সোমবার রাত ৪:৩৯, ১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং

বাংলাদেশে রাজনীতি-সংকট : বিলুপ্তির পথে গণতন্ত্র

জাকির মাহদিন

হাজারো সমস্যায় এখন জর্জরিত বাংলাদেশ। বিচারব্যবস্থা সরকারের সরাসরি ইচ্ছাধীন। শিক্ষাব্যবস্থা এখন সবচেয়ে লাভজনক, রাজনীতিতে জঘন্য ব্যক্তিদের আগমন, তৃণমূল উন্নয়ন ভেঙ্গে পড়েছে। একদিকে নির্দিষ্ট কিছু মানুষের অর্থ-সম্পদ ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে প্রান্তিক পর্যায়ের কোটি কোটি মানুষ মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত।

গাছের পরিচয় ফলে। আর একটি রাষ্ট্রের পরিচয় তার শাসনব্যবস্থায়, নাগরিক অধিকারে, বিচারব্যবস্থার স্বচ্চতা-নিরপেক্ষতায়, শিক্ষাব্যবস্থায় মনুষ্যত্বের চর্চায় এবং সর্বক্ষেত্রে সরকারের জবাবদিহিতায়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ বিশ্বমানচিত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য দেখালেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও প্রেসিডেন্ট জিয়া হত্যার পর রাষ্ট্রটি খুব দ্রুতই রাজনৈতিক সংকটে নিপতিত হয়। যার ভিত্তি গড়ে ওঠে স্বৈরাচার এরশাদের শাসনকালে। ধীরে ধীরে তা প্রকাশ্য রূপ পায়। একে একে ‘পুরুষগণ’ ব্যর্থ হলে জনগণ নারীশাসনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। কিন্তু সেই ঝুঁকে পড়াটা এখন রাজনৈতিক সংকট থেকে ‘রাজনীতি-সংকটে’ পরিণত এবং এ রাজনীতি-সংকট ক্রমেই গণতন্ত্র-সংকটে উপনীত হয়েছে।

বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে এখন কোনো রাজনৈতিক বা গণতন্ত্র চর্চাকারী দল নেই। প্রচুর ইস্যু থাকা সত্ত্বেও অনেক বছর ধরে কোনো গণতান্ত্রিক কর্মসূচি নেই।  হরতাল-ভাংচুর-অবরোধ, বিশৃঙ্খলা-গোলযোগ- এসব তো কোনো গণনৈতিক কর্মসূচি নয়ই, এমনকি বর্তমান সময়ের বিশাল বিশাল সমাবেশগুলোও কোনো গণনৈতিক কর্মসূচি না। সঠিক চিত্র তুলে ধরতে গেলে বলতে হয়, মওলানা ভাসানী, আকরম খাঁ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীনদের পর বাংলাদেশে গণনীতিচর্চাটা আর সামনে এগোয়নি, ক্রমাগত পেছনেই গিয়েছে।

এ দেশে গত কয়েকটি ‘নির্বাচনী মৌসুমে’ ভূঁইফোর রাজনৈতিক দলের বাম্পার ফলন হলেও সেগুলো এত মৃতপ্রায় যে শেষ পর্যন্ত প্রচুর ফরমালিন দিয়েও বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী নাজমুল হুদা একাই গড়েছেন প্রায় ডজনখানেক দল। দেশে এত দল যে দু’চারজন নেতা-পাতিনেতা একটেবিলে বসতে পারলে খুব সহজেই একটি ঐক্যজোট বা মহাজোট হয়ে যায়। জাতীয় পার্টি, ইসলামি ও বাম দলগুলো বিয়ে ছাড়াই এত বংশবিস্তার করেছে যে সরকারের তরফ থেকে ‘দলশুমারি’ না হলে তাদের সংখ্যা নির্ধারণ কঠিন।

শাসকগোষ্ঠী পরিস্থিতি না শামাল দিতে পারছে, না ক্ষমতা ছাড়তে পারছে। মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের নির্যাতন, মানবিক বিপর্যয় এবং বাংলাদেশের প্রতি অন্যায় আচরণ ও মিথ্যাচার বন্ধে কেউ কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি সেই আগের বুলিই আওড়াচ্ছে যা ক্রমাগত জাতিকে সমস্যায় ফেলছে। যা বললে যা করলে দলগুলো ও নেতাগণ দীর্ঘমেয়াদি পর্যায়ে কাছাকাছি আসতে পারেন, বসতে পারেন এমন কিছুর নামগন্ধও নেই।

এদিকে দেশের প্রধান ও বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলো বর্তমানে এতটাই জ্ঞান-গুণহীন যে এসবের নামোল্লেখ করে আলাদাভাবে কিছু লেখার প্রয়োজন আছে বলে হয় না। দলগুলোর দায়িত্বশীলরা প্রতিদিন মিডিয়ায় এত জ্ঞান বিতরণ করছেন, আর মিডিয়াও তা সরবরাহ করছে যে মানুষ শুনতে শুনতে সম্পূর্ণ ক্লান্ত। জাতি এখন কিছুটা বিশ্রাম চায়। অথচ তথাকথিত মিডিয়া বা ‘গণমাধ্যমগুলো’ এদের জন্য একপায়ে খাড়া। এরা যাই বলুক, এদের চেহারা দেখানো বা মুখের কথা ‘কোট’ করা ছাড়া মিডিয়া অচল। এমনটাই দেখে ও শিখে এসেছেন আমাদের ‘মেধাবী ও সৃষ্টিশীল’ সাংবাদিকগণ।

কেন এ অধঃপতন? বিগত পাঁচশত বছরের ইতিহাসে বাঙালি দুর্বল, ভীরু, মেধাহীন- এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে কেন এই ২০১৮ সালে এ অবস্থা? এর প্রধানতম কারণ, শুধু অতীত নিয়ে গর্ব করতে করতে এরা বর্তমানের বারোটা বাজিয়েছে। এখন শাসকগোষ্ঠী পরিস্থিতি না শামাল দিতে পারছে, না ক্ষমতা ছাড়তে পারছে। মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের নির্যাতন, মানবিক বিপর্যয় এবং বাংলাদেশের প্রতি অন্যায় আচরণ ও মিথ্যাচার বন্ধে কেউ কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি সেই আগের বুলিই আওড়াচ্ছে যা ক্রমাগত জাতিকে সমস্যায় ফেলছে।

বিয়ে করেই হোক আর পরকীয়া করেই হোক, সম্প্রতি জন্ম নেয়া রাজনৈতিক আরেক শিশু- নাম রাখা হয়েছে ‘যুক্তফ্রন্ট’, পরে জাতীয় এক্যফ্রন্ট। শিশুর পিতৃত্বের দায় চাপছে ড. কামাল নামের এক বৃদ্ধের উপর। প্রচুর সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে এ শিশুদল বা কথিত জোটকে নিয়ে। নির্বাচনের মাত্র অল্প ক’দিন বাকি। জনগণের সঙ্গে তাদের সরাসরি কোনো যোগাযোগ বা বোঝাপড়া নেই।

যা বললে ও যা করলে দলগুলো এবং নেতাগণ দীর্ঘমেয়াদি পর্যায়ে কাছাকাছি আসতে পারেন, বসতে পারেন এমন কিছুর নামগন্ধও নেই। বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বসাবসি এবং শলাপরামর্শের জায়গাটুকুও নেই। কারণ সবাই নিজেকে যোগ্য মনে করছে, যা মূর্খতার সর্বোচ্চ প্রমাণ। সবাই নিজ নিজ ভালো ও সাফল্যটাই দেখছে। তাই প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে, আওয়ামী লীগ কখনো ক্ষমতা ছাড়তে চাইলেও কার হাতে ছাড়বে? কে এর যোগ্য? তারচেয়ে ভালো তো তারাই চালাচ্ছে?

বিয়ে করেই হোক আর পরকীয়া করেই হোক, সম্প্রতি জন্ম নেয়া রাজনৈতিক আরেক শিশু- নাম রাখা হয়েছে ‘যুক্তফ্রন্ট’, পরে জাতীয় এক্যফ্রন্ট। শিশুর পিতৃত্বের দায় চাপছে ড. কামাল নামের এক বৃদ্ধের উপর। প্রচুর সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে এ শিশুদল বা কথিত জোটকে নিয়ে। নির্বাচনের মাত্র অল্প ক’দিন বাকি। জনগণের সঙ্গে তাদের সরাসরি কোনো যোগাযোগ বা বোঝাপড়া নেই। যদিও বৃহত্তর দল বিএপির সঙ্গে তথাকথিত ঐক্য করেছে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি কোনো বোঝাপড়া বা পরিকল্পনার ধারেকাছেও এরা নেই। বরং এদের ভর করে নির্বাচনকে ‘ফেয়ার’ দেখাতে পারবে আওয়ামী লীগ। এরা নির্বাচন বন্ধও করতে পারবে না, পেছাতেও পারবে না।

হাজারো সমস্যায় এখন জর্জরিত বাংলাদেশ। বিচারব্যবস্থা এখন সরকারের সরাসরি ইচ্ছাধীন। শিক্ষাব্যবস্থা এখন সবচেয়ে লাভজনক, রাজনীতিতে জঘন্য ব্যক্তিদের আগমন, তৃণমূলের উন্নয়ন ভেঙ্গে পড়েছে। একদিকে নির্দিষ্ট কিছু মানুষের অর্থ-সম্পদ ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে প্রান্তিক পর্যায়ের কোটি কোটি মানুষ মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত। আবার যাদের প্রচুর অর্থ-সম্পদ হচ্ছে, তারাও পারিবারিক ও মানসিক পর্যায়ে চরম অস্থিরতা এবং অশান্তিতে ভোগছেন। কারণ সম্পদের তুলনায় তাদের চাহিদা দ্বিগুণ-তিনগুণ। তারা মানুষের ও মনুষ্যত্বের মৌলিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত।

মানুষ এখন বেঁচে থাকছে সরকারকে ট্যাক্স দেবার জন্য, বিভিন্ন ধরনের ঋণ পরিশোধের জন্য, মনুষ্যত্ব বিক্রি করে দুবেলা দুমুঠো খাবারের জন্য। সুস্থ ও স্বাভাবিক কোনো মানুষের জীবন যাপন করা বাংলাদেশে এখন আর সম্ভব নয়। গত প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে  জন্ম নেয়া প্রতিদিনের হাজারো শিশুসন্তান এখন না এ দেশে ঠাই পাচ্ছে, না অন্যকোনো দেশে। দিন দিন পৃথিবী যেন আমাদের কাছে নরকের চেয়ে ভয়ঙ্কর ঠেকছে।

জাকির মাহদিন : লেখক, কলামিস্ট

zakirmhdin@yahoo.com

ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম,  সম্পাদকের কলাম

ট্যাগ:

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply