শুক্রবার বিকাল ৩:৩৩, ৩রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ১৭ই মে, ২০২৪ ইং

বিজ্ঞান, বিবর্তনবাদ ও মানুষ নিয়ে আমার ভাবনা

আবু এন এম ওয়াহিদ

বিজ্ঞানমনষ্করা আরো ভাবতে শুরু করেছেন যে, ‘বিজ্ঞান পারে না, এ জগতে এমন কিছু নেই। আজ হোক, কাল হোক, বিজ্ঞান মানুষের যাবতীয় সমস্যার সমাধান দেবে। মানুষের সকল কৌতূহল ও সওয়ালের জবাব বের করে আনবে। মহাসৃষ্টির তামাম অজানা রহস্যের সব দুয়ার খুলে দেবে’

আমরা এমন এক জামানায় বাস করছি, বিজ্ঞানী হই বা না হই, তবু বিজ্ঞান নিয়ে ভাবতে হয়। দিনে দিনে আমাদের জীবন আগা-গোড়া এমনভাবে বিজ্ঞানমুখাপেক্ষী হয়ে উঠছে, যেন আমরা সচেতন অথবা অবচেতন মনে প্রতিনিয়ত গভীর বিজ্ঞানসায়রে হাবুডুবু খাচ্ছি, অথচ কিছুই টের পাচ্ছি না। এমতাবস্থায় মনের অজান্তে কেউ কেউ অতিরিক্ত বিজ্ঞানবান্ধব ও বিজ্ঞানপ্রেমী বনে গেছেন! বিজ্ঞান যাই বলুক তাঁরা তাই সঠিক মনে করেন এবং বুঝে না বুঝে সেসব অন্ধের মতন অনুসরণ করেন। তাঁরা ভাবেন, বিজ্ঞান মানেই আধুনিকতা, বিজ্ঞান মানেই অগ্রগতি, বিজ্ঞান মানেই নিষ্কলুষ কল্যাণ। পক্ষান্তরে, অনেকে আবার বিজ্ঞানবিরূপও হয়ে উঠছেন। এই সব মানুষ বিজ্ঞানের নিত্যনতুন ধারণা ও নতুন নতুন উপকরণের সাথে নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারেন না। তাঁরা মনে করেন, বিজ্ঞানকে না মানাটাই যেন বলিষ্ঠ চরিত্র ও ব্যক্তিত্বেরই বহিঃপ্রকাশ।

এই দুই কিসিমের মাঝখানে যে আরেক দল মানুষ আছেন, সেকথা অনেক সময় আমরা বেমালুম ভুলে যাই। তাঁরাও আছেন এবং তাঁদের ভারসাম্যপূর্ণ চিন্তাশক্তি এবং পরিমীতিবোধসম্পন্ন জীবন ধারণ সমাজ ও সভ্যতার জন্য একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় বটে। এ পর্যায়ে আপনারা ভাবতেই পারেন, আমি নিজেকে মাঝখানের কাতারে ফেলে বুঝি বাহাদুরি নেব, কিন্তু সত্যি বলতে কি, এই তিন দলের মাঝে আমার অবস্থানটি কখন কোথায় গিয়ে ঠেকে তা আমি নিজেও জানি না। এমনি এক পটভূমিতে আজ আমি বিজ্ঞান নিয়ে আমার জানা, বোঝা ও মনের দু’টো কথা অকপটে আপনাদের উদ্দেশ্যে নিবেদন করতে চাই। ভুলত্রুটি পেলে ধরিয়ে দেবেন। খুশিমনে শুধরে নেব।

আমরা জানি, বিজ্ঞান প্রধানত দু’টো শাখায় বিভক্ত- তাত্ত্বিক ও ফলিত। তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের তামাম তত্ত্ব ও সূত্র আসে খোদ বিজ্ঞানীর মাথা থেকে। আর এসবের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলে কতেক গবেষণাগারে, চার দেয়ালের ভেতরে। আবার কতেক হয়ে থাকে সরেজমিনে, বাইরের বাস্তব জগতে। পরীক্ষিত সূত্রগুলো ব্যবহার করে ফলিত বিজ্ঞান মানব সমাজকে উপহার দিচ্ছে নিত্যনতুন প্রযুক্তি। কালের পরিক্রমায় এই প্রযুক্তির পরিসর বিস্তৃত হচ্ছে, নতুন নতুন ডালপালা মেলছে, গুণেমানে সমৃদ্ধ হচ্ছে। পৃথিবীব্যাপী ছোটবড় অসংখ্য কোম্পানি নিরন্তর নব নব প্রযুক্তিকে লুফে নিয়ে, নাড়াচাড়া করে, মানুষের জীবন ও জীবনযাত্রাকে সুন্দর, সহজ ও সহনীয় করে তোলার জন্য প্রত্যহ নানা জাতের প্রযুক্তিজাত যন্ত্রপাতি, উপকরণ ও উপাদানের ডালি নিয়ে ভোক্তা সাধারণের দুয়ারে এসে কড়া নাড়ে। এর মাঝে যেমন নিহিত আছে মানব সেবা ও মানব কল্যাণ, তেমনি আছে ব্যবসাবাণিজ্য, কেনাবেচা ও তাগড়া মুনাফা হাসিলের তাগাদা। কোনটার চেয়ে কোনটা বড়, সে-ও এক রসালো বিতর্কের অনুষঙ্গ। সেদিকে আজ যাচ্ছি না।

বাজারে নিত্যনতুন জিনিসপত্রের আমদানি-রপ্তানির ডামাডোলে হাজারো জাতের ছোটবড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাদের লাভের কঠিন ও জটিল অঙ্কগুলো সহজেই মিলিয়ে নেয়। ভোক্তা হিসেবে আমরাই বা কম কি। প্রয়োজন ও খায়েস মেটানোর উদ্দেশ্যে আমরা রঙ বেরঙের উপকরণগুলো দেওয়ানা হয়ে কিনি, এস্তেমাল করি, উপভোগ করি, উপকার পাই। একটা বিকল হওয়ার আগেই ছুঁড়ে ফেলে দিই, তারই উন্নত সংস্করণ আরেকটি কিনি। এভাবে দিনে দিনে আমাদের জীবন বৈচিত্র্যে, আনন্দে আর উত্তেজনায় ভরপুর হয়ে উঠছে। আজকাল প্রযুক্তির ওপর আমরা এমনভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি, নিজেদের অন্নটা পর্যন্ত নিজ হাতে উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাত করে খাবার টেবিলে হাজির করতে পারি না। পরনের কাপড়, সেও প্রযুক্তিরই ফসল। বসবাসের জন্য ঘরবাড়ি বানাতে গেলে বিশাল বিশাল যন্ত্রপাতির আঞ্জাম দিতে হয়। চিকিৎসাসেবা ও অষুধপত্রের কথা কী আর বলব! বিমার যখন শরীরে এসে আছর করে, তখন অসহায় হয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়ে করুণা মাগি। প্রযুক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করি। চিঁড়ে-মুড়ির মত অষুধ গিলি, দামী দামী অষুধ। জীবনের আরেকটি অতি প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ- ছেলেমেয়েদের পাঠদান ও জ্ঞানদান।  প্রযুক্তির  কোমল স্পর্শ ছাড়া সেটিও আজ অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভাবে বিজ্ঞান ও যান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা আমাদের জীবনকে অর্থপূর্ণ করছে কিনা জানি না, তবে আমরা মনে করি, প্রযুক্তির কারণে আমাদের যাপিত জীবন হয়েছে অনেক সহজ, সুন্দর ও আমারদায়ক। এই মনে করাটাও কতটা নির্ভুল ও যৌক্তিক তাও যুক্তিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়।

বিজ্ঞান প্রধানত দু’টো শাখায় বিভক্ত- তাত্ত্বিক ও ফলিত। তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের তামাম তত্ত্ব ও সূত্র আসে খোদ বিজ্ঞানীর মাথা থেকে। আর এসবের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলে কতেক গবেষণাগারে, চার দেয়ালের ভেতরে। আবার কতেক হয়ে থাকে সরেজমিনে, বাইরের বাস্তব জগতে। পরীক্ষিত সূত্রগুলো ব্যবহার করে ফলিত বিজ্ঞান মানব সমাজকে উপহার দিচ্ছে নিত্যনতুন প্রযুক্তি। কালের পরিক্রমায় এই প্রযুক্তির পরিসর বিস্তৃত হচ্ছে, নতুন নতুন ডালপালা মেলছে, গুণেমানে সমৃদ্ধ হচ্ছে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অন্য আরেকটি দিকও আছে। বিজ্ঞান জলে, স্থলে ও মহাশূন্যে বিরামহীন গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে এবং  নব নব অভিনব বিষয় আবিষ্কার করে মনুষ্য সমাজকে একের পর এক তাক লাগিয়ে দিচ্ছে! কোষ জীববিজ্ঞান এমন সব গবেষণা ও আবিষ্কার করে চলেছে যে, অনেকে এখন মনে করতে শুরু করেছেন, বিজ্ঞানের গতি অপ্রতিরোধ্য, শক্তি ও ক্ষমতা অসীম! তাঁরা বলে থাকেন, ‘সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন বিজ্ঞান মানুষকে অমর প্রাণীতে পরিণত করে দেবে। মানুষ আকাশযানে চড়ে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ঘুরে বেড়াবে। পৃথিবী নামক এই সবুজ গ্রহের বাইরে গিয়ে বসতবাড়ি গড়বে’ ইত্যাদি ইত্যাদি। বিজ্ঞানের এমন সাফল্য মানুষের চিন্তা জগতকে প্রতিনিয়ত নতুনভাবে ঝাঁকুনি দিচ্ছে। ইদানীং বিজ্ঞানমনষ্করা আরো ভাবতে শুরু করেছেন যে, ‘বিজ্ঞান পারে না, এ জগতে এমন কিছু নেই। আজ হোক, কাল হোক, বিজ্ঞান মানুষের যাবতীয় সমস্যার সমাধান দেবে। মানুষের সকল কৌতূহল ও সওয়ালের জবাব বের করে আনবে। মহাসৃষ্টির তামাম অজানা রহস্যের সব দুয়ার খুলে দেবে’। এতক্ষণ যা বললাম, তা বিজ্ঞানের সাফল্য, বিজ্ঞানের অবদান এবং আগামী দিনে বিজ্ঞানকে নিয়ে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা।

বিজ্ঞান প্রসঙ্গে এবার অন্য একটি বিষয়ের অবতারণা করতে চাই। প্রাণীজগৎসহ মহাবিশ্বের সবখানেই ক্রমাগত পরিবর্তনের আলামত অতি সুস্পষ্ট। একথা বোঝার জন্য কাউকে বিজ্ঞানবিশেষজ্ঞ হতে হয় না। ক্রমাগত পরিবর্তনের এই ধারাবাহিকতাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বিবর্তন বলে, বিবর্তনের সর্বজনীনতায়ও আমি কোনো সমস্যা দেখি না, তবে বিবর্তনের সর্বজনীনতার সাথে ‘বিবর্তনবাদের’ একটি বড় ফারাক আছে। ‘বিবর্তনবাদ’ একটি বিশেষ দার্শনিক মতবাদ যা এসেছে ডারউইনের ‘অরিজিন অফ স্পিসিস’ থেকে। এর একটি গভীর অন্তর্নিহিত ‘বাণী’ আছে। এই মূল বাণীটি হলো, মানুষ নিম্নশ্রেণির প্রাণী থেকে ‘বিবর্তিত’ হয়েছে এমন এক প্রক্রিয়ায়, যে প্রক্রিয়ায় বানর, বেবুন, শিম্পাঞ্জী, ওরাং-ওটাং ইত্যাদির উদ্ভব হয়েছে তাদের পূর্ব-প্রজাতি থেকে, পৃথিবী নামক আমাদের এই প্রিয় গ্রহে। মানুষের সাথে কথিত প্রজাতিগুলোর এতো এতো মিল খুঁজে পাওয়া যায় যে, যে কেউ মনে করতেই পারেন, ‘তাহলে বুঝি মানুষ এবং ওই প্রাইমেটগুলোর উৎপত্তির উৎস এক ও অভিন্ন’।

‘বিবর্তনবাদীরা’ যুক্তি হিসেবে এ রকম বলতে পারেন, ‘মানুষের মাঝে যেমন পশুর বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়, তেমনি কিছু কিছু পশু-প্রাণীও মানবিক গুণাগুণের অধিকারী’। উদাহরণ স্বরূপ-  মানুষ পশুর মত খায়দায়, ঘুমায়, বংশ বিস্তার করে, আবার প্রাণীকুলে মানবের মত বুদ্ধিমত্তার অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া যায়, যেমন- পিঁপড়া, মৌমাছি ও বানরসহ আরো অনেকের বুদ্ধি আছে এবং তারা দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। কুকুরের মাঝে আছে প্রগাঢ় প্রভূভক্তি ও আনুগত্যবোধ। প্রায় সকল প্রাণীই মানুষের মতন বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হয়, পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি তাদের মায়ামমতারও কমতি নেই। মানুষের মত তারাও সুখে আন্দোলিত হয়, দুঃখ পেলে কাঁদে। পশুরও রাগ আছে, ক্ষোভ আছে, আবেগ আছে, আছে উচ্ছ্বাস। পশু হিংস্র হয়, মানুষ হিংস্রতায় পশুকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। অতএব, তাঁদের মতে, মানুষ পশুরই এক উন্নত ও পরিশীলিত সংস্করণ। ‘বিবর্তনবাদ’ যদি সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে সামনে এমন এক দিন আসবে যখন মানুষ আর মানুষ থাকবে না, ‘অতিমানুষ’, ‘মহামানুষ’, ‘অধঃপতিতমানুষ’ কিংবা ‘অভিনবমানুষ’ নামে অন্য কোনো প্রজাতিতে রূপান্তরীত হয়ে যাবে এবং সেখানেও থেমে থাকবে না, এভাবে ক্রমাগত তার ‘ক্রমবির্বতন’ হতেই থাকবে।

মানুষের সঙ্গে পশুর হাজারো মিল থাকতে পারে, কিন্তু তাদের মাঝে তিনটি মৌলিক পার্থক্য আছে।  প্রথমত, পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র প্রাণী যার চাহিদা সীমাহীন। পশু-পাখির চাহিদা তার পেট ভরাবার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, কিন্তু মানুষের চাহিদার কোনো চৌহদ্দি নেই। একটি বিশেষ সময়ে মানুষ একটি বিশেষ চাহিদা পূরণ করে ফেলতে পারে এবং এই পূরণ করে ফেলাটাই  সঙ্গে সঙ্গে তার জন্য আরো হাজারো চাহিদার দুয়ার খুলে দেয়। এখানে লক্ষ করার মত আরেকটি মজার ব্যাপার আছে। দু’টো কঠিন বস্তবতা নিরন্তর মানুষের এই ‘অসীম চাহিদার’ লাগাম টেনে ধরে রেখেছে। তার একটি বস্তুতান্ত্রিক এবং আরেকটি নৈতিক। এক. মানুষ যত বিত্তশালীই হোক না কেন, দিনের শেষে তার সম্পদ সীমিত। সীমিত সম্পদের কারণে সে তার সব চাহিদা মেটাতে পারে না। চাহিদার মাঝে তার জন্ম এবং অসংখ্য অপূর্ণ চাহিদা নিয়েই সে দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়।

প্রাণীকুলের বেলাও একথা সত্য। তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন খাদ্য ও পানীয়। তাদের জন্যও জগতে এ দুই বস্তুর যোগান সীমিত।  দুই. মানুষ তার জীবনে এই সীমিত সম্পদ আহরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আরো একটি কঠিন ও কঠোর বস্তবতাকে সঙ্গে লয়ে। এই বাস্তবতা আর কিছু নয়, সমাজ, রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় আইন-আদালত, সর্বোপরি নিজের বিবেকের কাছে তার দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহীতা। অর্থাৎ সে যেনতেন তরিকায় সম্পদ আহরণ করতে পারে না। প্রাচীনকালে যখন সমাজ  এবং রাষ্ট্র ছিল না, তখনো মানুষের দায়বদ্ধতা ছিল গোত্র, পরিবার ও আপন বিবেকের কাছে। তাহলে এ পর্যন্ত আমরা পশুর সাথে মানুষের দু’টো মৌলিক তফাৎ পেলাম। প্রথমত, ‘অসীম চাহিদা’ এবং দ্বিতীয়ত, ‘দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহীতা’। তৃতীয় যে বৈশিষ্ট্য মানুষের মর্যাদাকে পশুর চেয়ে যোজন যোজন উপরে তুলে ধরে সেটা হলো- মানুষ বিচার-বিবেচনাসম্পন্ন সৃষ্টি। দু’জন মানুষের মধ্যে ঝগড়াঝাটি ও মারামারি হলে তৃতীয়জন বুদ্ধি-বিবেচনা ও ন্যায়নীতির ভিত্তিতে বিচার ফয়সালা করে দিতে পারে। পক্ষান্তরে পশুর এই যোগ্যতা নেই। এই তিনটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য মানুষ ও পশুর মাঝে যে বিভাজনের দেয়াল তুলেছে সে দেয়াল বিবর্তনবাদের হাত ধরে  ক্রমে ক্রমে কিভাবে টপকানো যায়, তা আমার জানা নেই।

মানুষের সঙ্গে পশুর হাজারো মিল থাকতে পারে, কিন্তু তাদের মাঝে তিনটি মৌলিক পার্থক্য আছে।  প্রথমত, পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র প্রাণী যার চাহিদা সীমাহীন। পশু-পাখির চাহিদা তার পেট ভরাবার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, কিন্তু মানুষের চাহিদার কোনো চৌহদ্দি নেই। একটি বিশেষ সময়ে মানুষ একটি বিশেষ চাহিদা পূরণ করে ফেলতে পারে এবং এই পূরণ করে ফেলাটাই  সঙ্গে সঙ্গে তার জন্য আরো হাজারো চাহিদার দুয়ার খুলে দেয়। এখানে লক্ষ করার মত আরেকটি মজার ব্যাপার আছে। দু’টো কঠিন বস্তবতা নিরন্তর মানুষের এই ‘অসীম চাহিদার’ লাগাম টেনে ধরে রেখেছে। তার একটি বস্তুতান্ত্রিক এবং আরেকটি নৈতিক।

মানুষ হিসেবে আমাদের চাহিদা যেমন সীমাহীন তেমনি বিজ্ঞানী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কাছে আমাদের আছে অশেষ অশেষ ঋণ। আগুন, চাকা, বিদ্যুৎ, গাড়ি, উড়োজাহাজ, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, স্মার্ট ফোন, পেনিসিলিন, অ্যানেস্তেশিয়া, এমআরআই, মহাশূন্য যান, উপগ্রহ প্রযুক্তি ইত্যাদি সবই বিজ্ঞানের অবদান। এগুলো আমাদের জীবন, জীবনযাত্রা ও চিন্তাভাবনার খোলনলচে পাল্টে দিয়েছে। বৈজ্ঞানিক উপকরণ ছাড়া আজকাল আমরা এক মুহূর্তের কথাও ভাবতে পারি না। এ সব কিছু মেনে নেওয়ার পরও আমি আমার বিজ্ঞানপ্রেমী বন্ধুদের একটি বিষয় ভেবে দেখতে বলব। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষের জীবনের জন্য যত কিছু তৈরি করেছে তার কোনোটিই কিন্তু নির্ভেজাল ও নিখুঁত আশির্বাদ নয়।

কম হোক বেশি হোক, বিজ্ঞানজাত এমন কোনো উপাদান উপকরণ নেই যার কোনো নেতিবাচক অভিঘাত মানুষের জীবন ও প্রকৃতির ওপর পড়ছে না। তাই বলে আমি একথা বলছি না যে, আজই আমি গাড়ি চড়া, ইন্টারনেট ব্যবহার কিংবা ডাক্তারের কাছে যাওয়া বন্ধ করে দেব। আমি যা বলতে চাচ্ছি তা হলো, এক দিকে বিজ্ঞানের সম্ভাবনা যেমন অপরিসীম, অন্য দিকে তেমনি আবার প্রতিটি ক্ষেত্রে তার সীমাবদ্ধতাও তর্কাতীতভাবে প্রমাণিত। উদাহরণ স্বরূপ বলতে পারি, একদিকে কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের  উপকারিতার শেষ নেই, অন্যদিকে এর অসংখ্য নেতিবাচক ও ক্ষতিকারক অভিঘাতের কথা আমরা সবাই জানি, এটি ব্যাখ্যা করারও দরকার পড়ে না। চিকিৎসা বিজ্ঞানের কথা যদি বলি, ক্যান্সারের অষুধের যেমন রয়েছে মারাত্মক নেতিবাচক পাশর্^প্রতিক্রিয়া, সামান্য হলেও তেমনি খারাপ পাশর্^প্রতিক্রিয়া রয়েছে মাথা ব্যাথায় সেবন করা একটি মামুলি ‘টাইলেনল’ বড়িতে।

এখন বস্তুজগতের একটি অভিনব রহস্যের কথা বলতে চাই। আমাদের এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, যা কিছু আছে তার সবই সীমিত সংখ্যক মৌলিক পদার্থের সমন্বয়ে গঠিত। যে কোনো পদার্থকে যদি আমরা ক্রমাগত ভাঙ্গতে থাকি, তাহলে ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে এক সময় চলে যাব অণু-পরমাণু পর্যায়ে। পরমাণুর ভেতরে কী আছে? আছে প্রোটন, নিউট্রন ও ইলেকট্রন। এগুলো তিন ধরণের কণা, এগুলো চোখে দেখা যায় না – এমন কি সবচেয়ে তীক্ষ্ণ অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও না, তবে গবেষণাগারে পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে কেবল অনুভব করা যায়, অনুভব করা যায় যে, ওই পর্যায়ে  বস্তু তার আপন বৈশিষ্ট্য ও অস্তিত্ব হারিয়ে বিলীন হয়ে গেছে এক ধরনের সম্ভাবনাপ্রসূত তরঙ্গ ফাংশন অথবা আলোর কণায়। অন্য ভাষায় বলতে গেলে বলা যায়, বস্তুর মূলে গেলে আর বস্তু পাওয়া যায় না, পাওয়া যায় এনার্জি বা শক্তি।

সবশেষে, সৃষ্টি রহস্য নিয়ে কৌতুহলী মানুষের চূড়ান্ত প্রশ্নে বিজ্ঞানের অবস্থান নিয়ে সংক্ষেপে কয়েকটি কথা বলে আজকের লেখাটির ইতি টানব। অবিজ্ঞানী সাধারণ মানুষের পক্ষে আলোচ্য বিষয়টি সমঝে নেওয়া একেবারে সহজ না হলেও কঠিন নয়। এবার দেখা যাক মহাবিশ্বের মহাসৃষ্টি কেন ও কিভাবে হয়েছিল? এ প্রশ্নে বিজ্ঞান কী উত্তর দেয়। বিজ্ঞানের মতে সৃষ্টির সূচনা হয়েছে ‘বিগ ব্যাঙ্গ সিঙ্গুলারিটি’-তে। ওই পর্যায়ে মহাবিশ্বের যাবতীয় বস্তু ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র, সীমাহীন ক্ষুদ্র একটি বিন্দুতে জমাট বাঁধা ছিল। ওই বিন্দুর ঘনত্ব ছিল অসীম, বক্রতাও ছিল অসীম এবং তার আকার ছিল এতই ছোট যেন শূন্যেরই নামান্তর। দশ থেকে বিশ বিলিয়ন বছর আগে, ওই জমাট বাঁধা বিন্দুতে  ‘বিগ ব্যাঙ্গ’ বিষ্ফোরণ ঘটে, যার মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় স্থান (স্পেস) ও তার নিরন্তর সম্প্রসারণ প্রক্রিয়া এবং কাল (টাইম) ও তার নিরন্তর পথ চলা।

গেল ১০০ বছরে বিজ্ঞানী ও মহাবিজ্ঞানীরা অনেক জটিল ও কঠিন তত্ত্ব ও সূত্র আবিষ্কার করেছেন যা দিয়ে মহাবিশ্বের যে কোনো সময়ের অবস্থা পর্যালোচনা করে আগামীতে কী হতে পারে সেই মর্মে ভবিষ্যৎবাণী করছেন এবং সেগুলো মোটামুটি সঠিকই হচ্ছে, কিন্তু সৃষ্টির ‘বিগ ব্যাঙ্গ’ রহস্য উন্মোচনের জন্য ওই সব তত্ত্বজাত সমীকরণগুলোকে যখন অসীম ঘনত্ব ও বক্রতাসম্পন্ন এবং অসীম ক্ষুদ্রকায় ওই জমাট বাঁধা বিন্দুতে নিয়ে প্রয়োগ করা হয় তখন গোটা তত্ত্ব ভেঙ্গে খান খান হয়ে ধ্বসে পড়ে। সসীমে যা কাজ করে, অসীমে তা অচল! তাই সৃষ্টি রহস্যের মূল প্রশ্নে (জমাট বাঁধা বিন্দুটি কেন বিষ্ফোরিত হলো?) মহাবিজ্ঞানীরা অনাথ শিশুর মতন অসহায়!

আবু এন. এম. ওয়াহিদ : অধ্যাপক- টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি,

এডিটর – জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ
awahid2569@gmail.com

ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম

ট্যাগ:

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply