রবিবার দুপুর ১২:৩৫, ১২ই চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ. ২৬শে মার্চ, ২০২৩ ইং

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও আধুনিক অগ্রযাত্রার অনন্য মালয়েশিয়া

৬৩৭ বার পড়া হয়েছে
মন্তব্য ০ টি

দক্ষিণ চীন সাগরের তীরে অবস্থিত মালয়েশিয়া; প্রকৃতির অপরূপ বৈচিত্র্য, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, অভিবাসীদের কর্মসংস্থান ও আধুনিকতার মিশেলে গোটা দেশটি বিশ্বের মধ্যে অনন্য। দ্বীপরাজ্য মালয়েশিয়াতে ভ্রমনের জন্য ১৯৯৩ সালে এপ্রিলের শেষের দিকে গিয়ে ছিলাম। অবস্থান করেছিলাম প্রায় এক বৎসর। এখানকার বিভিন্ন প্রদেশে অবস্থিত অসম্ভব সুন্দর ট্যুরিষ্ট স্পট গুলো ঘুড়ে ঘুড়ে দেখে বিমুগদ্ধ হয়েছি এবং পাশাপাশি খন্ডকালীন চাকুরীও করেছি। সেই সুবাদে আধুনিক মালয়েশিয়ার আর্থ- সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছি। আর অবহিত হয়েছি এখানকার ইতিহাস- ঐতিহ্য সম্পর্কে।  বর্তমান মালয়েশিয়া হল পূর্বতন মালয়উপদ্বীপ। এই অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসার শুরু হয় পঞ্চদশ শতকের গোড়ার দিকে। সুদূর পর্তুগাল হতে পুর্তগীজরা এসে ১৫১১ সাল এ অঞ্চলের শাসন ক্ষমতা দখল করেন। তারপর ক্ষমতা দখল করেন নেদারল্যান্ডের ওলন্দাজরা এবং পরে ব্রিটেনের ইংরেজরা, এভাবে দীর্ঘ দিন যাবৎ এই অঞ্চলে উপনিবেশীক শাসন চলতে থাকে। জাতির এই সংকট কালে টুংকু আব্দুর রহমানের আপোষহীন ব্যাপকগন আন্দোলনের বধৌলতে অবশেষে ১৯৫৭ সালে বৃটিশরা পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে মালয়েশিয়া ত্যাগ করে। ১৯৫৩ সালে মালয়, সাবা, সরায়াক ও সিঙ্গাঁপুর নিয়ে গঠিত হয় মালয়া ইউনাইটেড। সেখানে থেকেই দেশটির নামকরন করা হয় মালয়েশিয়া। কিন্তু মাত্র দুই বছর পরই সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়া থেকে বহিস্কার হয়ে আলাদা হয়। স্বাধীন মালয়েশিয়া তার নিজস্ব স্বকীয়তা নিয়ে যাত্রা শুরু করে।

বর্তমানে ফেডারেল মালয়েশিয়া পূর্ব ও দক্ষিণ অঞ্চলের বেশ কতকগুলো দ্বীপ রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত। পূর্বাঞ্চলে রয়েছে সাবা ও সারায়াক আর দক্ষিণাঞ্চলে রয়েছে জহরবারু, মালাক্কা, নিগরীসিম্ভীনাল, কুয়ালালামপুর, সেলাঙ্গার, পেরা, পাহাঙ্গঁ, পারলিস, আলোরসেতার, ক্লানতান, তেরেঙ্গানো ও পেনাং। ফেডারেল মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক ব্যবস্থা একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের কাঠামোতে পরিচালিত হয় । রাজা হলেন রাষ্ট্রের প্রধান আর প্রধানমন্ত্রী হলেন সরকার প্রধান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দুই কক্ষ বিশিষ্ট আইন সভা এখানে বিদ্যমান। এখানকার বিচার, নির্বাহী ও আইন প্রনয়ন বিভাগ সম্পূর্ণরুপে পৃথক ও স্বাধীন।

আমাদের দেশের মতো বিচার বিভাগ ও আইন প্রনয়ন বিভাগের স্বাধীনতার উপর নির্বাহী বিভাগ কখনো প্রভাব বিস্তার করে না। ফেডারেল মালয়েশিয়ার ভৌগলীক সিমানা ও চৌহদ্দি খুবই চমৎকার। পূর্ব- উত্তরে ব্রুনাই, পূর্বে- দক্ষিনে ইন্দোনেশিয়া, পশ্চিমে-দক্ষিনে ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাঁপুর; পশ্চিম-উত্তরে থাইল্যান্ড। বর্তমানে মালয়েশিয়ার মোট আয়তন ১ লক্ষ ২৭ হাজার ৩৫৩ বর্গমাইল। আশির দশকে দেশটির হাল ধরেন আধুনিক মালয়েশিয়ার স্বপ্নদ্রষ্ট্রা ড. মাহাথির মোহাম্মদ ও তার ডেপুটি আনোয়ার ইব্রাহিম।

মালয়েশিয়ার বর্তমান জনসংখ্যা ২০০৭ সালের হিসাব অনুযায়ী আনুমানিক ২ কোটি ৭১ লক্ষ ৪০ হাজার। এর মধ্যে মালয়ের আদি অধিবাসী মালয়ী ৫১%, চায়না ২২.৫%, ভারতীয় ২০.৬%, এবং অন্যান্য গোষ্ঠি ৬.৭%। ২০০৬ সালের হিসাব অনুযায়ী এখানকার মাথাপিছু আয়- ১২ হাজার ৭০০ শত মার্কিন ডলার। মালয়েশিয়ার বেশির ভাগ বড় বড় শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক চায়নারা। মালয়িরা নিয়ন্ত্রন করে পুরো প্রশাসনিক কার্যক্রম। আর ভারতীয়দের হাতে পুরো শিক্ষাব্যবস্থার কর্তৃত্ব। নানান ধর্ম- জাতির ও গোত্রের সমন্বয়ে গঠিত দেশটি শুরুতে ছিল অত্যন্ত অনুন্নত ও পাশ্চাৎপদ। কিন্তু মাহাথির মোহাম্মদের ক্ষমতা গ্রহনের পর থেকেই ধীরে ধীরে মালয়েশিয়া হয়ে উঠে বিশ্বের রোল মডেল। মালয়েশিয়া ও এর আসপাশের দেশগুলো রাষ্ট্রীয় ভাষা মালয় ভাষা। এই ভাষা অতিসহজ-সরল ও শ্রুতিমধুর। আমি প্রায় দুই মাসের মধ্যেই মালয় ভাষা মোটামুটি আয়ত্ত করে ফেলি। মালয় ভাষার কয়েকটি শব্দ এখানে উল্লেখ করা হল। যেমন, এখানে – ছিনি, ঐখানে – ছানা, কাছে – ডেক্কাত, দূরে – ঝাউ, উপরে – আতাস, নিচে – বাওয়া, বন্ধ – তোতোভ, খোলা – বোকা ইত্যাদি। এই ভাষা অতি প্রাচীন হওয়ার পরও এর কোনো অক্ষর আজ অবধি আবিস্কৃত হয় নি। এই ভাষাভাষীর লোকেরা আরবী অথবা ইংরেজী অক্ষরের মাধ্যমে তাদের ভাষা লিখিত ভাবে প্রকাশ করে। এখানকার অর্ধেক সংখ্যকলোক মালয় ভাষায় কথা বলে। এই ভাষা বহুজাতিক বাজারের ভাষা হিসেবে প্রচলিত। মালয়েশিয়াতে প্রায় ১৩০টি ভাষার প্রচলন রয়েছে। এদের মধ্যে চীনা ভাষা, তামিল ভাষা, ডায়াক ভাষা ও জাভীয় ভাষা উল্লেখযোগ্য।

এই দেশের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাই উন্নত বিশ্বের শিক্ষা পাঠ্যক্রমের সমস্ত নিয়মকানুন অনুযায়ী পরিচালিত হয়। এখানে ছাত্র রাজনীতি সম্পুর্ণরুপে নিষেধ । তাই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে কখনো উচ্চকন্ঠের মুখোমুখি হতে হয় না। প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে প্রায়ই মুক্ত এই মাধুর্যস্নাত দেশটিতে ঋতু বলতে মোটামুটি দুটি প্রত্যক্ষ করা যায়। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত গ্রীষ্ম আর বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বর্ষণসিক্ত এবং কমনীয় রূপময় নৈসর্গিকি ঐশ্বর্যের পরিপূর্ণ আধার । প্রায়ই বিকাল বেলায় চমকানো বজ্রপাতসহ মুষলধারের বৃষ্টি পুরো পরিবেশনকে শীতল এবং আমারদায়ক করে তোলে।

মালয়েশিয়ান সরকার খাদ্য-দ্রব্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের গুনগতমান এবং মূল্য কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রন করেন। প্রতিদিন প্রতিটি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য রেডিও- টেলিভিশন ও পত্রিকার মাধ্যমে প্রকাশ ও প্রচার করা হয়। যদি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এর ব্যতিক্রম করেন তা হলে উক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হয়। নানা ধর্ম-বর্ণ ও গোষ্ঠির মানুষের অবস্থানের জন্যে এখানকার খাবারও বেশ বৈচিত্রময়। মালয়, চাইনীয় এবং ভারতীয়- নানা ধরনের খাবার বিভিন্ন রেস্তোরায় পাওয়া যায়। এছাড়াও রয়েছে মধ্যপ্রাচ্য ও থাইল্যান্ডের খাবার। এখানকার মহিলারা বিকাল দিকে তাদের বাড়ীর সামনে বিভিন্ন ধরনের পিঠা তৈরী করে বিক্রি করে। পিঠাকে মালয় ভাষায় কুই বলা হয়। আর চাকুরীজীবি পুরুষেরা অতিরিক্ত অয় করার জন্যে অবসর সময় নিউজ পেপার ও ষ্টেশনারী সামগ্রী বাস্তায় ফেরী করে বিক্রি করে।

মালয়েশিয়ার গ্রাম অঞ্চলের বাড়ীগুলো সম্পুর্ণরূপে কাঠের তৈরী আর শহরের পাকা বাড়ীগুলো দু’তলা থেকে ছয় তলা পর্যন্ত হয়। মালয় ভাষায় গ্রামকে কাস্পুঙ্গ ও শরহরকে বান্দর মবলা হয়। এলাকা ভিত্তিক বাড়ীগুলোর উচ্চতা ও ডিজাইন সব একই ধরনের হয়। এখানে ২/৩ টি মহল্লার পর পর রয়েছে স্থায়ী প্রভাত কালীন কাচাঁ বাজার থাকে, মালয় ভাষায় প্রভাত কালীন বাজারকে পাছার পাগী বলা হয়। আর রয়েছে মহল্লা ভিত্তিক অস্থায়ী বৈকালীক সপ্তাহিক কাঁচা বাজার, যাকে মালয় ভাষায় পাছার মালম বলা হয়। বাজার গুলোতে গৃহস্থালীর সামগ্রী সুলভ মূল্যে পাওয়া যায়।

মালয়েশিয়ার পরিবহন ও ট্রাফিক ব্যবস্থা খুবই উন্নত ও আধুনিক। শহরের অভ্যন্তরীন বাসগুলো ৬০/৭০ মাইল গতিতে চলে আর মহাসড়কের বাসগুলো চলে ১০০/১৫০ মাইল গতিতে। মহাসড়কের মোড়ে ও শহরের বাসষ্ট্যান্ড গুলোতে সিসি ক্যামেরা লাগানো থাকে। মহাসড়ক গুলো চার লেন বিশিষ্টি। এখানে লাইসেন্স ও ফিটনেস বিহীন গাড়ী কেউ চালাতে পারেনা । এই দেশে মন্ত্রী, আমলা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জন্যে আলাদা কোনো রাস্তা-ঘাট ও নিয়ম-নীতি নেই। এখানে ভি.আই.পি. ধরনের কোনো রাস্তার অস্তিত্ব নেই। সাধারন জনগনের মতো তাদেরকেও একই নিয়ম মেনে সবধরনের পরিবহন ব্যবস্থায় চলাচল কতে হয়।  তবে স্কুল-বাস গুলি যে কোনো বাসকে ওভারটেক করে যেতে পারে।  এখানকার আমলা-মন্ত্রীরা ব্যক্তিগত কাজে সরকারী গড়ী ব্যবহার করতে পারে না। এক বার আমি  বিশেষ প্রয়োজনে কুয়ালালামপুর থেকে পেনাঙ্গেঁর উদ্দেশ্যে নৈশকালীন বাসে চড়ে যাচ্ছিলাম, তখন আমার পিছনের আসনের যাত্রী ছিলেন তৎকালীন উপ-প্রধানমন্ত্রী আরোয়ার ইব্রাহিম।

মালয়েশিয়ায় নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। সবাই সবাইকে সম্মান করে। কাজকে সবাই পছন্দ করেন। আমাদের দেশের মতো এখানে নারী ধর্ষন, এ্যাসিড নিক্ষেপ, হত্যা, আত্মহত্যা ও নারী নির্যাতনের মতো কোনো জগন্য ঘটনা সচরাচর দেখা যায় না। সরকারী, বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ড্রাইভিং সিটে, শপিংমলে, হোটেল রেস্টুরেন্ট থেকে শুরু করে সর্বত্রই নারীদের অবাধ বিচরন।

সমগ্র মালয়েশিয়ায় “নোওয়ার্ক নো পেমেন্ট” পদ্ধতিতে শিল্প ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান চলে। এখানে সাপ্তাহিক ছুটির দিনও শ্রমিকদেরকে কোনো বেতন দেওয়া হয় না। ট্রেডইউনিয়ন, হরতাল, অবরোধ ইত্যাদি অলিখিত ভাবে নিষিদ্ধ। এখানে শ্রমিক-মালিকের সম্পর্ক বন্ধুত্বপুর্ণ। কেউ কারো প্রতি কোনো হিংসা- বিদ্বেষ পোষন করে না। শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের বেতনের মধ্যে তেমন আহমরি ব্যবধান নেই। এক কথায় শ্রমিক- মালিক ও কর্মকর্তারা একই মানের জীবন নির্বাহ করে। তাই এখানে আমাদের দেশের মতো মালিক- শ্রমিকদের মধ্যে কখনো কোনো কলহ সৃষ্টি হয় না। মালয়েশিয়ার রাজনীতিবিদরা আমায়িক ও সদাচারী। তারা বিরোধী মত, দল ও আইনের প্রতি বেশ শ্রদ্ধাশীল। নিজেদের দোষ তারা অকপটে স্বীকার করেন। যদি কোনো মন্ত্রী বা আমলা দুর্নীতি বা গর্হিতকর কাজের জন্য আদালত কর্তৃক সাজা প্রাপ্ত হন তাহলে সেই ব্যক্তি সঙ্গে সঙ্গে পদত্যাগ করেন। উল্লেখ্য যে, ১৯৯৮ সালে তৎকালীন ক্যারিশম্যাটিক নেতা উপ-প্রধান মন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হলে মালয়েশিয়ার প্রবাদ পুরুষ প্রধানমন্ত্রী মাহাথীর মোহাম্মদ তাকে দলের ও রাষ্ট্রের যাবতীয় কাজ থেকে বরখাস্ত করেন। এই নিয়ে জনগণ বা রাজনৈতিক দলগুলো কোন টু শব্দটি পর্যন্ত করেনি ! সবচেয়ে মজার ও লক্ষনীয় বিষয় হল – বর্তমানে উক্ত দুই রাজনীতিবিদ রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষমাতাশীন “নাজিব রাজাক সরকারের” ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে যৌথ ভাবে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করে যাচ্ছেন ! এখানে উল্লেখ্য যে, এই যৌথ-আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে ২০১৮ সালের জানুয়ারী মাসে অনুষ্ঠিত মালয়েশিয়ার সাধারন নির্বাচনে মহাথির মোহাম্মদের নেতৃত্বাধীন রাজনেতিক জোট “পাকাতান হারাপন” পার্লামেন্টে১১৩টি আসনে জয়ী হয়েছে। পার্লমেন্টের মোট আসন ২২২টি। অন্য দিকে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের রাজনৈতিক জোট “বারিসান ন্যাশনাল” জিতেছে৭৯টি আসনে। মহাথির মোহাম্মদ নিজেও এক সময়  বারিসান ন্যাশনাল  জোটের অংশ ছিলেন। তবে ১৫ বছর পর জনগণের বৃহৎ স্বার্থে পুনরায় রাজনীতিতে ফিরে আসেন এবং রাজনৈতিক মঞ্চে ফিরেই নিজের দল ও এক সময়ের শিষ্য নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে দাড়াঁন তিনি।এই নির্বাচনে অসাধারন বিজয়ের পর মালয়েশিয়ার সপ্তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি শপথ নিয়েছেন। তার বয়স এখন প্রায় ৯৩। সম্ভবত তিনিই বিশ্বের সবচেয়ে প্রবীন রাষ্ট্রনায়ক। এর আগে প্রায় একটানা ২২ বছর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে  তার মতোএমন দেশপ্রেমীক,সৎ ও র্নিভিক রাজনীতিবিদ একান্ত দরকার।

মালয়েশিয়ার প্রচার মাধ্যম গুলো স্বাধীন ও নিরপেক্ষ। এখানকার রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের সংখ্যা আমাদের দেশের তুলনা অতি নগন্য। প্রচার মাধ্যম গুলো সরকারের ইতি ও নেতিবাচক দু’টো দিকই সমভাবে প্রচার করে। উতুসান মালয়েশিয়া, দ্য স্টার ও দ্য মালয় মেইল এখানকার প্রথম সারির পত্রিকা। আমি নিয়মিতভাবে দ্য মালয় মেইল পত্রিকাটি পড়তাম। এই পত্রিকাটিতে সব সময় সার্কভুক্ত দেশ গুলোর খবরা-খবর নিয়মিত প্রকাশিত হতো। এখানকার কিংবদন্তি চলচ্চিত্র অভিনেতা হলেন মোহাম্মদ পির ইয়ামলী; আমি তার অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছি। তাকে আমাদের দেশের চলচ্চিত্র অভিনেতা আব্দুল রাজ্জাকের সাথে তুলনা করা যেতে পারে।

মালয়েশিয়াতে এখন সাধারনত বহিরাগতদের নাগরিকত্ব দেওয়া হয় না। এখানে কেউ জন্মগ্রহন করলে অথবা কেউ কোনো মালয় নাগরিককে বিয়ে করলে এই দেশের নাগরিকত্ব পাওয়া যা। সরকারের এই উদার নৈতিক আইনের সুযোগে প্রবাসী বাংলাদেশীর একটি অংশ মালয় মেয়েকে বিয়ে করে নিবির্ঘ্নে ব্যবসা-বনিজ্য করে যাচ্ছেন। আবার অনেক বাংলাদেশী সেলুন, মুদি দোকান, কারওয়াশ, ফটোকপির দোকান, টেইলারিং শপ, ফলের দোকান ইত্যাদি ব্যবসা করছেন। উদাহরণ স্বরূপ আনোয়ার হোসেন নামে আমার এক বন্ধুর কথা বলা যেতে পারে; সে এক মালয় মহিলাকে বিয়ে করে মুদি দোকানের ব্যবসা করে যাচ্ছেন প্রায় ২৫ বছর যাবৎ। সেকেন্ড হোম হিসেবে কয়েক হাজার অ্যাপর্টমেন্টও ফ্ল্যাট কিনে রেখেছেন বাংলাদেশী চিহ্নিত বিত্তশালীরা। তারা প্রতিনিয়ত বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা এনে মালয়েশিয়াতে হাউজিং ব্যবসা, গাড়ি বেচা- কেনার ব্যবসা, আইটি ব্যবসা, প্রিন্টিং ব্যবসা, কনস্ট্রাকশন ব্যবসা, আবাসিক হোটেল, কফিশপ ইত্যাদি ব্যবসা নিরাপদে করে যাচ্ছে। ২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী বৈধ অবৈধ মিলে আনুমানিক প্রায ১০ লাখ বাংলাদেশী শ্রমিক কাজ করছেন মালয়েশিয়ায়। এর মধ্যে এখানকার বিভিন্ন জেলে আটন আছে প্রায় ১০ হাজার বাংলাদেশী। এছাড়া ছাত্র- ব্যবসায়ী মিলে আরও প্রায় ১লাখ বাংলাদেশী বাস করছেন এই দেশে। এর মধ্যে অর্ধেকই অবৈধ। তবে তাদের বৈধ হওয়ার সুযোগ দিয়েছে মালয়েশিয়া সরকার।

হিন্দু-বৌদ্ধ ও ইসলাম এই তিন ধর্ম অনুশারীদের চমৎকার আবাসস্থল হলো মালয়েশিয়া। এরা পরষ্পরের প্রতি সহানুভুতিশীল ও সহাবস্থানে বিশ্বাসী। এখানে ধর্মীয় চর্চাও ধর্মপন্থী রাজনৈতিক তৎপড়তা সম্পর্ণরূপে উন্মুক্ত। তবে এখানে নাস্তিকতার চর্চা ও নাস্তিকপন্থী রাজনৈতিক তৎপড়তা সম্পূর্ণরূপে নিষেধ। মালয়েশিয়াতে বর্তমানে মুসলিম ৬১.৩% বৌদ্ধ ১৯.৮% হিন্দু ৯.২% ও অন্যান্য দর্শ ৯.৬%। এখানে মুলত হিন্দু ,বৌদ্ধ ও ইসলাম এই তিন ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান বেশী পরিলক্ষীত হয়।

মালয়েশিয়ার হিন্দুরা আমাদের দেশের মতো শারদীয় দুর্গা উৎসব পালন করেনা। তারা দেবতা সুব্রমনিয়ানকে স্মরন করে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারী মাসে থাইপুসম উৎসব পালন করে । উৎসবের দিন হাজার হাজার স্থানীয় হিন্দুরা একটি ধর্মীয় মিছিলে শামিল হয়ে যাত্রা করেন দেবতা সুব্রমনিয়ানের মন্দিরের দিকে; বেশীর ভাগ ভক্তদের কাধে দুধ ভর্তি কলশি থাকে, কারো হাতে থাকে শিবের ত্রিশুল, কারো হাতে থাকে কার্তিকের ধনুক এবং কারো কারো শরীরে বিভিন্ন অংশে ছোট বড় ইস্পাতের শলাকা এ ফোঁড় ও ফোঁড় হয়ে বিধে থাকে। কথিত আছে এই দিনেই দেবতা সুব্রমনিয়ান রাক্ষস-সর্দার তারকা সুরকে হত্যা করে ছিলেন। মালয়েশিয়ার এই থাইপুসম উৎসব দেখতে সারা বিশ্ব থেকে প্রচুর পর্যটক আসেন।

মালয়েশিয়ার চায়নিজরা হলো বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী । আমাদের দেশের মতো এখানে বৌদ্ধ পূর্ণিমা বা মাখী পুর্ণিমা পালন করা হয়না। তবে চায়নিজদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় ও সামাজিক উৎব হলো “চায়নিজ নিউ ইয়ার”। চীনাদের নিজস্ব বর্ষপঞ্জিকা অনুসারে, বসন্তের মাঝামাঝিতে তাদের নতুন বছর শুরু হয়। চীনারা চন্দ্রবর্ষ অনুসারন করে থাকে। কবে থেকে নতুন বছর শুরু তা নিদির্ষ্ট নয়। একেক বছর একেক দিনে আবার পরপর কয়েক বছর একই দিনেও হতে পারে। নতুন বছরকে তারা একটি প্রাণীর নামে নাম করন করে থাকে। ষাড়, বাঘ, খরঘোশ, ড্রাগনসহ নির্দিষ্ট ১২টি প্রাণীর নাম ঘুরেফিরে রাখা হয় একেক বছর। নববর্ষের প্রথম দিনে ধর্মীয় আচার দিয়ে শুরু হওয়া এ উৎসব গড়ায় ১৫দিন পর্যন্ত। ঘরবাড়ী সাজানো, শিশুদের উপহার দেওয়া, খাবার তৈরী, মুখোশ পরা, পটকা ও আতশবাজি ফোটানো হয় উৎসব চলা কালে।

মালয়েশিয়ার সিংহভাগ মুসলিমই ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইদ্রীস শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী আর অতি সামান্য মুসলিম ইমাম আবু হানিফা নোমান ইবনে ছাবেত কুফীর দলভুক্ত। অবাক হওয়ার বিষয় এখানে আমাদের দেশের মতো শিয়া-সুন্নী, হানাফী-শাফেয়ী, রিজভী-ওয়াহ্হাবী ইত্যাদি ধর্মীয় দলা গুলোর মতো কোনো ধরনের দাঙ্গাঁ হয় না। এখানে মুসলিম অধ্যুষিত এলায় প্রতি মহল্লায় একটি করে পাঞ্জেঘানা মসজিদ আছে আর ১৪/১৫ টি মহল্লার জন্যে রয়েছে একটি করে জামে মসজিদ। জামে মসজিদের ইমাম, মোয়াজ্জিম ও খাদেম সাহেব গণ সরাসরি সরকার কর্তৃক নিয়োগকৃত। শুধু মাত্র জামে মসজিদ গুলোতেই জুম্মা ও ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। দেশের সমগ্র অঞ্চলের জামে মসজিদ গুলোতে অভিন্ন খুৎবা প্রদান করা হয়। নারী-পুরুষ উভয়ই মসজিদে নামাজ আদায় করেন। এখানকার মসজিদ গুলোতে মাঝে মধ্যে মাগরিবের পর থেকে এশারের পূর্ব পর্যন্ত ধর্মীয় আলোচনা হয়। আমাদের দেশের মতো এখানে মাঠে-ময়দানে ও রাস্তা-ঘাটে ওয়াজ মাহফিল কখনো হয় না। রমযান মাসে প্রতিটি মুসলিমকে রমযানের পবিত্রতা অটুট রাখতে হয়। যাকাত ও ফিতরার টাকা সরাসরি সরকারী তহবীলে জমা দিতে হয়।

মালয় ভাষায় পবিত্র ঈদ উৎসবকে হারিরাইয়া বলা হয়। আমাদের দেশের মতো এখানে দুই ঈদ উৎসবে সর্বসাধারণের মাঝে ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দিপনা দেখা যায় না। এখানকার পুরুষরা ঈদের দিন শার্ট- প্যান্ট ও কালো টুপি পরে থাকেন। নারীরা বাজুকুরুং ও বাজু কেবায়া নামের গলা থেকে পা পর্যন্ত এক ধরনের স্কার্ট পরেন । ঈদের দিনের বিশেষ খাবার হিসেবে তারা রান্না করেন কেতুপাত্ব, দোদোল, লেমা, নাসিলোমা, আয়াম গৌরিং, নামের ঐতিহ্যবাহী খাবার। ঈদের নামাজ শেষে স্বজনদের কবর জিয়ারত করার রীতি আছে তাদের মধ্যে। দিনের বাকী সময় পরিবার, আত্মীয়, বন্ধু বান্দবের সঙ্গেঁ কাটান। একবার ঈদুল আযহার দিন ফরিদা বিনতে বকতিয়ার ও আসাদুল্লাহ গালীভ নামে দুইজন মালয়ী বন্ধুর বাসায় বেড়াতে গিয়ে ছিলাম। তাদের আদর-আপ্যায়নে আমি এতটাই বিমুগ্ধ হয়েছি যে, তা আজও ভুলতে পারিনা। কোরবানী ঈদের দিন অন্যধর্মাম্বীদের সুবিধার্থে ও পরিবেশগত কারনে সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত স্থানে এখানকার লোকেরা পশুকোরবানী দিয়ে থাকেন। মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মাধ্যবিত্তরা সচরাচর পশু কোরবানী দেননা। মাসজিদের ইমাম সাহেবদের দ্বারাই পশু জবাই ও পশুর মাংস বিলি- বন্টনের কাজ সম্পন্ন করা হয়। অবস্থাপন্ন ব্যক্তিরা কোরবানীর এই মাংস গ্রহন করেন না।

মালয়েশিয়াতে মুসলিমদের জন্য হারাম খাবার ক্রয়-বিক্রয় সম্পূর্ণরূপে নিষেধ । তবে অমুসলিমদের জন্য তা সম্পুর্ণ বৈধ। এখানে কেউ কারো ধর্ম বা সম্প্রদায় নিয়ে কোনো ধরনের কটাক্ষ করেন না বা ধর্মীয় আচার পালনের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেন না। বরং এ ধরনের শুদ্ধ চেতনা তারা নিজেদের মধ্যে আত্বস্থ করে নিয়েছে। কেউ নিজের কোন কিছু বিসর্জন না দিয়ে নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি এটুটু রেখে ভারতীয়,চীনা ও মালয়রা তাদের কর্মযোগকে নিরন্তর এগিয়ে দেশটিকে অগ্রযাত্রার শীর্ষে নিয়ে যাচ্ছে।

মালয়েশিয়ার অর্থনীতি মূলত মুক্তবাজার অর্থনীতি। “একতাই বল” এই নীতি আদর্শে অনুপ্রানিত হয়ে সমগ্র মালয়েশিয়ার জনগণ সম্মিলিত ভাবে দেশকে সত্যিকারের গনতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও টেকসই উন্নয়নের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। মালয়েশিয়া আজ উঠতি শিল্প উন্নত দেশ। এই নীতি-বাক্যে উদ্ধুদ্দ হয়ে আমাদের সরকার, বিরোধীদল ও আপামর জনগনকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বৈষম্যহীন এবং শোষন মুক্ত সমাজ বিনির্মানে অগ্রসর হতে হবে; তা হলেই আমরা সত্যিকারের স্বাধীন , গনতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠন করতে পারবো।

খায়রুল আকরাম খান : ব্যুরো চীফ, দেশ দর্শন

Some text

ক্যাটাগরি: ভ্রমণ কাহিনি, সাহিত্য

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply

Flirt4free Review: Security, Prices, Models

The Best Chat Room Apps…

Videochat de sexo

Take part in the Finest…

The Fantasy About Ukraine Girls…

The Hidden Treasure Of Costa…

Se corre en su cara

On the web Pokies Modern…

5 Simple Techniques For Portuguese…

The Idiot’s Guide To Sexy…