শুক্রবার দুপুর ১২:১০, ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ. ২৯শে মার্চ, ২০২৪ ইং

দার্জিলিং শহরের নামকরণ ও ইতিহাস

৫৯৯ বার পড়া হয়েছে
মন্তব্য ০ টি

**দার্জিলিং শহরের নামকরণ ও ইতিহাস

দার্জিলিংয়ের ইতিহাসের সাথে সিকিম, নেপাল, ভূটান ও ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাস অঙ্গাঅঙ্গী ভাবে জড়িত।

নিজেরা নিজেরা মারামারি করলে তৃতীয় পক্ষ কিভাবে সুবিধা নেয় সেটার চমৎকার উদাহরণ হচ্ছে দার্জিলিং৷ এখানে যদি সিকিমকে প্রথম পক্ষ এবং নেপালকে দ্বিতীয় পক্ষ হিসেবে বিবেচনা করেন, তাহলে তৃতীয় পক্ষ হচ্ছে ব্রিটিশরা। একটু খুলেই বলা যাক।

Darjeeling নামকরণের উৎপত্তি Dorje Ling থেকে।

Dorje Ling ছিল দার্জিলিঙের স্থানীয় এক জাতির উপাসনালয় যা কি না সিকিমের রাজা (যাদেরকে চোগিয়াল বলা হত) ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে নির্মাণ করেছিলেন। Dorje মানে হচ্ছে বজ্র কিংবা বিদ্যুৎচমক এবং Ling মানে হচ্ছে স্থান। তাহলে দার্জিলিং এর অর্থ দাঁড়ায় এটি এমন এক স্থান যেখানে বজ্রসহ বিদ্যুৎ চমকায়।

সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ৭০০০ ফুট উপরে বর্ষাকালে বেশি বেশি বিদ্যুৎ চমকাবে সেটাই স্বাভাবিক। দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে উপাসনালয়টি ১৮১৫ সালে নেপালের গোর্খা বাহিনীর দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

দার্জিলিং একসময় সিকিমের অংশ ছিল।

সিকিমের সাথে নেপালের সবসময় দ্বন্দ্ব লেগেই থাকত। সিকিমের দার্জিলিং অংশ দিয়ে নেপাল এবং ভুটানের সীমান্ত আলাদা করা ছিল।

ফলে দার্জিলিং তথা সিকিম একটা বাফার রাষ্ট্র হিসাবে বেশ শান্তিতেই ছিল। কিন্তু সেই শান্তি সহ্য হল না নেপালী গোর্খাদের। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত সিকিম রাজ্য দ্বারা দার্জিলিং সংলগ্ন পাহাড়ী অঞ্চল এবং নেপাল রাজ্য দ্বারা শিলিগুড়ি সংলগ্ন তরাই সমতল অঞ্চল শাসিত হত।

১৭৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকে নেপালের গোর্খারা সমগ্র পাহাড়ী অঞ্চল অধিকারের চেষ্টা শুরু করলে সিকিমের রাজা তাঁদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। গোর্খারা যোদ্ধা জাত, তাঁদের সাথে যুদ্ধ করে সুবিধা করা এত সহজ নয়।

ক্রমাগত পরাজয়ের ফলশ্রুতিতে সিকিম সেনাবাহিনী একটা পর্যায়ে তিস্তা নদীর তীর পর্যন্ত পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে সিকিমের রাজা ব্রিটিশদের সহায়তা কামনা করেন। ভারত তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তথা ব্রিটিশ রাজের দখলে। ব্রিটিশরা দেখল নেপালিদের এই অগ্রযাত্রা রুখতে না পারলে তো বিপদ। তাই সমগ্র উত্তর সীমান্তে নেপালীদের বিজয়যাত্রা রুখতে ব্রিটিশরা তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।

১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে সংগঠিত ইঙ্গ-গোর্খা যুদ্ধের ফলে গোর্খারা পরাজিত হয়ে পরের বছর সগৌলি চুক্তি স্বাক্ষর করে।

এই চুক্তির ফলে নেপাল তার ভূমির এক তৃতীয়াংশ মালিকানা হারায় এবং সিকিম রাজ্য থেকে অধিকৃত মেচী নদী থেকে তিস্তা নদী পর্যন্ত সমস্ত অঞ্চল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে সমর্পণ করতে বাধ্য হয়।

১৮১৭ সালের তিতালিয়া চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই অঞ্চল সিকিমের রাজাকে ফেরত দানের মাধ্যমে সিকিমের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করে।

যারা ভাবছেন, আহা ব্রিটিশরা কতই না মহান তারা একটু অপেক্ষা করে বাকি কাহিনী পড়ুন।

১৮২৯ সালের ঘটনা। নেপাল এবং সিকিমের মাঝে আবারও গ্যাঞ্জাম শুরু হয় “অন্তুদারা” সীমান্ত নিয়ে। এই গ্যাঞ্জাম মিটানোর খায়েশে তৎকালীন ব্রিটিশ বড়লাট উইলিয়াম বেন্টিংক তাঁর দুজন অফিসার Captain George Alymer Lloyd এবং J. W. Grant কে পাঠালেন অন্তুদারা’তে।

দুই অফিসার পথমধ্যে যাত্রাবিরতি করেন দার্জিলিঙে।

এবং দার্জিলিং এর সৌন্দর্যে এতটাই মুগ্ধ হয়ে পড়েন যে ব্রিটিশ গভর্নরকে প্রস্তাব দিয়ে বসেন যেন এই স্থানে একটা স্বাস্থ্যনিবাস তৈরি করা হয়। ব্রিটিশ হর্তাকর্তারা নিজেদের দেশের ঠাণ্ডা পরিবেশ থেকে উত্তপ্ত ভারতে এসে হাঁসফাঁস করছিলেন। এমন সময় দার্জিলিং তাঁদের শুষ্ক জীবনে দু’ফোটা শান্তির পরশ নিয়ে হাজির হয়েছিল। ছুটিছাটায় পরিবার নিয়ে এখানে বেড়াতে আসবেন এমন দিবাস্বপ্নে বিভোর হতে তাঁদের মোটেই সময় লাগে নি।

বেন্টিংক সাহেব সানন্দে তাঁদের প্রস্তাব মঞ্জুর করলেন এবং সিকিমের রাজার কাছে দার্জিলিং লিজ নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। সেসময় দার্জিলিঙে খুব বেশি বসতি ছিল না। রাজার ছিল দয়ার শরীর তার উপর নেপালের সাথে যুদ্ধে ব্রিটিশদের সহায়তার কথাও (যদিও এই যুদ্ধ ব্রিটিশরা নিজেদের স্বার্থেই করেছিল) তিনি ভুলেন নি। ১৮৩৫ সালের ১ লা ফেব্রুয়ারি তিনি দার্জিলিংকে ব্রিটিশদের কাছে বিনামূল্যে অনির্দিষ্টকালের জন্য লিজ দিয়ে দিলেন।

ব্রিটিশরা চালাক জাতি। ১৮৪১ সাল থেকে তারা রাজাকে খুশি করার জন্য বার্ষিক ১ হাজার রুপি দেওয়া শুরু করে যার পরিমাণ ১৮৪৬ সালে ৬০০০ রুপি পর্যন্ত বাড়ানো হয়।

দার্জিলিং লিজ পাওয়ার পর থেকে ব্রিটিশরা জায়গাটির ব্যাপক উন্নয়ন ঘটায়। রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ, চার্চ, চা-বাগান, রেললাইন ইত্যাদি তৈরি হতে থাকে। ব্রিটিশরা যখন প্রথম দার্জিলিঙয়ে আসে তখন স্থানীয় লেপচা গোত্রের মাত্র ১০০ লোক এখানে থাকত।

এসব দেখে সিকিমের রাজা ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়েন। জলের দামে হীরে বিক্রি করার বিষয়টি তিনি বুঝতে পারেন। আরও একটা ব্যাপার ছিল।

দার্জিলিঙয়ে চায়ের আবাদ বাড়ার সাথে সাথেই সিকিম থেকে প্রচুর পরিমাণ শ্রমিক দার্জিলিঙয়ে পাড়ি জমায় যা কি না সিকিমের অভিজাত সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।

সিকিমের রাজার আদেশে সেইসব শ্রমিকদের জোর করে সিকিমে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টাকে ব্রিটিশরা ভালোভাবে গ্রহণ করে নি।

এভাবেই একদা মধুর সম্পর্কের আবরণে চিড় ধরে। সেই চিড় বিশাল খাদে পরিণত হয় ১৮৪৯ সালে যখন সিকিম রাজের নির্দেশে দুজন ব্রিটিশ অভিযাত্রীকে সিকিম ভ্রমণরত অবস্থায় বন্দী করা হয়।

ব্রিটিশরা ঠিক এমন একটা মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাঁদেরকে মুক্ত করার জন্য সেনাবাহিনী পাঠায় এবং ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোম্পানি ৬৪০ বর্গমাইল (১,৭০০ বর্গকিলোমিটার) এলাকা অধিকার করে নেয়।

ব্যস, দার্জিলিং চিরতরে সিকিমের হাতছাড়া হয়ে গেল।
ব্রিটিশরা এখানেই থেমে থাকে নি। ১৮৬৪ সালে তারা কালিম্পং (যা কি না ছিল ভুটানের অংশ) দখল করে নেয়।

কালিম্পং এর অবস্থানগত গুরুত্ব অপরিসীম। এটি দখল করার মাধ্যমে পাহাড়ের গিরিপথগুলোর উপর নজর রাখা সুবিধা হয়। দার্জিলিং হারিয়ে সিকিমের রাজার মাথা পাগল হওয়ার দশা। আবারও সিকিমিজ এবং ব্রিটিশ বাহিনীর মাঝে ১৮৬৫ সালে ছোটখাটো যুদ্ধ হয়। ফলশ্রুতিতে তিস্তা নদীর পূর্ব তীরের অঞ্চলগুলি ব্রিটিশদের হস্তগত হয়।

১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কালিম্পংসহ ১,২৩৪ বর্গমাইল (৩,২০০ বর্গকিলোমিটার) ক্ষেত্রফল এলাকা নিয়ে দার্জিলিং জেলা গঠিত হয়, যা বর্তমানে একই আকারের রয়ে গেছে। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতের স্বাধীনতার পর দার্জিলিং, কার্শিয়াং, কালিম্পং ও তরাই অঞ্চলের কিয়দংশ নিয়ে নির্মিত দার্জিলিং জেলাকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।

 

Some text

ক্যাটাগরি: বিবিধ

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply

আমি প্রবাসী অ্যাপস দিয়ে ভ্যাকসিন…

লঞ্চে যৌন হয়রানি