শুক্রবার সন্ধ্যা ৬:০৬, ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ৩রা মে, ২০২৪ ইং

‌সি‌লেবাসনির্ভর শিক্ষায় জীবনদর্শন বিলুপ্ত

জান্নাতুল মাওয়া ড্রথি

“আমাদের সমাজের যখন এ করুণ পরিণতি, তখন আমরা কোন্ মানবিক বিপ্লবের আশা করছি? যে সন্তান বড় হচ্ছে রাষ্ট্রের কাছে তার সিলেবাস মুখস্থের বিনিময়ে নিশ্চিন্তের জীবন যাপনের পেশার আশায়, সে কিভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে? অথবা সৎ মানবিক এবং ন্যায়পরায়ন সমাজ গঠনের পক্ষে অবস্থান নেবে? সে কী করে দেশ-জাতি গঠনে ভূমিকা রাখবে?”

আজকাল আমরা এমনভাবে জীবন যাপন করছি- “আমার যা ইচ্ছা তাই করবো, তাতে অন্যের উপর কি প্রভাব পড়লো তাতে আমার কিছু যায় আসে না।” এ ধরনের মানসিকতা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের মাঝে। তারপর সেটা ছড়িয়ে পড়ে সন্তানদের মাঝেও। তাই অতীতের সেই মেধাবী তরুণসমাজ এখন আর তেমন গড়ে উঠছে না। বরং অস্থির, উগ্র এবং সবকিছুর উপর অনীহা পোষণ করে এমন একটা সমাজ গড়ে উঠছে চারপাশে। এজন্য প্রধানত দায়ী- কোন্ পারিবারিক পরিমণ্ডলে সে বেড়ে উঠছে, তার চারপাশে সে কেমন মানুষদের দেখছে। এরপর আমাদের সমাজব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা- এগুলোর প্রভাব পড়তে শুরু করে। কেমন অস্থির একটা সমাজব্যবস্থা আমরা গড়ে তুলেছি তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সবদিকে যে অনৈতিকতার গোলক ধাঁধা তৈরি হয়েছে, তা যেন ভেদ করা অসম্ভব। এর ভেতরে হাবুডুবু খাচ্ছে আমাদের তরুণসমাজ। এগুলো ভেদ করার জন্য যে উপযুক্ত জ্ঞান বা শিক্ষার প্রয়োজন, তা আজকের তথাকথিত শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে নেই। আমরা তৈরি করে চ‌লে‌ছি নির্দিষ্ট সিলেবাসের কিছু যন্ত্রমানব, যারা নিযুক্ত হবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কর্মযোগের রোবোটিক কর্মচারী হিসেবে। যাদের থাকবে না বিবেক, বিচার-বুদ্ধি। থাকবে না সত্তাগত জ্ঞান, থাকবে না জীবনদর্শন বা মানবিক গুণাবলী।

আরো পড়ুন> ভোর আসবে মানুষেরই হাত ধরে

আমাদের সমাজে ভালো শিক্ষা মানে বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণের যোগ্যতা। শিক্ষাব্যবস্থা এখন কর্মবান্ধব, জ্ঞানবান্ধব নয়। এর বাইরে আমরা যেতেই পারি না। যদিওবা যাওয়ার চেষ্টাটুকু করি, তবে মেধাকে তো সম্মান দেওয়া হবেই না বরং কপালে জুটবে সমাজচ্যুত হওয়ার খড়গ। তার সাথে পেতে পারি পাগল, ভণ্ড উপাধি। ব্য‌ক্তি জীবনের চালিকা শক্তিকে অর্থোপার্জনের মেশিন না বানালে সে সমাজের যোগ্য নয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রায় শোনা যায়, ছাত্রসমাজের নতুন কিছু শেখার আগ্রহ কম। সিলেবাসের বাইরে হলে তো তার ধারেকা‌ছেও ভি‌ড়ে না। শেখার আগ্রহ যাদের আছে, তারাও রাতারাতি কিছু হয়ে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর। এর ফলে মানসম্মত জ্ঞাননির্ভর কিছুই হচ্ছে না।

“অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সবদিকে যে অনৈতিকতার গোলক ধাঁধা তৈরি হয়েছে, তা যেন ভেদ করা অসম্ভব। এর ভেতরে হাবুডুবু খাচ্ছে আমাদের তরুণসমাজ। এগুলো ভেদ করার জন্য যে উপযুক্ত জ্ঞান বা শিক্ষার প্রয়োজন, তা আজকের তথাকথিত শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে নেই। আমরা তৈরি করে চ‌লে‌ছি নির্দিষ্ট সিলেবাসের কিছু যন্ত্রমানব, যারা নিযুক্ত হবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কর্মযোগের রোবোটিক কর্মচারী হিসেবে।”

আমাদের পারিবারিক মণ্ডলে নৈতিক শিক্ষার চর্চা থেকে কপটতা, স্বার্থপরতা এবং শুধু নিজেকে পেতে হবে- এ শিক্ষাটাই মুখ্য হ‌য়ে উঠে‌ছে। বাবা মায়ের জীবন-যাপন সন্তানের জীবন-যাপনের উপর প্রভাব ফেলে। সন্তান যখন তাদের ভুল এবং অন্যায় করতে দেখে, তখন সে সেটাতেই অনুপ্রাণিত হয়। আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত একটা নিয়ম- বাবা-মায়ের কোনো ভুল থাকে না। অথবা বয়স্করা সবসময় সঠিক পথ দেখায়। এ রকম একটা মানসিক দাসত্বনির্ভর সমাজব্যবস্থা বহুদিন ধরে চলে আসছে, এতে তরুণ প্রজন্ম মানসিকভাবে পঙ্গুত্ব বরণ কর‌ছে। আজকের সমাজে ছেলেরা পড়াশোনা করে বড় হয় বেশি বেতনের চাকরি পাওয়ার জন্য। অপর‌দি‌কে মেয়েরা পড়াশোনা করে বড় হয় ভালো বর পাওয়ার জন্য। এ ধর‌নের সমাজে নৈতিকতাসম্পন্ন তরুন প্রজন্ম না পাওয়াই স্বাভাবিক।

লেখকের সব লেখা

আমাদের সমাজের যখন এ করুণ পরিণতি, তখন আমরা কোন্ মানবিক বিপ্লবের আশা করছি? যে সন্তান বড় হচ্ছে রাষ্ট্রের কাছে তার সিলেবাস মুখস্থের বিনিময়ে নিশ্চিন্তের জীবন যাপনের পেশার আশায়, সে কিভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে? অথবা সৎ মানবিক এবং ন্যায়পরায়ন সমাজ গঠনের পক্ষে অবস্থান নেবে? সে কী করে দেশ-জাতি গঠনে ভূমিকা রাখবে? বিশ্বমানবতায় তার অবস্থান শূন্যে হওয়াটাই স্বাভাবিক। জীবনদর্শনের চেয়ে জীবন যাপনের গুরুত্ব যেখানে বেশি, সেখানে নির্বুদ্ধিতা আর হটকারিতায় আর যাই হোক, সামাজিক বিপ্লব সম্ভব নয়।

“একটা মানসিক দাসত্বনির্ভর সমাজব্যবস্থা বহুদিন ধরে চলে আসছে, এতে তরুণ প্রজন্ম মানসিকভাবে পঙ্গুত্ব বরণ কর‌ছে। আজকের সমাজে ছেলেরা পড়াশোনা করে বড় হয় বেশি বেতনের চাকরি পাওয়ার জন্য। অপর‌দি‌কে মেয়েরা পড়াশোনা করে বড় হয় ভালো বর পাওয়ার জন্য। এ ধর‌নের সমাজে নৈতিকতাসম্পন্ন তরুন প্রজন্ম না পাওয়াই স্বাভাবিক।”

আজকালকার বাবা মায়েরা শিক্ষার নামে সন্তানের সর্বোচ্চ মার্কসম্পন্ন সার্টিফিকেটের মূল্য বেশি দেয়। সার্টিফিকেটের কাছে সন্তানের জীবনের মূল্যও থাকে না। প্রতিবছর মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের সময় অকৃতকার্য হয়ে কতজন আত্মহত্যা করেছে তাও হিসাব রাখতে হয়। এবারও ৮ জনের মৃত্যুর খবর এসেছে। বেশিরভাগ পরিবারেই নিয়মিত পড়াশোনার পাশাপাশি অন্যান্য বই পড়ায় তেমন উৎসাহ দেওয়া হয় না।

আমরা অনেক কঠিন বিষয় নিয়ে সময় কাটাতে পছন্দ করি। কিন্তু একটা জ্ঞাননির্ভর বই আমাদের অবসর বা দৈনন্দিন জীবনে কতটা আনন্দদায়ক এবং তৃপ্তি দিতে পা তা উপলব্ধি করি না। জাতিগত অধঃপতনের মূলেও কাজ করে জ্ঞান অন্বেষণ না করার মানসিকতা। ফলাফল, আমরা প্রাত্যহিক বস্তুবাদী জীবনের প্রতি অতিমাত্রায় আকৃষ্ট হয়ে পড়েছি। এতে জীবনে হতাশা নেমে এসেছে। তথাকথিত সফলতার পেছনে ছুটতে গিয়ে নিজেদের ভেতরের আত্মার আনন্দকে মেরে ফেলছি। তাই জীবনের চরম সময়ে জীবনের মূল্য বুঝি না।

লেখকের ব্লগ

জান্নাতুল মাওয়া ড্রথি : কলামিস্ট

 

ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম

ট্যাগ: জান্নাতুল মাওয়া ড্রথি

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply