![](http://www.old.deshdorshon.com/wp-content/uploads/2019/03/D-750x420.jpg)
বিবাহের আধ্যাত্মিক তাৎপর্য ঈশ্বর সদৃশ হওয়া। ঈশ্বর নারীও না- পুরুষও না। তিনি নারীও পুরুষও। অর্ধেক নারী, অর্ধেক পুরুষ নিয়ে তিনি এক। একা-একা প্রেম করা যায় না। তাই তিনি সর্জন করলেন মানুষ। প্রেমের সঙ্গী। আলাদা আলাদাভাবে নারী ও পুরুষ তার বিভাজিত অংশ। ঈশ্বর সদৃশ হওয়ার জন্য দ্বৈত সত্তার একত্ব চাই। বিবাহ সেই সুযোগটি তৈরী করে দেয়।
প্রেম দেওয়ার জন্য পাত্র চাই। বিষয় এবং বিষয়ী ছাড়া প্রেম নাই। ‘মানবজাতি’ বিষয় নয়- একটি বিমূর্ত ধারণা। তাই ‘মানবজাতি’র সঙ্গে প্রেম করা যায় না। ঈশ্বরও একটি বিমূর্ত ধারণা। ঈশ্বরের মূর্তির সঙ্গে প্রেম করা যেতে পারে। কিন্তু মূর্তি তো সাড়া দেয় না। মূর্তি থেকে সাড়া পাওয়ার যে গল্পগুলো প্রচলিত আছে, তা সিজোফ্রেনিয়া রোগীর অলীক প্রত্যক্ষণ। গাছের সঙ্গে প্রেম করা যেতে পারে। কিন্তু এটি খুব সহজ। বৃক্ষপ্রেমিককে ‘উত্তম মালী’ বলা যেতে পারে- সাধক নয়। জীব-জন্তুর সঙ্গেও প্রেম করা যেতে পারে। এটি একটু কঠিন হলেও নিম্নমানের। কারণ বৃক্ষের চলন কেন্দ্র নাই। বৃক্ষ বলে না, চলে না, অভিমান করে না, তিরস্কার করে না, ক্রোধান্বিত হয় না।
মানবজাতি ও ঈশ্বরের মতো ‘নারী’ও একটি বিমূর্ত ধারণা। মূর্ত হলো একজন নারী- যার প্রতিটি ইঞ্চি দেখা যায়, অনুভব করা যায়। তাকে ভালোবেসে ও শ্রদ্ধা করেই শিখতে হয় জগতের সব নারীকে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা করার শিল্পকলা। নারী-পুরুষের পাস্পরিক আকর্ষণের আধ্যাত্মিক তাৎপর্য এটিই হতে পারে যে, নারীকে ভালোবাসার মাধ্যমে পুরুষ, এবং পুরুষকে ভালোবাসার মাধ্যমে নারী মহাকালের টান অনুভব করে। পুরুষ স্বর্গের প্রতীক- নারী মর্ত্যের। স্বর্গ-মর্ত্য এক না হলে প্রেমের বাঁশি বাজে না।
বিবাহ একজনকে ভালোবাসার মাধ্যমে জগৎকে ভালোবাসার সুযোগ করে দেয়। বিবাহ করা মানেই হলো সংকল্প করা যে, আমরা আমাদের প্রেমের প্রমাণ দিবো। যে দম্পতি জগতের সম্মুখে প্রেমের প্রমাণ উপস্থিত করতে পারে, কেবল তাদের কাছেই বিবাহের আধ্যাত্মিক তাৎপর্য মূর্ত হয়ে উঠে। বিবাহের মাধ্যমে সে জগতের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত হয়। বিবাহ শুধু একজন মানুষের সঙ্গে আরেকজন মানুষের যোগ না- একজনের সঙ্গে জগতের যোগ। স্বামীর কাছে স্ত্রী কখনো ছোট বোন, কখনো বড় বোন, কখনো প্রেমিকা, কখনো বা মাতা। স্ত্রীর কাছে স্বামী কখনো ছোট ভাই, কখনো বড় ভাই, কখনো প্রেমিক, কখনো বা বাবা। একজনের মধ্যে সবাইকে আবিষ্কারের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর প্রেম সম্পূর্ণতা লাভ করে। যে পুরুষ একজন নারীকে ভালোবাসতে পারে না, সে মানুষকে এবং ঈশ্বরকে ভালোবাসার কথা চিন্তাও করতে পারে না। তাই বিবাহ মানবজীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। এটিকে ক্ষুদ্র করে দেখার কোনো সুযোগ নেই।
বিয়ে করার পর কোনো পুরুষেরই এমনটি ভাবা উচিত না যে, সে এমন একজনকে ঘরে এনেছে, যে সর্বদা তার সেবায় নিয়োজিত থাকবে। বরং, এটি ভাবা উচিত যে, সে এমন একজনকে ঘরে এনেছে, যার সেবা করবে। সারাজীবন, একনিষ্ঠভাবে। স্ত্রীরও এমনটি ভাবা উচিত। বৈবাহিক জীবনের সব সমস্যার সমাধান রয়েছে এই নির্ণয়ে। কাকে বিয়ে করা উচিত, আর কাকে বিবাহ করা উচিত নয়, তা বিবাহের আগে ভাবা যেতে পারে- বিবাহের পর না। বিয়ের পর সে যেমনই হোক, যত খারাপই হোক, ভালোবাসা দিয়ে তাকে ভালো করার প্রচেষ্টা থাকা চাই। বরং সে যত খারাপ হবে, তার সঙ্গে সমন্বয় করা যত অসম্ভব হবে, সাধকের জন্য এটি উপরি পাওনা, এই কারণে যে, র্ধৈর্যশীলতা অনুশীলনের জন্য তার অন্য কোনো পরীক্ষা দেওয়ার দরকার নেই। বৈপরীত্যের দ্বন্দ্ব ও সমাহারের মধ্যেই বিকশিত হয় প্রেম। প্রেমের মাধ্যমে আসে একাত্মতা।
যখন একজন নারী ও একজন পুরষ একাত্ম হয়ে যায় তখন ঈশ্বর বাস করেন তাদের সঙ্গে। নিঃসঙ্গ ও বিচ্ছিন্ন মানুষ নন্দনকাননে প্রবেশের ছাড়পত্র পায় না। তাই আধ্যাত্মিকতার মূল ব্যাপার হলো দুইজনে এক হওয়া। এটি যদি স্বামী-স্ত্রীর পক্ষে সম্ভব না হয়- তবে আর কার পক্ষে সম্ভব? আর কার সঙ্গে একাত্ম হওয়ার জন্য প্রকৃতি সমস্ত সুযোগ অনিরুদ্ধ করে দেয়?
যদি স্বামী স্ত্রীকে নিঃশর্তে ভালোবাসতে না পারে, তবে আর কাকে ভালোবাসতে পারবে?
প্রেমের লক্ষ্য এক হওয়া। যে যতটুকু আরেকজনের সঙ্গে একাত্ম হতে পারে ততটুকুই তার ঈশ্বর উপলব্ধি। কেবল এই সূত্রেই ঈশ্বরকে ভালোবাসা এবং মানুষকে ভালোবাসা সমান্তরাল।
যে একজন মানুষের সঙ্গে একাত্ব হলো সে গোটা মানবজাতির সঙ্গে একাত্ম হলো। যে গোটা মানবজাতির সঙ্গে একাত্ম হলো, সে ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হলো।
এই একজনকেই আমরা খুঁজে মরি সারাজীবন। স্ত্রীর সঙ্গে একাত্ম হতে পারি না, ভাই-বোন, বন্ধুদের সঙ্গে একাত্ম হতে পারি না, মাতা-পিতার সঙ্গে একাত্ম হতে পারি না; অবশেষে আমরা একাত্ম হওয়ার জন্য গুরুর কাছে যাই। ফলে কী হয়? হয় একাত্ম হওয়ার ভান করে আমরা প্রতারকদের অন্তর্ভুক্ত হই; না হয় হওয়া/ না হওয়ার দ্বন্দ্বে দগ্ধ হয় হৃদয়। পুরুষের সৃষ্টি নারীর জন্য। নারীর সৃষ্টি পুরুষের জন্য। যখন একজনের প্রতি আরেকজনের শ্রদ্ধা থাকে না তখন ঈশ্বর সুপ্ত হয়ে যায়। যখন একজন অন্যজনকে শ্রদ্ধা করে ঈশ্বর উপস্থিত হয়। কুরুক্ষেত্রের প্রত্যক্ষ কারণ- রাজত্ব ছিল না। এটি ছিল একজন নারীর মর্যাদা রক্ষার যুদ্ধ।
জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় যৌবন। কেন? কারণ এই সময় একাত্ম হওয়ার ইচ্ছা প্রবল থাকে।
যে পরিবারে মাতা-পিতার মধ্যে প্রেম থাকে সে পরিবারে বড় ভাইবোন ছোট ভাইবোনদের প্রেম করে। যারা প্রেমময় একত্বে বাস করে তাদের বাসাটি হয় প্রেমের বাসা- ঈশ্বরের ঘর। একটি ঘর প্রেমময় হলে, একটি সমাজ প্রেমময় হওয়ার স্বপ্ন দেখা যায়। একটি সমাজ প্রেমময় হলে, একটি দেশ প্রেমময় হওয়ার স্বপ্ন দেখা যায়। একটি দেশ প্রেমময় হলে, পৃথিবী প্রেমময় হওয়ার স্বপ্ন দেখা যায়। তদ্বিপরীত নয়।
কে বলেছে আধ্যাত্মিকতা সুখ বিরোধী? আধ্যাত্মিকতা দুঃখ বিরোধী। আধ্যাত্মিকতা হলো শাশ্বত সুখের অন্বেষা। সুখ এমন একটা ব্যাপার, যা একা অনুভব করা যায় না। সুখ অনুভূত হয় প্রেম উপলব্ধির মাধ্যমে। যদি কেউ মনে করে যে, আরো কিছু টাকা থাকলে সুখ পাওয়া যেতো, তবে সে জীবন সম্বন্ধে এখনো অবিদিত। জীবনে টাকার প্রয়োজন আছে, কিন্তু তা সুখের শর্ত নয়। অর্থ, ক্ষমতা, খ্যাতির সঙ্গে স্বামী-স্ত্রী সুখে থাকার সম্বন্ধ অল্পই। যেখানে প্রেম আছে সেখানে অর্থ, ক্ষমতা, খ্যাতির সীমানা তুচ্ছ। প্রেম সব জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যগত বিভেদ ভাসিয়ে নিতে পারে।
সুখ কি? সুখ হলো প্রেমের হাসি, প্রেমের কান্না, প্রেমের গান, প্রেমের ফিসফিস।
আমাদের চোখ উদগ্রীব হয়ে আছে প্রেমাস্পদের রূপ দেখার জন্য, কান উদগ্রীব হয়ে আছে তার কন্ঠস্বর শোনার জন্য, ত্বক উদগ্রীব হয়ে আছে তার স্পর্শ পাওয়ার জন্য। পঞ্চইন্দ্রিয় নিজের জন্য নয়- তার জন্য। চোখ নিজেকে দেখার জন্য নয়- জগৎ দেখার জন্য। পঞ্চইন্দ্রিয়ের ব্যাকুলতা শুধু প্রেম পাওয়ার জন্য এবং প্রেম দেওয়ার জন্য।
নারীর জন্য কেমন পুরুষ দরকার? এমন পুরুষ দরকার- যে তাকে ভালোবাসতে পারে, মর্যাদা দিতে পারে।
পুরুষের জন্য কেমন নারী দরকার? এমন নারী দরকার- যাকে সে ভোলোবাসতে পারে, মর্যাদা দিতে পারে।
কে কতটা বিদ্ধান, কে কতটা ধনী, কে কতটা সুন্দর এর কোনো মূল্য নেই- কাকে কতটুকু ভালোবাসা যায় তাতেই রয়েছে মূল্য। “প্রীতি ও প্রেমের পুণ্য বাঁধনে যবে মিলি পরস্পরে, স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদের কুঁড়ে ঘরে”।
মানুষ চলে যায়। কিন্তু থেকে যায় তার প্রেম। থেকে যায় তার সত্য, যে সত্যকে সে লালন-পালন করতো। প্রেম জীবনকে ছাড়িয়ে যায়। সত্য জীবনকে অতিক্রম করে যায়।
মানব অস্তিত্ব যখন প্রেমময় হয় তখন তা ঈশ্বরের মন্দির হয়ে উঠে। মানুষ কেন বাঁচে? মানুষ বাঁচে প্রেম পাওয়ার জন্য এবং প্রেম দেওয়ার জন্য। প্রেম থেকে সৃষ্টি, প্রেমে লালন-পালন, প্রেমেই প্রত্যাবর্তন।
“একলা আমি মুক্ত হতে চাই না প্রাণনাথ
আমায় তুমি যুক্ত কর বিশ্বজনার সাথ।”
Some text
ক্যাটাগরি: মতামত
[sharethis-inline-buttons]