শুক্রবার সকাল ৮:৩০, ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ৩রা মে, ২০২৪ ইং

সরকারি চাকরিতে বেতন-ভাতা বৃদ্ধি জাতীয় সমস্যা ও বেকারত্বের কারণ

খায়রুল আকরাম খান

গবেষকদের মতে, গবেষণালবদ্ধ কাজকে বাদ দিয়ে সরকারি চাকরির পেছনে দৌড়ানোর কারণ মোটা অংকের বেতন। পাশাপাশি বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কম থাকায় চাকরি তৈরি হচ্ছে না এবং উদ্যোক্তা হবার ঝুঁকিও অনেকে নিচ্ছে না। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসেবেও দেখা গেছে, উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়ে গেছে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে না এবং চাকরির সুযোগ কম।

সরকারি চাকরির প্রতি সাধারণ মানুষের আকর্ষণ চিরকালই ছিল। কিন্তু ভালো বেতন, চ্যালেঞ্জ, আত্মবিকাশের সুয়োগ- এসব কারণে মেধাবী তরুণরা বেসরকারি চাকরির প্রতিই আকৃষ্ট। এদিকে অষ্টম বেতন কাঠামো বাস্তবায়নের পর অনেক ক্ষেত্রে সরকারি চাকরির বেতন বেসরকারির চেয়ে বেশি হয়ে গেছে। এর সঙ্গে সরকার গাড়ি-বাড়ির ঋণসহ যেভাবে নানা সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে তাতে সরকারি চাকরির প্রতি তরুনদের আকর্ষণ আরো বেড়েছে। এ প্রসঙ্গে  সাবেক সরকারি কর্মকর্তাদের অভিমত হলো, সরকারি খাতের চাকরিতে প্রারম্ভিক বেতন আগে যেটা ভালো ছিল না, এখন তা খুবই ভালো। শুরুতেই ৪০ হাজার টাকার উপরে বেতন দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে থাকে আরো অনেক রকম সুবিধা।

বাইরে থাকলে বাড়ি-ভাড়াসহ নানান সুবিধা আছে। তবে এসব কিছুর পরও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তাদের একটা ক্ষমতা থাকে। তাদের মতে, আমাদের মতো দরিদ্র দেশে সাধারণ জনগণ থেকে বিভিন্ন ধরনের মোটা অংকের কর নিয়ে সরকারি কর্মচারিদের বেতন-ভাতা ভাড়ানো একটি বৈসম্যমূলক কাজ। এতে ভবিষ্যতে সামাজিক অস্থিরতা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। এ ধরনের অব্যবস্থা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে কোনো শিক্ষিত যুবক বেসরকারি খাতে চাকরি করতে চাইবে না। ফলে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় করপোরেট ও মাল্টিন্যাশনাল প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশিদের হাতে চলে যাবে। যার প্রক্রিয়া গত ৩/৪ বছর থেকে  শুরূ হয়েছে।

জরিপ করে দেখা যায়, শতকরা হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশেই সবচেয়ে কম সরকারি চাকরির সংস্থান হয়। অন্যদিকে বেসরকারি খাত বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে গেলেও শিক্ষিত যুবকদের অদক্ষতা ও অনাগ্রহের কারণে এ খাতের শীর্ষস্থানীয় পদের চাকরিগুলো করায়ত্ত করে রেখেছে বিদেশিরা। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের সরকারি খাতে চাকরি আছে মাত্র ৩.৮%, বেসরকারি খাতে ১৪.২%, ব্যক্তি খাতে ৬০.৯% এবং অন্যাণ্য খাতে ২১.১%। অন্যদিকে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রতিনিয়তই বাড়ছে। কর্মসংস্থানের যে ভয়াবহ চিত্র তাতে উচ্চশিক্ষিতদের বড় অংশেরই কর্মসংস্থান হতে হবে দেশি-বিদেশি বেসরকারি ব্যক্তিমালিকানাধীন খাতে। এমতাবস্থায় এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, উচ্চশিক্ষিতদের বেশিরভাগেরই সরকারি চাকরি হবে না। তারপরও শিক্ষিত যুবকরা সরকারি সরকারি জন্য মেধা-বুদ্ধি খরচ করে যাচ্ছেন।

শতকরা হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশেই সবচেয়ে কম সরকারি চাকরির সংস্থান হয়। অন্যদিকে বেসরকারি খাত বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে গেলেও শিক্ষিত যুবকদের অদক্ষতা ও অনাগ্রহের কারণে এ খাতের শীর্ষস্থানীয় পদের চাকরিগুলো করায়ত্ত করে রেখেছে বিদেশিরা।

ঐতিহ্যগতভাবেই আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত যুবকদের মাঝে সরকারি চাকরির চাহিদা সবসময় ছিল। তবে ইদানিং বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার কারণে এই চাহিদা বেড়েছে জ্যামিতিক হারে। বিশেষ করে ২০১৫ সালে সরকারি চাকরিতে বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা এক লাফে দ্বিগুণ হয়ে যাওায়ার পর শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে সরকারি চাকরির প্রতি আগ্রহ আরো বেড়েছে। দুই দশক আগেও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে সরকারি চাকরির জন্য অত হাপিত্যেশ দেখা যায়নি। অথচ গত তিন বছরে ক্লাসের পড়া বাদ দিয়ে তৃতীয় বর্ষ থেকেই চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার জন্য গ্রন্থাগারে ঢুকতে সকাল থেকেই লাইন ধরছে শিক্ষার্থীরা। এতদিন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরি এড়িয়ে চললেও ইদানিং তারাও আসছে এই দিকে। বিসিএস পরীক্ষায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে।

সম্প্রতি সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা যেভাবে মাঠে নেমেছে, সাম্প্রতিককালে কোনো দাবিতে এত বেশি মানুষের পথে নামার ঘটনা দেখা যায়নি। এরপরই আলোচনায় আসে, কেন শিক্ষার্থীরা এত উদগ্রীব হয়ে গেছে। শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন করেছে, সেখানে মূলত বেশি উঠে এসেছে বিসিএসসহ প্রথম শ্রেণির চাকরির বিষয়টি। এই চাকরিগুলোর মর্যাদা এবং ক্ষমতা যেমন বেশি, তেমনি বেতন ভাতাও আকর্ষণীয় এবং ভবিষ্যত উজ্জ্বল! প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরিতে যোগ দিলে শুরুতেই এখন ৩৫ থেকে ৩৮ হাজার টাকা মিলছে। এর পাশাপাশি প্রতি বছর পাঁচ শতাংশ হারে বেতন বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি, পদোন্নতির সুনির্দিষ্ট নীতিমালা, চাকরির নিরাপত্তা, পর্যাপ্ত ছুটি, পরিবহন ও আবাসন সুবিধা, সন্তানদেরকে স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার, অবসরকালীন সুবিধার পাশাপাশি সামাজিক মর্যাদাও শিক্ষার্থীদেরকে সরকারি চাকরির দিকে ধাবিত করছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ এবং গবেষকরা।

প্রথম শ্রেণির পাশাপাশি দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতেও এখন বেতন কাঠামো আকর্ষণীয়। এই পদগুলোতে যারা যোগ দেয়, তাদের সমান শিক্ষাগত এবং অন্যান্য যোগ্যতা নিয়ে বেসরকারি চাকরিতে এসব সুযোগ সুবিধা অনেক কম। সেখানে সুনির্দিষ্ট কাঠামো না থাকা, পদোন্নতির জন্য কাজের চেয়ে নিয়োগকর্তার সুনজরে পড়ার বিষয়ও থাকে। এর বাইরেও বেশ কিছু বিষয় রয়েছে। যেমন মাতৃত্বকালীন ছুটি বেশিরভাগ বেসরকারি চাকুরেদের জন্য চার মাস হলেও সরকারি চাকরিজীবীরা এই ছুটি পান ছয় মাসের। নৈমিত্তিক ছুটি সরকারি চাকুরেরা ইচ্ছা অনুযায়ী কাটাতে পারলেও বেসরকারি চাকুরেরা সে সুবিধা পান না অনেক ক্ষেত্রেই। অসুস্থতাজনিত ছুটির ক্ষেত্রেও বৈষম্য রয়েছে। আবার সরকারি চাকুরেদের অর্জিত ছুটি জমলে এর বিনিময়ে টাকার জন্য দুশ্চিন্তা করতে হয় না, কিন্তু বেসরকারি চাকরির অনেক ক্ষেত্রেই এসব নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়।

ঐতিহ্যগতভাবেই আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত যুবকদের মাঝে সরকারি চাকরির চাহিদা সবসময় ছিল। তবে ইদানিং বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার কারণে এই চাহিদা বেড়েছে জ্যামিতিক হারে। বিশেষ করে ২০১৫ সালে সরকারি চাকরিতে বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা এক লাফে দ্বিগুণ হয়ে যাওায়ার পর শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে সরকারি চাকরির প্রতি আগ্রহ আরো বেড়েছে। দুই দশক আগেও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে সরকারি চাকরির জন্য অত হাপিত্যেশ দেখা যায়নি। অথচ গত তিন বছরে ক্লাসের পড়া বাদ দিয়ে তৃতীয় বর্ষ থেকেই চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার জন্য গ্রন্থাগারে ঢুকতে সকাল থেকেই লাইন ধরছে শিক্ষার্থীরা।

বিনয় পাল নামে আমার এক পরিচিতজন ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরখানেক যাবৎ  শিক্ষকতা করছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতোকত্তোর করেছেন। কিন্তু এখন উক্ত চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিসিএস পরীক্ষা দিচ্ছেন। শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে বিসিএস ক্যাডার হতে চাইছেন, জানতে চাইলে বিনয় বলেন, ‘পরিবারের মানসিকতা হলো যে সরকারি চাকরি করতে হবে, ক্ষমতা থাকতে হবে, বিয়ে করার জন্য এই চাকরির গ্রহণযোগ্যতা বেশি। এছাড়া মর্যাদা, বেতন কাঠামো এবং জব সিকিউরিটি সবকিছু মিলিয়েই আমাকে বিসিএস বেশ আকর্ষণ করছে।’ এরকম আরো অনেক উদাহরণ এখন দেখা যায়, যারা অন্য চাকরি ছেড়ে সরকারি চাকরিতে যোগ দিচ্ছেন। সরকারি চাকরির জন্যে হন্যে হয়ে ছুটছেন।

আবার সরকারি চাকরিতে আগ্রহের সবচেয়ে বড় কারণ, চাকরির নিশ্চয়তা। এটা বেসরকারি খাতের চাকরিতে নেই। বেসরকারি খাতে সহজেই চাকরিচ্যুত করা যায়। কিন্তু সরকারি চাকরি সহজে যায় না। সামাজিক স্বীকৃতিও সরকারি চাকরির অন্যতম কারণ। এছাড়া রয়েছে ক্ষমতা ব্যবহারের চর্চা। একজন সরকারি কর্মকর্তা ক্ষমতা চর্চা করতে পারেন। কিন্তু বেসরকারি খাতে একজন সর্বোচ্চপদধারী ব্যক্তিও ক্ষমতা চর্চা করতে পারেন না। সরকারি চাকরিতে সময় দেয়ার নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা আছে। কিন্তু বেসরকারি খাতে সেটা নেই। এসব মিলিয়ে তরুণদের প্রথম পছন্দ থাকে সরকারি চাকরি। কিন্তু গবেষকদের মতে, গবেষনালবদ্ধ কাজকে বাদ দিয়ে সরকারি চাকরির পেছনে দৌড়ানোর কারণ মোটা অংকের বেতন। পাশাপাশি বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কম থাকায় চাকরি তৈরি হচ্ছে না এবং উদ্যোক্তা হবার ঝুঁকিও অনেকে নিচ্ছেন না। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসেবেও দেখা গেছে, উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়ে গেছে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে না এবং চাকরির সুযোগ কম। ফলে সরকারেরই যতটুকু বিনিয়োগ সেজন্য সেখানে একটা ঝোঁক বেশি।

বর্তমানে বাংলাদেশে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। তাদের বেতন-ভাতা দ্বিগুণ করার সাথে সাথে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্রের দাম হু হু করে বেড়ে চলেছে। পাশাপাশি তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যও বৃদ্ধি পেয়েছে। টাকার মূল্য দিন দিন কমছে। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবন নির্বাহ কঠিনতর হচ্ছে। বর্তমানে আমাদের দেশে প্রায় চার কোটি ৮২ হাজার লোক প্রকৃত বেকার। এর মধ্যে ৪০শতাংশই শিক্ষিত বেকার। দেশের এই ভয়াবহ অবস্থার প্রেক্ষিতে সরকার বাহাদুরের উচিৎ, একটি সুষ্ঠু নীতি মালা প্রনয়ণ করে নতুন কর্মস্থান সৃষ্টি করা এবং সরকারি ও বেসরকারি চাকরির  বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার মধ্যে ভারসাম্য আনা।

ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম

ট্যাগ:

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply