বুধবার রাত ১:০২, ২৫শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ৭ই মে, ২০২৪ ইং

টিসিবির পণ্য পেতে ভোগান্তি সীমাহীন: ডিলারদের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়

খায়রুল আকরাম খান

ব্রাহ্মণবাড়িয়া কাচারি পুকুর পাড়। ছবি: দেশ দর্শন

মাত্র ১৩০ টাকা সাশ্রয়ের জ‌ন্যে প্রতি‌টি ভোক্তা‌কে ৩ থে‌কে ৪ ঘণ্টা ‘ধৈর্য ধ‌রে’ অ‌পেক্ষা কর‌তে হয়। এ‌তো ব‌্যাপক সম‌য়ের অপচয়, দীর্ঘ সম‌য়ের প্রতীক্ষা। ব‌্যাপার‌টি খুবই অমান‌বিক!

সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং কর‌পো‌রেশন অব বাংলা‌দেশ (‌টি‌সি‌বি)‌ সাধারণ মানু‌ষের জ‌ন্য তুলনামূলক কম দা‌মে ভোজ‌্যপণ‌্য বি‌ক্রি ক‌রে আস‌ছে দীর্ঘদিন ধরে। সরকা‌রের বা‌ণিজ‌্য মন্ত্রণাল‌য়ের তত্ত্বাবধা‌নে এ‌টি নিয়‌মিতভা‌বে প‌রিচা‌লিত হয়। সাধারণ ছু‌টির সময়ও মানুষ প্রয়োজনীয় খাদ‌্যদ্রব‌্য টি‌সি‌বির প‌রি‌বেশক‌দের ভ্রাম‌্যমান ট্রাক থে‌কে কিন‌তে পার‌ছেন! বি‌শেষ ক‌রে যেসব প‌ণ্যের দাম বাজা‌রে বেশি থা‌কে, সেসব পণ‌্য সরকার টি‌সি‌বির ডিলা‌রের মাধ‌্যমে সাধারণ জনগ‌ণের নিকট পৌঁ‌ছে দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করে। সরকা‌রের এই মহতী উ‌দ্যোগ স‌ত্যিই প্রশংসার যোগ্য।

বর্তমা‌নে টি‌সি‌বির প্রত্যেক ডিলা‌র‌কে প্রতি‌দিন বরাদ্দ দেওয়া হ‌য় ৭০০ কে‌জি চি‌নি, ৩০০ কে‌জি মশুর ডাল, ৫০০ লিটার তেল। কিন্তু ডি‌লার‌দের বিরু‌দ্ধে অ‌ভি‌যোগ র‌য়ে‌ছে- এসব প‌ণ্যের বে‌শির ভাগই তারা কা‌লোবাজা‌রে বি‌ক্রি দেয়। ফ‌লে দীর্ঘক্ষণ ঘণ্টার পর ঘণ্টার দা‌ঁড়ি‌য়ে থেকেও চা‌হিদামা‌ফিক পণ‌্য পা‌চ্ছেন না ভোক্তাগণ। তাই খা‌লি হাতেই বা‌ড়ি ফি‌রে যে‌তে হয় বে‌শির ভাগ ভোক্তা‌কে।

সারাদেশের ম‌তো ব্রাহ্মণবা‌ড়িয়াও এর ব‌্যতিক্রম নয়। ব্রাহ্মণবা‌ড়িয়া পৌরসভা ও এর আশপাশ এলাকায় প্রতি‌দিন সকাল থে‌কে দুপুর পর্যন্ত সরকারঘো‌ষিত স্বল্পমূ‌ল্যে টি‌সি‌বির ভোজ‌্যপণ‌্য বি‌ক্রি হয়। বর্তমা‌নে ব্রাহ্মণবা‌ড়িয়া পৌর সভার কাচারী পুকুর পাড়, লোকনাথ দী‌ঘির পাড়, ইন্ডা‌স্ট্রিয়াল স্কুল মাঠ, নিয়াজ মোহাম্মদ স্টে‌ডিয়াম হাইস্কুল মাঠসহ আ‌রো বেশ কিছু জায়গায় ট্রা‌কে টি‌সি‌বির ভোজ‌্যপণ‌্য নিয়‌মিতভা‌বে বি‌ক্রি হ‌য়। বর্তমা‌নে এই জেলায় র‌য়ে‌ছে টি‌সি‌বির ৬১ জন ডিলার। এসব ডিলার সদর উপ‌জেলাসহ অন‌্যান‌্য উপ‌জেলায় ট্রা‌কে ক‌রে ভোজ‌্য পণ‌্য বি‌ক্রি কর‌ছেন প্রতি‌দিন।

টি‌সি‌বির ডিলা‌দের বিরু‌দ্ধে ভোক্তাদের অ‌ভি‌যো‌গের বিষয়ে অনুসন্ধান কর‌তে গত ২৫ আগস্ট সকাল সা‌ড়ে ৯টায় কাচারী পুকুরপাড়স্থ আব্দুল কুদ্দুস মাখন মুক্তমঞ্চ চত্ব‌রে পৌঁ‌ছি। চার‌দি‌ক লো‌কে লোকারণ‌্য। তিল ঠাই‌য়ের জায়গা নেই। প্রায় ৪০০ থে‌কে ৫০০ লোক স্বাস্থ‌্যবি‌ধি ভে‌ঙ্গে গাদাগা‌দি ক‌রে টি‌সি‌বির পণ‌্য পাওয়ার আশায় ত‌ী‌র্থের কাকের ম‌তো দীর্ঘক্ষণ যাবৎ লাই‌নে দা‌ঁড়ি‌েয়ে আ‌ছেন। লাই‌নে দা‌ঁড়ি‌য়ে থাকা ৬০ বছর বয়সী নেকজান বি‌বি দেশ দর্শনকে জানা‌ন, তি‌নি পা‌য়ে হে‌ঁটে এ‌সে‌ছেন শহরের শিমরাইলকা‌ন্দি থে‌কে সকাল ৬ টায়।

তি‌নি বলেন, প্রায়দিনই তি‌নি এখা‌নে আ‌সেন টি‌সি‌বির ভোজ‌্যপণ‌্য পাওয়ার আশায়। কিন্তু বে‌শিরভাগ দি‌নেই তার ভা‌গ্যে পণ‌্য জু‌টে না। লাই‌নে দা‌ঁড়ি‌য়ে থাকা আব্দুল র‌হিম না‌মে এক ভোক্তা জানা‌ন, তি‌নি শেরপুর থে‌কে বাদ ফজর এখা‌নে এ‌সে‌ছেন। দীর্ঘক্ষণ যাবৎ লাই‌নে দা‌ঁড়ি‌য়ে আ‌ছেন টি‌সি‌বির প‌ণ্যের আশায়। এখ‌নো পর্যন্ত তি‌নি শে‌ৗচকর্ম সম্পন্ন কর‌তে পা‌রেননি। এতো ক‌ষ্টের পরও ভোজ‌্যপণ‌্য যে পা‌বে তার কো‌নো নিশ্চয়তা নেই।

টি‌সি‌বির ডিলা‌র‌দের বিরু‌দ্ধে তার অ‌ভি‌যোগ, তারা ভোক্তা‌দের সা‌থে দুর্ব‌্যবহার ক‌রে, মা‌পে কম দেয়, প‌রি‌চিত লোক‌কে বে‌শি ক‌রে পণ‌্য দেয়। কালা মিয়া না‌মের আ‌রেজন জানা‌ন, নিবার্হী ম‌্যা‌জি‌স্ট্রেট উপ‌স্থিত থাক‌লে সব ভোক্তাই সব পণ‌্য পান। কিন্তু ম‌্যা‌জিস্ট্রেট বে‌শিক্ষণ এখা‌নে থা‌কেন না। তি‌নি চ‌লে গে‌লে সব পণ‌্য চা‌হিদামা‌ফিক পাওয়া যায় না।

“চার‌দি‌ক লো‌কে লোকারণ‌্য। তিল ঠাই‌য়ের জায়গা নেই। প্রায় ৪০০ থে‌কে ৫০০ লোক স্বাস্থ‌্যবি‌ধি ভে‌ঙ্গে গাদাগা‌দি ক‌রে টি‌সি‌বির পণ‌্য পাওয়ার আশায় ত‌ী‌র্থের কাকের ম‌তো দীর্ঘক্ষণ যাব লাই‌নে দা‌ঁড়ি‌েয়ে আ‌ছেন।”

পণ‌্য কিন‌তে আসা র‌হিমা খাতুন জানা‌ন, “দাম কম পাওয়ার আশায় দীর্ঘক্ষণ ধ‌রে অ‌তি কষ্ট ক‌রে লাই‌নে দা‌ঁড়ি‌য়ে আ‌ছি। পণ‌্য পাব কি-না জা‌নি না। লাই‌নের মাঝামা‌ঝি‌তে দাঁড়ানো বিরাসা‌রের বা‌সিন্দা আলী আহ‌মে‌দের অ‌ভি‌যোগ, “বরাদ্দ দেওয়া সকল পণ‌্য ট্রা‌কে ক‌রে আ‌নেন ডিলা‌রের কর্মচারীরা। কিন্তু বে‌শির ভাগ পণ‌্যই তারা কা‌লো বাজ‌রে বে‌শি দা‌মে বি‌ক্রি ক‌রে দেন।”

ভোক্তা‌দের সা‌থে আলাপরত অবস্থায় হঠাৎ টি‌সি‌বির পণ‌্যবাহী ট্রাক আব্দুল কুদ্দুস মাখন চত্ব‌রে প্রবেশ ক‌রে। তখন সকাল প্রায় সা‌ড়ে ১০টা বা‌জে। এ সময় চার‌দি‌কে হুড়োহু‌ড়ি শুরু হয়। যেসব ভোক্তা বিরক্ত হ‌য়ে বা‌ড়ি ফি‌রে যা‌চ্ছি‌লেন, তারা পূ‌র্বের জায়গায় আসার চেষ্টা ক‌রেন। আবার কেউ কেউ খুব প্রাতঃকা‌লে ইট‌ রে‌খে তা‌দের জায়গা চিহ্নিত ক‌রে গি‌য়েছি‌লেন, তারাও তা‌দের চি‌হ্নিত জায়গা দখল নি‌তে আ‌সেন। এই নি‌য়ে ভোক্তা‌দের ম‌ধ্যে তর্ক‌বিতর্ক শুরু হয়। ভোক্তা‌দের এ‌হেন আচর‌ণে ম‌নে হ‌চ্ছে, তারা যেন বিনা পয়সায় ‘রি‌লি‌ফের মাল’ নি‌তে এ‌সে‌ছেন। এই অবস্থায় পু‌লিশ এ‌সে উদ্ভূত প‌রি‌স্থি‌তি সামাল দেন।

ভোক্তা‌দের ম‌ধ্যেকার বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ার পর আ‌মি ছু‌টে যাই ট্রা‌কে উপ‌স্থিত টি‌সি‌বির প‌রি‌বেশক‌দের সা‌থে কথা বল‌তে। তা‌দের কাছ থে‌কে অবগত হই, বর্তমা‌নে একজন ক্রেতা‌কে ২ লিটার তেল, ২ কে‌জি চি‌নি, ২ কে‌জি মসুর ডাল দেওয়া হ‌চ্ছে। আর এর বি‌নিম‌য়ে ক্রেতার কাছ থে‌কে নেওয়া হ‌চ্ছে মাত্র ৪২০ টাকা। যার বর্তমান বাজার মূল‌্য ৫৫০ টাকা।

টি‌সি‌বি প্রতি‌নি‌ধির হিসাব অনুযায়ী দেখা যা‌চ্ছে, প্রত্যেক ক্রেতা বাজারমূল‌্য থে‌কে মোট ১৩০ টাকা সাশ্রয় পা‌চ্ছে। মাত্র ১৩০ টাকা সাশ্রয়ের জ‌ন্যে প্রতি‌টি ভোক্তা‌কে ৩ থে‌কে ৪ ঘণ্টা ‘ধৈর্য ধ‌রে’ অ‌পেক্ষা কর‌তে হয়। এ‌তো ব‌্যাপক সম‌য়ের অপচয়, দীর্ঘ সম‌য়ের প্রতীক্ষা। ব‌্যাপার‌টি খুবই অমান‌বিক! এমন কষ্টকর কাজ স‌ত্যিই দুঃখজনক! এ ধর‌নের অমান‌বিকতার অবসান হওয়া দরকার।

এরপর দেখা কর‌তে যাই ব্রাহ্মণবা‌ড়িয়া জেলার টি‌সি‌বির সব‌চে‌য়ে পুরনো ও শীর্ষস্থানীয় প‌রি‌বেশক মোঃ হো‌সেন মিয়ার কার্যাল‌য়ে। তার প্রতিষ্ঠা‌নের নাম ‘মেসার্স তা‌নিম এন্টারপ্রাইজ’। তাকে পাওয়া যায়‌নি। ত‌বে তার প্রতিষ্ঠা‌নের ম‌্যা‌নেজার মোঃ তা‌নিম হাসানের নিকট ভোক্তা‌দের অ‌ভি‌যোগ সম্প‌র্কে জান‌তে চাই‌লে তিনি জানা‌ন, “ভোক্তা‌দের অ‌ভি‌যোগ ভি‌ত্তিহীন, বা‌নোয়াট। ত‌বে এ কথা সত‌্য যে, আমরা চা‌হিদা অনুযায়ী সব ভোক্তা‌কে সব পণ‌্য দি‌তে পার‌ছি না।”

“আলী আহ‌মে‌দের অ‌ভি‌যোগ, “বরাদ্দ দেওয়া সকল পণ‌্য ট্রা‌কে ক‌রে আ‌নেন ডিলা‌রের কর্মচারীরা। কিন্তু বে‌শির ভাগ পণ‌্যই তারা কা‌লো বাজ‌রে বে‌শি দা‌মে বি‌ক্রি ক‌রে দেন।”

তার ভাষ‌্য অনুযায়ী, ক‌রোনাকালীন কর্মহীন ও আয় ক‌মে যাওয়া মানু‌ষেরাই টি‌সি‌বির পণ‌্য ক্রয় কর‌তে আ‌সেন। আর বাজা‌রের তুলনায় টি‌সি‌বির প‌ণ্যের মূল‌্য কম হওয়ার কার‌ণে ক্রেতার সংখ‌্যা দিন‌দিনই বাড়‌ছে। এই অবস্থায় য‌দি ভোক্তার চা‌হিদা অনুযায়ী পণ‌্য সরবরাহ বা‌ড়ে তাহ‌লে আমরা ক্রেতা‌দের চা‌হিদা অনুযায়ী সব পণ‌্য অ‌তি সহ‌জে সরবরাহ কর‌তে পার‌বো।

এ বিষয়ে একজন সমাজবিশ্লেষকের মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সরকা‌র ও সং‌শ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়‌টির দি‌কে নজর দেওয়া এবং টি‌সি‌বির ডিলার‌দের বিরুদ্ধে আ‌নিত ভোক্তাদের অ‌ভি‌যোগগু‌লোর সত্যতা তদন্তসা‌পে‌ক্ষে প্রমাণিত হলে তা‌দের‌কে আই‌নের আওতায় আনা অপরিহার্য। পাশাপা‌শি চা‌হিদামা‌ফিক পণ‌্য সরবরাহ ক‌রে ভোক্তা‌দের পণ‌্য পাওয়া সু‌নি‌শ্চিত ক‌রে তা‌দের শারী‌রিক ও মান‌সিক কষ্ট লাঘব কর‌া এবং তা‌দের মূল‌্যবান সময় অপচয় রোধ করাও জরুরি।”

তিনি বলেন, “সরকার এ কাজ‌টি সুষ্ঠু ও সুন্দরভা‌বে কর‌তে পার‌লে টি‌সি‌বির পণ‌্য পাওয়ার ক্ষে‌ত্রে মানু‌ষের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হ‌বে এবং অ‌স্থির বাজা‌রে বি‌ভিন্ন পণ‌্য-দ্রব্যের মূ‌ল্যবৃ‌দ্ধিও নিয়‌ন্ত্রিত হ‌বে।”

খায়রুল আকরাম খান: নিজস্ব প্রতিবেদক

ক্যাটাগরি: প্রধান খবর,  শীর্ষ তিন

ট্যাগ:

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply