শুক্রবার সকাল ১১:৪৯, ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ৩রা মে, ২০২৪ ইং

পাটকল ব‌ন্ধ: সময়ের অনিবার্য পরিণতি

মহিবুল ইসলাম

“‘সরকারি মাল দরিয়ামে ঢাল!’ যার অনিবার্য ফল হিসাবে লোকসান অবধারিত হয়ে ওঠে। আদমজী যখন ডুবছিল; একটার পর একটা ইউনিট বন্ধ হচ্ছিল তখনো সিবিএ নেতাদের দাপিয়ে বেড়ানো এবং বড় বড় কর্তাদের পাজেরো হাঁকানো ঠিকই চলছিল।”

কেবল পাটকলই নয়; সরকারি খাতের অধিকাংশ শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই এখন রাষ্ট্রের জন্য গলার কাঁটা! এ এক কঠিন বাস্তবতা। চোখের সামনে দেখি, গ্রামীনফোন লাভ করলেও টেলিটক লোকসান দেয়। গ্রামীণফোনের গ্রাহকসেবা আর টেলিটকের গ্রাহকসেবার পার্থক্য রাতদিন। গ্রামীণফোনের গ্রাহক বাড়ে, টেলিটকের কমে। কুরিয়ার সার্ভিসগুলো ছোট ছোট রুমে ব্যস্ত সময় কাটায়, আর ডাক বিভাগের লোকজন আলিশান স্থাপনায় বসে বসে ঝিমোয়। রেলওয়ে ও বিআরটিসি বছরের পর বছর লস দিয়ে যায়, আর প্রাইভেট বাস কোম্পানিগুলো ঝলমলে হয়ে ওঠে দিনে দিনে। বিশ্বে নতুন করে পাটের চাহিদা তৈরি হওয়ায় বেসরকারি পাটকলগুলোও ধীরে ধীরে ভালো করছে; কিন্তু কোনোমতেই পারছে না সরকারিগুলো!

সময়ে সময়ে মানুষের মনস্তত্ত্বের উপর অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। আমি নিজে প্রাইভেট সেক্টরে কাজ করেছি প্রায় চার বছর। যে ছেলেটিকে সেখানে দেখেছি সকাল-সন্ধ্যায় শরীর নিংড়ে সবটুকু দিয়ে ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্নে বিভোর, চোখে মুখে সদা উদ্দীপ্ত ভঙ্গি; সেই ছেলেটিই যখন সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা হয়ে যায়, তখন তার মধ্যে অন্যরকম ভাব দেখি। আগের সেই সবটুকু দেওয়ার মনোভঙ্গিটা উধাও হয়ে যায়। দেওয়ার চেয়ে নেওয়ার ভাব ও সমীকরণটাই দিনে দিনে প্রকট হয়ে ওঠে তার মনে-মগজে। মালিক যদি সরকার হয় তবে সেই প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক কিংবা কর্মকর্তা তথা সিবিএ কিংবা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সকলের মাঝেই সেই একই প্রবণতা; ‘সরকারি মাল দরিয়ামে ঢাল!’ যার অনিবার্য ফল হিসাবে লোকসান অবধারিত হয়ে ওঠে।

আদমজী যখন ডুবছিল; একটার পর একটা ইউনিট বন্ধ হচ্ছিল তখনো সিবিএ নেতাদের দাপিয়ে বেড়ানো এবং বড় বড় কর্তাদের পাজেরো হাঁকানো ঠিকই চলছিল। নিজের শ্রমঘণ্টার কতটা সময় নিজেকে নিংড়ে অফিসের জন্য, কারখানার জন্য দিলেন সেই হিসাবের চেয়ে কতটা সুবিধা পেলেন বা পেলেন না সেই হিসাব নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকেন প্রায় সবাই। অধিকাংশ সরকারি প্রতিষ্ঠানে এমনটাই দেখা যায় বলে অনেক বিজ্ঞ পর্যবেক্ষকের অভিমত। মালিক সরকার হলেই কর্মচারীদের মধ্যে ‘সরকারি মাল দরিয়ামে ঢাল’ প্রবণতা ঝেঁকে বসে। নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি ও মিশ্র অর্থনীতির জমানার পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এমনটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রমাণিত। সে কারণেই আজ বাজার অর্থনীতির বাড়বাড়ন্ত সর্বত্র।

“কাজ না করে অলস সময় পার করা কিংবা অফিসের কাজের সময় অফিসের প্রয়োজনকে দাবিয়ে ব্যক্তিগত কাজে সময় দেয়া, নিজের ব্যক্তিগত সবগুলো কাজ অফিস সময়ের ভেতর করে নেয়ার ধান্ধা। এমনকি কাজ না করেও কেবল সুবিধাদি হাতিয়ে নেওয়াটাকে কোনোরকম অন্যায় মনে করে না সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের সিংহভাগ কর্মজীবী!”

অনেকেই তাদের পর্যবেক্ষণ এভাবেই ব্যক্ত করেন যে, কাজ না করে অলস সময় পার করা কিংবা অফিসের কাজের সময় অফিসের প্রয়োজনকে দাবিয়ে ব্যক্তিগত কাজে সময় দেয়া, নিজের ব্যক্তিগত সবগুলো কাজ অফিস সময়ের ভেতর করে নেয়ার ধান্ধা। এমনকি কাজ না করেও কেবল সুবিধাদি হাতিয়ে নেওয়াটাকে কোনোরকম অন্যায় মনে করে না সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের সিংহভাগ কর্মজীবী! বরং এই প্রবণতার বিপরীতে অবস্থান নেয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীগণই দিনে দিনে অন্যদের চোখের বালি হয়ে ওঠেন সেসব প্রতিষ্ঠানে।

দেশ স্বাধীনের পর পাটকলসহ অনেক কিছুই সরকারিকরণ হয়েছিল; উদ্দেশ্য ছিল মহৎ। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই দুর্দিনের সূত্রপাত; শেষ পর্যন্ত কোনো মহৎ অর্জন সেখান থেকে আসেনি। ক্রমে ক্রমে সেগুলি হয়ে ওঠেছে সরকারি অর্থ অপচয়ের ছিদ্র বিশেষ; তথা ব্লিডিং পয়েন্ট। সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় সেটা প্রমাণিত যে, সরকার খুব সী‌মিত কিছু ক্ষেত্রে ব্যবসা করলেও ব্যাপকহারে কিংবা কলকারখানা চালিয়ে ব্যবসা করতে পারে না। প্রায় সারা বিশ্বের বাস্তবতায় একই ফল; সরকার শেষ পর্যন্ত ব্যবসা করতে পারেনি এবং পারে না। ‘কেন পারেনি’ বা ‘কেন পারে না?’ সেই প্রশ্নের উত্তর অনেক লম্বা। সে তাত্ত্বিক আলোচনা দীর্ঘ দীঘ পরিসরে বাস্তবে হওয়া জরুরি।

ছোটবেলায় পড়েছি পাট আমাদের সোনালী আঁশ। পাট বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের হাতিয়ার ছিল একসময়। তখনও কৃত্রিম তন্তুর ব্যবহার ব্যাপক আকার ধারণ করেনি পৃথিবীময়। সেইসব এখন কেবলই গল্প। অনেকটা রূপকথার গল্পের মতোই। বাস্তবতা হচ্ছে- বর্তমান সময়ে বেসরকারি পাটকলগুলো ধীরে ধীরে ব্যবসাসফল হয়ে উঠলেও সরকারিগুলো ধুঁকে ধুঁকে মরছে; হ্যাঁ, ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকার চেয়ে একেবারে মরে যাওয়াই শ্রেয়। তা-ই হচ্ছে সরকারি পাটকলের ক্ষেত্রে। কেন এমন হলো এর তাত্ত্বিক জবাব খুঁজবেন সমাজ বিজ্ঞানীরা। কিন্তু একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে কিছু বিক্ষিপ্ত ভাবনা ও মন খারাপের অনুভূতি মগজে বুদবুদ তুলে বৈকি।

“অনবরত লোকসানের কারণে অনেক রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল এযাবত কালে বিভিন্ন সরকারের আমলে বন্ধ হয়েছে। অবশিষ্ট ২৬টি পাটকলও লোকসান দিয়ে যাচ্ছিল বছরের পর বছর ধরে। এসব লোকসানী শিল্প বন্ধ করে শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেক বা স্বেচ্ছায় অবসরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বর্তমান সরকার।”

আমার বিশেষ শ্রদ্ধাভাজন একজন অভিজ্ঞ (সাবেক) আমলা, প্রসঙ্গক্রমে ঠিক এভাবেই তার অভিমত ব্যক্ত করেছেন, “সরকার ব্যবসা করে কোনো দেশে সফল হয় নাই। সরকার সেবা খাত চালায় অনেক দেশেই ভর্তুকি দিয়ে। … ব্যবসা প্রাইভেট সেক্টর করুক।” হ্যাঁ, সময়ের পরীক্ষায় এটাই শেষ কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে শ্রমিক ও সর্বস্তরের কর্মজীবীদের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং অসম প্রতিযোগিতার হাত থেকে বেসরকারি খাতকে রক্ষা করার জন্য জুতসই নীতিমালা এবং সেই নীতিমালার কঠোর মনিটরিং প্রয়োজন। বাজার অর্থনীতির যুগে উন্নত বিশ্বের দেশে দেশে সেটা হয়েছে। যা আমাদের দেশে এখনো হয়নি। আমরা যদি এটুকুও করতে না পারি তবে মানবতা তো ভূলুণ্ঠিত হবেই পদে পদে। আর সে কারণেই ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ কথাটির বদলে ‘সবার উপরে মুনাফা সত্য’ কথাটিই সত্য হয়ে ওঠছে। আর এমনটা নিঃসন্দেহে আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্নের সাথে সাংঘর্ষিক।

উল্লেখ্য, অনবরত লোকসানের কারণে অনেক রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল এযাবত কালে বিভিন্ন সরকারের আমলে বন্ধ হয়েছে। অবশিষ্ট ২৬টি পাটকলও লোকসান দিয়ে যাচ্ছিল বছরের পর বছর ধরে। এসব লোকসানী শিল্প বন্ধ করে শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেক বা স্বেচ্ছায় অবসরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বর্তমান সরকার। জানা যায়, পাটকলগুলোয় বর্তমানে স্থায়ী শ্রমিক ২৪ হাজার ৮৬৬ জন। এ ছাড়া তালিকাভুক্ত বদলি ও দৈনিকভিত্তিক শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ২৬ হাজার। কঠিন দুঃসময়ে হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হচ্ছে। ভাবতেই ভীষণ মন খারাপ হয়, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় কিন্তু জুতসই বিকল্প-তো দেখি না!

মহিবুল ইসলাম: চিন্তক, কলামিস্ট

ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম

ট্যাগ:

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply