শুক্রবার বিকাল ৫:৫২, ৩রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ১৭ই মে, ২০২৪ ইং

বিশ্বাসের অন্ধ বিশ্বাস ও ধর্মান্ধ মৌলবাদ

সমাপ্তি চক্রবর্তী

অন্ধ বিশ্বাস থেকে মুক্ত হওয়া খুবই কঠিন। এই কঠিন কাজটি যে করতে পারে, কেবল সেই পারে বাস্তবতা ও বিশ্বাসকে আলিঙ্গন করতে। অন্ধ বিশ্বাস না থাকলে সরাসরি আমরা নিজের দিকে তাকাতে পারি এবং নিজেকে জানতে ও ভালোবাসতে শুরু করি। যেখানে অন্ধ বিশ্বাস আছে, সেখানে অস্বচ্ছতা তো অবশ্যই আছে। আয়নাতে ময়লা থাকলে যেমন চেহারা স্পষ্ট দেখা যায় না, তেমনি মনে অন্ধ বিশ্বাস থাকলে নিজেকে এবং কোনোকিছুকেই স্পষ্ট দেখা যায় না।

বাস্তব জীবনে বিশ্বাস অপরিহার্য। অথচ বিশ্বাসের কথা উঠলেই ধর্মীয় প্রসঙ্গ চলে আসে। ভাবটা এমন, যেন বিশ্বাস শুধুই একটা ধর্মীয় ব্যাপার। আর ধর্ম যেন জীবন থেকে পৃথক কিছু। ভাববার বিষয়, যে ব্যক্তি বাস্তবে বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই না করে এক কেজি আলুও কিনে না, সে কেমন করে ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়ে বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই না করেই বিশ্বাস করে? ধর্মীয় বিশ্বাসেরই যদি বিশ্বাসযোগ্যতা না থাকে, তবে ধর্মজীবনে সততা আসবে কোত্থেকে? অধিকাংশের ধর্ম বিশ্বাসই অন্ধ।

যে ব্যক্তি বিশ্বাসকে বিচার-বিবেচনা ও বুদ্ধি দিয়ে গ্রহণ করতে পারে না, সে নিজেকে বিশ্বাসীর স্তরে উন্নীত করতে কোনো পদক্ষেপও নিতে পারে না। বিচার-বিবেচনা না করেই যদি কেউ ধরে নেয় যে সাঁকোটি ওজন বহন করতে পারবে, তবে বুঝতে হবে সাঁকোটি ব্যবহার করে ওপাড়ে যাবার আগ্রহ তার নেই। না দেখে, না বুঝে, যাচাই না করে অন্ধের মতো কোনোকিছু বিশ্বাস করাকে বলা হয় অন্ধ বিশ্বাস। ধর্ম সম্বন্ধে যার অন্ধ বিশ্বাস থাকে, তাকে বলা হয় ধর্মান্ধ। প্রচণ্ড রক্ষণশীলতা ও পক্ষপাতিত্বের আতিশায্য ধর্মান্ধতার প্রধান লক্ষণ। ধর্মান্ধ কোনো যুক্তি গ্রহণ করে না। সে যতটুকু জানে ততটুকুকেই চূড়ান্ত মনে করে এবং যারা তার সঙ্গে একমত নয়, তাদেরকে মূর্খ ও ধর্মবিরোধী আখ্যা দেয়।

ধর্মান্ধ ব্যক্তি যা দেখে, বুঝে, করে তা বিশ্বাস করে না। বরং সে যা বিশ্বাস করে তা-ই দেখে, তা-ই বুঝে, তাই করে। অন্ধ ধর্মবিশ্বাসের উৎপত্তি হয় পরিবেশ, সমাজ ও পারিবারিক প্রভাব থেকে। জন্মের পর থেকেই নানা রকমের আনুষ্ঠানিকতা দেখা-শোনা এবং না বুঝে পালন করার মাধ্যমে এগুলো ছাপ ফেলে অবচেতন মনে।

যারা তার মতো ধর্মাচার করে না, তাদেরকে সে শত্রু ভাবতে শুরু করে। নিজস্ব সাম্প্রদায়িক গোত্র ব্যতীত অন্য কোনো উৎস থেকে জ্ঞান আহরণ করাকে সে মহাপাপ মনে করে। তার চিন্তাজগতে ভিন্নমতাবলম্বীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। সংকীর্ণতার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে সে ভিন্ন ধর্ম, বর্ণ ও জাতির প্রতি অসহনশীল ও বিদ্বেষপরায়ণ হয়ে উঠে; সুযোগ পেলেই অন্য ধর্মকে কটাক্ষ করে কথা বলে, অন্য ধর্মের নবি-রাসুল, অবতার ও সাধকদের ব্যাপারে অশ্লীল বাক্য ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ায়।

ধর্মান্ধ ব্যক্তি যা দেখে, বুঝে, করে তা বিশ্বাস করে না। বরং সে যা বিশ্বাস করে তা-ই দেখে, তা-ই বুঝে, তাই করে। অন্ধ ধর্মবিশ্বাসের উৎপত্তি হয় পরিবেশ, সমাজ ও পারিবারিক প্রভাব থেকে। জন্মের পর থেকেই নানা রকমের আনুষ্ঠানিকতা দেখা-শোনা এবং না বুঝে পালন করার মাধ্যমে এগুলো ছাপ ফেলে অবচেতন মনে। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র তাদের বিশ্বাসগুলো সন্তানের উপর চাপিয়ে দেওয়া পবিত্র দায়িত্ব মনে করে। তাই যেভাবে খানের সন্তান খান হয়, সেভাবেই মুসলমানের সন্তান মুসলমান, হিন্দুর সন্তান হিন্দু, পীরের জাদা পীরজাদা, নবাবের জাদা নবাবজাদা, সাহেবের জাদা সাহেবজাদা হয়।

অন্ধ বিশ্বাসের প্রভাবে ক্রমান্বয়ে অন্তকরণ কুলুপ আঁটা হয়ে যায়। অবচেতন স্তর থেকে এসব বিশ্বাসই ব্যক্তির কর্ম ও আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। অন্ধ বিশ্বাসের একটি বড় কারণ- ভয়। যেখানে অজানার ভয় আছে কিন্তু জানার আগ্রহ নেই, সেখানেই আশ্রয় নেয় অন্ধত্ব। লালসাপূর্ণ জীবনের যাতনাকে অস্বীকার করার জন্যও কেউ কেউ আশ্রয় নেয় অন্ধ বিশ্বাসের। ধর্মান্ধতা আরো বিপজ্জনক হয়ে উঠে, যখন তাদেরকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয়। তখন সেটা একধরনের মৌলবাদী রূপ ধারণ করে। যুগে যুগে তা-ই হয়েছে; রাজনীতিকরা ধর্মান্ধদের ব্যবহার করে বারবার থামিয়ে দিয়েছে প্রগতি। ফ্ল্যাভি ভাইরাসের মতো ধর্মান্ধ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীর দেশে দেশে। খুবই মারাত্মক ভাইরাস এটি।

ধর্মান্ধতা আরো বিপজ্জনক হয়ে উঠে, যখন তাদেরকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয়। তখন সেটা একধরনের মৌলবাদী রূপ ধারণ করে। যুগে যুগে তা-ই হয়েছে; রাজনীতিকরা ধর্মান্ধদের ব্যবহার করে বারবার থামিয়ে দিয়েছে প্রগতি। ফ্ল্যাভি ভাইরাসের মতো ধর্মান্ধ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীর দেশে দেশে।

ধর্মান্ধ ভাইরাসের সংক্রমণে মস্তিষ্ক পচে যায়। ফলে ধর্মের নামে মানুষকে হত্যা করাও পবিত্র দায়িত্ব মনে করে জঙ্গি ধর্মান্ধরা। ধর্মান্ধরা নিজের বিশ্বাসকে অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে বল প্রয়োগ করতে দুইবার ভাবে না। একটি মাত্র বিশ্বকে নানা দেশে, নানা দল-উপদলে, নানা ধর্মে, নানা জাতিতে, নানা আদর্শে বিভক্ত করেছে অন্ধ বিশ্বাস। অন্ধ বিশ্বাস আফিমের মতো, এক ধরনের আসক্তি তৈরি করে। অন্ধ বিশ্বাস ব্যক্তির অর্জন নয়। যা নিজের অর্জন নয়, তা পরের। পরের ধনে পোদ্দারি করা মানে, অপরের সর্বনাশ করা। ধর্মান্ধরা সব ধরনের আকাম-কুকাম করে, কিন্তু তারা তা করে ‘দলিলের’ অপব্যাখ্যা দিয়ে। অন্ধ মন পূর্ণ থাকে দলিলে। যে মন দলিলে পূর্ণ হয়ে যায়, তা হারিয়ে ফেলে চিন্তা করার ক্ষমতা। তারা নিজের অজান্তেই পরিণত হয় আত্মপ্রতারকে।

নানা রকম কল্পকাহিনী তাদের দৃষ্টিকে ধোঁয়াচ্ছন্ন করে রাখে। অন্ধ বিশ্বাসীরা বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে অক্ষম হয়ে উঠে। এরা জর্জরিত হতে থাকে অসংখ্য কুসংস্কারে। এটি এমন একটা অন্ধকার কারাগার তৈরি করে, যেখানে সত্যের আলো প্রবেশের জন্য একটা জানালাও উন্মুক্ত থাকে না। সত্যানুসন্ধানের জন্য প্রয়োজন তদন্ত, তলব, অন্বেষণ, অবিরাম নিরীক্ষণ, গবেষণা এবং প্রয়োজনীয় সকল সম্ভাবনাগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা।

অন্ধ বিশ্বাস থেকে মুক্ত হওয়া খুবই কঠিন। এই কঠিন কাজটি যে করতে পারে, কেবল সেই পারে বাস্তবতা ও বিশ্বাসকে আলিঙ্গন করতে। অন্ধ বিশ্বাস না থাকলে সরাসরি আমরা নিজের দিকে তাকাতে পারি এবং নিজেকে জানতে ও ভালোবাসতে শুরু করি। যেখানে অন্ধ বিশ্বাস আছে, সেখানে অস্বচ্ছতা তো অবশ্যই আছে। আয়নাতে ময়লা থাকলে যেমন চেহারা স্পষ্ট দেখা যায় না, তেমনি মনে অন্ধ বিশ্বাস থাকলে নিজেকে এবং কোনোকিছুকেই স্পষ্ট দেখা যায় না। সব ধরনের অন্ধতা থেকে মুক্ত হলে মনে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, সত্যের ঝলকে সে শূন্যতাই লাভ করে পূর্ণতা।

সমাপ্তি চক্রবর্তী : কলকাতা ইউনিভার্সিটি

ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম

ট্যাগ:

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply