শুক্রবার রাত ১:৪৮, ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২রা মে, ২০২৪ ইং

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা মানুষ না অমানুষ বানাচ্ছে?

দেলোয়ার হুসাইন

একটি শিশুর প্রথম শিক্ষক তার মা। অথচ সেই মা ছোটবেলা থেকেই তাকে মোবাইল, টেলিভিশন ইত্যাদিতে আসক্ত করছে। সন্তানকে যতটুকু সময় দেওয়ার কথা ততটুকু দিচ্ছে না। নিজেকে ব্যস্ত রাখছে অন্যকাজে, টিভি সিরিয়াল, ফেইসবুক ইত্যাদিতে।

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। আর আমরা মেরুদণ্ডহীন জাতি। শিক্ষা বলতে এখানে সঠিক বা সুশিক্ষার কথা বলা হয়েছে। সুশিক্ষার অভাবে আমরা মেরুদণ্ডহীন জাতি। শিক্ষা বলতে আমরা শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেই বুঝি। অথচ প্রকৃত শিক্ষার অনেক বড় একটি অংশই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে, সমাজ, পরিবেশ, বাস্তবতা ও বিবেক-বুদ্ধি থেকে গ্রহণ করতে হয়।

সুশিক্ষা ও সঠিক বুঝের অভাবে বর্তমান প্রজন্মটা এমন যে, ফেইসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামে অন্যরা যা করছে, ভালো-মন্দ বিবেচনা না করেই আমরাও সেইটাকেই ট্রেন্ড বানিয়ে নিচ্ছি, সেটাই ফলো করছি। চিন্তাশক্তি ও বিবেক-বুদ্ধি হারিয়ে এমন একটি জাতিতে পরিণত হয়েছি যে আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন। এই অন্ধকার কাটিয়ে আলোতে ফিরে আসতে প্রয়োজন সুশিক্ষা বা প্রকৃত শিক্ষা।

এই সমাজে একটি কথা শোনা যায়- ভালোভাবে পড়াশোনা করে ‘মানুষ’ হতে হবে। আমার প্রশ্ন, এরা কি তাহলে ‘অমানুষ’ হয়ে জন্মগ্রহণ করেছে? অন্যদিকে বর্তমান প্রাতিষ্ঠানিক অসুস্থ্য শিক্ষার মাধ্যমে আমরা কি মানুষ বানাচ্ছি, না অমানুষ বানাচ্ছি?

আরো পড়ুন> স্রোতের বিপরীত ভাবনা: পুনর্জন্ম

যে শিক্ষা ‘ভালো’ সার্টিফিকেট, ‘ভালো’ চাকুরি (চাকর হওয়া) ও মানুষের কাছে ‘শিক্ষিত’ বলে অহংকার করার জন্য, সেই শিক্ষা কখনোই জাতির মেরুদণ্ড হতে পারে না। বরং সেই শিক্ষা জাতির জন্য ক্যান্সারের চেয়েও ভয়ংকর একটি রোগ। আর এই রোগ এখন ছড়িয়ে পড়েছে সমাজের সর্বস্তরে। দিন দিন শিক্ষিতদের (অসুস্থ্য শিক্ষা) হার বাড়ার পরও আমরা আজ কেন নানারকম সমস্যায় হাবুডুবু খাচ্ছি? কখনো কি ভেবেছেন, সমস্যাগুলোর উৎস্য কী? বেশিরভাগ সমস্যার উৎস্য হচ্ছে সঠিক শিক্ষার অভাব। আর সঠিক শিক্ষাটা পাবেইবা কোথায় ও কীভাবে?

একটি শিশুর প্রথম শিক্ষক তার মা। অথচ সেই মা ছোটবেলা থেকেই তাকে মোবাইল, টেলিভিশন ইত্যাদিতে আসক্ত করছে। সন্তানকে যতটুকু সময় দেওয়ার কথা ততটুকু দিচ্ছে না। নিজেকে ব্যস্ত রাখছে অন্যকাজে, টিভি সিরিয়াল, ফেইসবুক ইত্যাদিতে। যখন সে শিখতে শুরু করে তখন থেকেই প্রাইভেট টিউটর, কাজের বুয়া, মোবাইলে কার্টুন, ডিসুম ডিসুম ইত্যাদিতে সময় পার করছে।

বর্তমান প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পরিবেশটাই এমন যে মনুষ্যত্ব ও মানবিকতা শিক্ষার পরিবর্তে সেখানে অসুস্থ প্রতিযোগিতা, স্বার্থের নেশা, ভোগের আকাঙ্ক্ষা, চারপাশকে নিচে রেখে নিজেকে একটা ‘উচ্চশ্রেণিতে’ নিয়ে যাওয়ার তীব্র বাসনার শিক্ষা লাভ হয়।

একটি শিশু যখন তার মায়ের কাছে বসে “অ, আ, ই, A, B, C” শিখবে, তখন সে এই অক্ষরগুলোর পাশাপাশি মায়ের স্নেহ ও ভালোবাসাও উপলব্ধি করতে পারবে এবং তা থেকে তার মধ্যে মানুষের প্রতি ভালোবাসা, মায়া-মহব্বত জন্মাবে। আর যখন সে প্রাইভেট টিউটর, কাজের বুয়া ও মোবাইল থেকে শিখবে তখন সে “অ, আ, ই, A, B, C” শিখবে ঠিকই, কিন্তু মানুষের প্রতি ভালোবাসা, মায়া-মহব্বতের অভাব রয়ে যাবে। যখন সন্তান একটু বড়ো হয় তখন শুরু হয় আরেক প্রতিযোগিতা। ভালো স্কুলে এডমিশন নিতে হবে, ভালো রেজাল্ট করতে হবে, অমুকের চাইতে ভালো করতে হবে ইত্যাদি। আর তখন থেকেই শুরু হয়ে যায় সুশিক্ষাকে পাশ কাটিয়ে কুশিক্ষার গুরুত্ব।

এদিকে বর্তমান প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পরিবেশটাই এমন যে মনুষ্যত্ব ও মানবিকতা শিক্ষার পরিবর্তে সেখানে অসুস্থ প্রতিযোগিতা, স্বার্থের নেশা, ভোগের আকাঙ্ক্ষা, চারপাশকে নিচে রেখে নিজেকে একটা ‘উচ্চশ্রেণিতে’ নিয়ে যাওয়ার তীব্র বাসনার শিক্ষা লাভ হয়। তাই এমন ঘটনা অহরহ ঘঠছে যে শুধু ভালো রেজাল্ট না করার কারণেই আত্মহত্যা করছে।

আমার খুব পরিচিতি একজন (স্বা মী স্ত্রী ২ জনই স্কুলের শিক্ষক), উনার ছেলে A+ না পাওয়াই উনি কান্না করেছে। মনে হয় জীবনের কোনো মানেই থাকবে না যদি ভালো একটা সার্টিফিকেট অর্জন না করা যায়। আমি বলছি না যে A+ বা ভালো সার্টিফিকেটের কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য হতে হবে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর ভেতরের সুপ্ত মনুষ্যত্বের সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটানো, ত্যাগের দৃষ্টিভঙ্গি গঠন, মানসিকতার উন্নয়ন ও মানবিকতার চর্চা। আমার জানামতে স্বল্পসংখ্যক মানুষ এমন চেষ্টা করছেন।

লেখক: দেলোয়ার হুসাইন

চেয়ারম্যান: অপটিমাম আইটি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

ক্যাটাগরি: মিনি কলাম

ট্যাগ: দেলোয়ার হুসাইন

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply