮ খ্রিস্টাব্দে (মোঘল সম্রাট) নূরুদ্দিন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের শাসনকালে তার সেনাপতি প্রধান দাউদ খাঁ ত্রিপুরার রাজা থেকে এই অঞ্চল দখল করেছিলেন। অতপর দাউদ খাঁর নামানুসারে অত্র এলাকার নাম দাউদপুর পরগনা নামকরণ করা হয়েছিল।দীর্ঘ সংগ্রামের পরে তিনি (দাউদ খান) প্রশাসনিক অধিপতি হিসাবে এখানে বসতি স্থাপন করেন। এই পরগনাটি পরবর্তীতে জালালপুর (ময়মনসিংহ) এর সাথে সংযুক্ত হয়। ১৭৬৫ সালে ব্রিটিশরা বাংলায় দেওয়ান (রাজস্ব সংগ্রহকারী) হিসাবে আগমন করেছিল। তারা প্রশাসনিক উদ্দেশ্যে বহু জেলা তৈরি করেছিলেন। তারা ১৭৯০ সালে ত্রিপুরাকে পূনরায় জেলা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন। দাউদপুর পরগনাও ময়মনসিংহের একটি অংশ ছিল। ১৮৬০ সালে সরকার ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে মহকুমা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে। দাউদপুর, সরাইল, বেজুরা এবং হরিপুরকে ময়মনসিং থেকে পৃথক করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জমা দেওয়া হয়।[২] ১৯৮৪ সালে এরশাদ সরকার ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে মহকুমা থেকে জেলা হিসাবে উন্নীত করে।লোহর,কালাছড়া,অলিয়াজুড়ি, মধ্যগঙ্গা,বালিয়াজুড়ি, পারেঙ্গা, দেউদিনা প্রভৃতি নদী সমূহ ছাড়াও হাওড়,সমতল ভূমি এবং ছোট পাহাড় এ তিন ধরনের ভূমিররূপ এর এক অপররূপ সমন্বয়ে গড়া উপজেলাটি ইতোপূর্বে ব্রা‏হ্ম‏ণবাড়িয়া সদর উপজেলার অন্তর্ভূক্ত হলেও তিতাস নদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন ভৌগলিকভাবে একটি ব্যতিক্রমধর্মী উপজেলা বলে এখানে ভিন্নধর্মী একটি আবহ ও আমেজ রয়েছে।বৃটিশ শাসনামলে ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে এ উপজেলার সীমান্ত দিয়ে ব্র‏‏‏হ্ম‏ণবাড়িয়াসহ এত্দঅঞ্চলে স্থল যোগাযোগ সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল।তার বাস্তব প্রমাণ প্রায় ১৭০ বছরের পুরাতন সিংগারবিলের সাথে ত্রিপুরা রাজ্যের যোগাযোগের প্রধান সড়কটি। যেটি এখনো ব্যবহার উপযোগী রয়েছে। লালমাটি সমৃদ্ধ বিষ্ণুপুর ও সিংগারবিল ইউনিয়নে রয়েছে প্রাকৃতিক কাঁঠাল, লিচু ও পেয়ারাসহ ভিন্ন ধর্মী নানা বৃক্ষর অপরূপ সমাহার। মননশীল মানুষকে এর সৌন্দর্য আকর্ষণ করবেই। তা ছাড়া কালাছড়া চা বাগানে নাম না জানা, বহু অজানা শহীদদের গণ কবর ও রয়েছে। সর্বমোট ২২১.১৭বর্গ কিমি (৮৫.৩৯ বর্গমাইল)আয়তনে ১০টি ইউনিয়ন, ১৬৮টি মৌজা, এবং ২৩০ টি গ্রাম নিয়ে বিজয়নগর উপজেলা গঠিত। এটি জাতীয় সংসদের ২৪৫নং নির্বাচনী এলাকা (ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর ও বিজয়নগর) ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ এর অংশ।

★উপজেলার ঐতিহ্য ও দর্শনীয় স্থানঃ
➤”দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ রাজ কর্তৃক কর্ম-আদেশ পেয়ে বর্তমান বিজয়নগর উপজেলার অন্তর্গত সিঙ্গারবিল এলাকায় বিমান ঘাঁটি নির্মাণ করেছিল ‘পি চক্রবর্তী এন্ড কোং’ নামের একটি কোম্পানি যার সদর অফিস ছিল (বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের জন্মভিটা) সরাইল উপজেলার কালিগচ্ছ গ্রামে।” [৩]

➤ তোফায়েল মোহাম্মদ (মেজর)স্মৃতিসৌধ:
১০ নং পাহাড়পুর ইউনিয়নের অর্ন্তগত ৯নং ওয়ার্ডে লক্ষীপুর গ্রাম,সেখানে ই পি আর বাহিনীর মেজর তোফায়েল মোহাম্মদ ও জমাদার আজম শত্রু কবলিত ১৯৭১ এর সেদিনের স্বদেশভূমি পুনর্দখলের যে বীরত্ব দেখিয়েছিলেন সেই স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই তার স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। এই স্মৃতিসৌধের নামেই তোফায়েল নগর বাজারের নাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের প্রধান সড়ক টি,এ রোডটির নামকরণ করা হয়েছে।

➤শেখ হাসিনা সড়ক:
স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর তিতাস পূর্বাঞ্চলের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের সাথে (তিতাস পূর্বাচল) বিজয়নগর উপজেলার সরাসরি বিকল্প শেখ হাসিনা সড়ক।২০১০ সালের ১২ মে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ মাঠে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিমনা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কটি নির্মাণের ঘোষণা দেন।
গত ২০১৬ সালের ২৫ নভেম্বর বিজয়নগর উপজেলার পত্তন ইউনিয়নের টানমনিপুর (পত্তন শিবির) এলাকায় সড়কের মাটি ভরাট কাজের ভিত্তিপ্রস্ত স্থাপন করেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক কর্মী র.আ.ম. উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি ।স্থানীয় জনগণের দাবির মুখে স্থানীয় সংসদ সদস্য র.আ.ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী সড়কটি প্রধানমন্ত্রী ‘শেখ হাসিনা সড়ক’ নামকরণ করে এর ফলক উদ্বোধন করেন।প্রায় ৪৩ কোটি ২৭ লক্ষ পয়ত্রিশ হাজার টাকা ব্যয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স ডলি কনস্ট্রাকশন-ইনফ্রাটেক কর্তৃক যৌথভাবে কাজলা বিলের ওপর দিয়ে ২৪ ফুট প্রস্থে,(প্রায়) ৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য,রাস্তাটির কাজের সিংহভাগই সম্পন্ন হয়েছে।১১৬ কোটি টাকা ব্যায়ে বালিয়াজুড়ী নদী, লইসক্যা খাল ও তিতাসের উপর সর্বমোট তিনটি ব্রীজ নির্মানের কাজও দৃশ্যমান। [৪]

★নামকরণের পিছনের কথাঃ
লাল সবুজের বাংলাদেশে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছিল অগ্নিগর্ভ, বিস্ফোরন্মুখ
যুদ্ধের নয় মাসের ইতিহাস অদম্য সাহস, অপরিসীম ত্যাগ ও সাফল্যের বীরত্বগাথাঁয় খঁচিত অম্লান ইতিহাস। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়নগর উপজেলার রয়েছে বিরল এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান। ১৯ নভেম্বর এ উপজলার মুকুন্দপর সীমান্ত ফাঁড়ি আক্রমণ করে মুক্তিবাহিনী দখল করে নেয়।সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯ নভেম্বর পাহাড়পুর ইউনিয়নের মুকুন্দপুর এলাকাটি সর্ব প্রথম মুক্ত হয়েছিল। যা মুকুন্দপুর দিবস হিসেবে প্রতি বছর পালন করা হয়ে থাকে। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ৩১ জন বন্দী হয়। হস্তগত হয় ২৭ টি রাইফেল, ২টি স্টেনগান, ২টি এলএমজি এবং ১X৩ ইঞ্চি মর্টার।তাছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয়ের পতাকা এ ইউনিয়ন দিয়ে সর্বপ্রথম বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল।

★বিজয়নগর নামকরণঃ
২০১০ সালের আগে সমগ্র ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় বিজয়নগর বলে কোনো শব্দ ছিল না ।সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯ নভেম্বর পাহাড়পুর ইউনিয়নের মুকুন্দপুর এলাকাটি সর্ব প্রথম মুক্ত হওয়া,স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয়ের পতাকা এ ইউনিয়ন দিয়ে সর্বপ্রথম বাংলাদেশে প্রবেশ সহ বিস্ফোরন্মুখ যুদ্ধের নয় মাস এতদ অঞ্চলে মুহুর্মুহু যুদ্ধ সংগঠিত হওয়ায় পুরো মুক্তিযুদ্ধে এ এলাকার গুরুত্ব বিবেচনায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে নতুন একটি উপজেলা তৈরি করে এর নাম দেন বিজয়নগর।

★পাদটীকাঃ

➤[১] ↑ Traditions in motion: religion and society in history By Supriya Varma, Satish Saberwal, Page no. 243
➤[২] শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত (উত্তরাংশ)।।অচ্যুতচরণ চৌধুরী
➤[৩] অঞ্জলী লহ মোর মাতৃভূমি।।শিল্পপতি শান্তিব্রত চক্রবর্তী,কলকাতা।
➤[৪] বাংলাদেশের খবর।। প্রকাশিত ২৮ মে ২০১৯ ইং।
➤[৫] নামকরণের ইতিকথা।। এস এম শাহনূর
➤[৬] উপজেলা তথ্যবাতায়ন।

💻Copyright@ এস এম শাহনূর
(উইকিপিডিয়ান, কবি ও গবেষক)

🚫বিশেয সতর্ক বার্তা:
মূল লেখকের অনুমতি ছাড়া উপরোক্ত লেখার আংশিক/পুরো অংশ অন্য কোন ব্যক্তির নামে বা কোন মাধ্যমে প্রকাশ করা কপিরাইট আইনে অমার্জনীয় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।

 

Some text

ক্যাটাগরি: বিবিধ

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply

আমি প্রবাসী অ্যাপস দিয়ে ভ্যাকসিন…

লঞ্চে যৌন হয়রানি