শুক্রবার সকাল ১০:৩০, ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ৩রা মে, ২০২৪ ইং

মফস্বল সাংবাদিকদের অমানবিক জীবন

আবুল খায়ের আনছারী

মফস্বলে কাজ করা একজন সাধারণ সাংবাদিক আমি। সাংবাদিকতা মহৎ পেশা জেনেই এ লাইনে কাজ করতে এসেছি। কতটা মহৎ হতে পারব জানি না। কিংবা শেষ পর্যন্ত এ পেশায় নিজের মহত্ত্ব ঠিক থাকবে কি না সেটাও জানা নেই।

আমার চেনা একজন জ্ঞানী লোকের মুখ থেকে শুনেছিলাম, পেশা হিসেবে তিনটি পেশা অধিক সম্মানের। শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা এবং রাজনীতি। সে হিসেবে আমরা যারা সংবাদ মাধ্যমে কাজ করি তারা দ্বিতীয় সারিতে আছি। পেশাদারিত্বের দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা আমাদের যাপিত জীবন নিয়ে আমার স্বল্প অভিজ্ঞতার আলোকে দুয়েকটি কথা বলছি। বিশেষত আমরা যারা মফস্বলে কাজ করছি, মফস্বল সাংবাদিক হিসাবে তাদেরকে নিয়েই এই লেখা।

মফস্বল সাংবাদিকদের কাজের প্রধান অন্তরায় হলো, যোগাযোগ ব্যবস্থা। অনুন্নত যোগযোগ ব্যবস্থার কারণে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সংবাদ সংগ্রহ করতে দীর্ঘ সময় ব্যয় হয় এবং সময়মতো সংবাদ প্রেরণ না করতে পারলে সে সংবাদ যথা সময়ে প্রকাশিতও হয় না। নির্ধারিত সময়ের পরে সংবাদ প্রকাশিত হলে সে সংবাদের তেমন কোনো গুরুত্ব থাকে না। সে ক্ষেত্রে গণমাধ্যম সংস্থা বা পত্রিকা কর্তৃপক্ষের উচিত হবে, সংবাদকর্মীদের জন্য নিজস্ব পরিবহনের ব্যবস্থা করে দেয়া। পরিতাপের বিষয় হলো, যেখানে অধিকাংশ পত্রিকার সংবাদ কর্মীদের কোনো প্রকার বেতনই দেয়া হয় না, সেখানে পরিবহনের ব্যবস্থা কি করে করবে? পরিবহনের যথাযথ ব্যবস্থা না থাকায় সংবাদ সংগ্রহ করতে রাত অবদি সময় লেগে যায়। ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে গ্রামের পর গ্রাম, কখনোবা পায়ে হেঁটে দূর্গম পথ পাড়ি দিয়ে জীবনের ঝুকি নিয়েই আমাদেরকে কাজ করতে হয়।

পেশা হিসেবে তিনটি পেশা অধিক সম্মানের। শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা এবং রাজনীতি। সে হিসেবে আমরা যারা সংবাদ মাধ্যমে কাজ করি তারা দ্বিতীয় সারিতে আছি। পেশাদারিত্বের দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা আমাদের যাপিত জীবন নিয়ে আমার স্বল্প অভিজ্ঞতার আলোকে দুয়েকটি কথা বলছি।

মহৎ পেশায় সম্পৃক্ত থেকে আমরা সৎভাবেই জীবন যাপনের কথা চিন্তা করে থাকি। কিন্তু ভেবে দেখা উচিত, সৎভাবে জীবন পরিচালনা করার অবলম্বন আমাদের আছে কি না। সাংবাদিককে জাতির দর্পণ বলা হয়। জাতির দর্পণকে কতটা মূল্যায়ণ করছে জাতি সেটি সময়ের প্রশ্ন।

জীবিকা নির্বাহের জন্য আমরা পছন্দসই পেশাকে বেছে নেই। তাবৎ দুনিয়ার পেশাদারী লোকেরা পারিশ্রমিকের বিনিময়েই কাজ করে থাকেন। প্রশ্ন হলো, আমরা আমাদের কাজের বিনিময়ে কী পাই? আমাদের দেশের পত্রিকাগুলো অধিকাংশই সাংবাদিকদের কোনো বেতন দেয় না। যেগুলো দেয় তাও পর্যাপ্ত নয়, যৎসামান্য পারিশ্রমিকি দিয়ে একটি পরিবার চলতে পারে না। আবার সম্পাদকের কড়া নির্দেশ, সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে কোনো টাকা বা বিনিময় নিতে পারবেন না। মানলাম, সেটা আমাদের দায়িত্ব, বিনিময় নেব না। কিন্তু আপনারওতো ভেবে দেখা উচিত, আমার জীবনমান কোথায় গিয়ে ঠেকেছে! কীভাবে চলে আমার সংসার?

বলা হয়ে থাকে কিংবা কোনো কোনো পত্রিকার টার্গেট থাকে- ন্যুনতম তিন মাসে একটি বিজ্ঞাপন দিতে হবে অবশ্যই। সেটাও জানি যে, পত্রিকাগুলো অনেকাংশে বিজ্ঞাপননির্ভর। কিন্তু একবার ভাবুন তো, একটা উপজেলায় সরকারি সেক্টরে কয়টি অফিস আছে? আর বছরে সেখান থেকে কয়টি বিজ্ঞাপন হয়ে থাকে? মফস্বলে বেসরকারি বা ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন খুবই নগণ্য। একটা উপজেলায় ন্যুনতম দশ থেকে পনেরটি জাতীয় দৈনিকের কার্যক্রম রয়েছে। প্রতিটি দৈনিকের প্রতিনিধিই বিজ্ঞাপন সংগ্রহের চেষ্টা করে থাকেন। কারণ বিজ্ঞাপন দিতে পারলে সেখান থেকে কিছু কমিশন পত্রিকা কর্তৃপক্ষ প্রতিনিধিকে দিয়ে থাকে এবং এই কমিশনই একজন প্রতিনিধির পারিশ্রমিক বা সম্মানী। একটা উপজেলা থেকে বছরে কতটি বিজ্ঞাপন হয়ে থাকে তার সঠিক পরিসংখ্যান হয়তো আমি দিতে পারব না। তবে এটুকু জোর দিয়ে বলতে পারি, পত্রিকার চাহিদানুযায়ী যথেষ্ট নয়।

জীবিকা নির্বাহের জন্য আমরা পছন্দসই পেশাকে বেছে নেই। তাবৎ দুনিয়ার পেশাদারী লোকেরা পারিশ্রমিকের বিনিময়েই কাজ করে থাকেন। প্রশ্ন হলো, আমরা আমাদের কাজের বিনিময়ে কী পাই? আমাদের দেশের পত্রিকাগুলো অধিকাংশই সাংবাদিকদের কোনো বেতন দেয় না।

জীবনকে আমরা সবাই ভালোবাসি, ভালোবাসি পরিবার পরিজনকে। নিজ এবং পরিবারের জন্য কী করতে পারি আমরা? আমাদের চারপাশে দৈনন্দিন ঘটে যাওয়া সহস্র ঘটনা প্রবাহ থেকে সংবাদ সংগ্রহ করে থাকি। সঠিক ও বস্তুনিষ্ট সংবাদ পরিবেশনের ফলে আমাদেরকে অনেকের চক্ষুশুল হতে হয়। হুমকিধামকি উপেক্ষা করেই আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করি। এর বিনিময়ে ক্ষেত্রবিশেষে হয় আমাদেরকে এই দুনিয়ার মোহ-মায়া পরিত্যাগ করতে হয়, নতুবা সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করে মানবেতর জীবন যাপন করে ধুকে ধুকে মরতে হয়।

এতে কী পায় আমাদের পরিবার পরিজন? কয়েকটি পত্রিকার শিরোনাম, কিছু সমালোচনা, টকশোতে কিছু তর্ক-বিতর্ক; এরপর সবাই বেমালুম ভুলে যান। যে পত্রিকা বা গণমাধ্যমের জন্য কাজ করে সব হারালাম, একদিন তারা আমার নামটাও মনে রাখবে না। অন্ধের যষ্ঠি হারিয়ে পরিবারের সবাই শোকতাপ আর মাতমকে পুঁজি করে বয়ে বেড়াবে সারাজীবন। এই হলো আমাদের পাওয়া। কখনো ভেবে দেখেছেন কি?

আবুল খায়ের আনছারী : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

khairansari0@gmail.com

ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম

ট্যাগ:

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply