শুক্রবার সকাল ১১:৩৬, ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ৩রা মে, ২০২৪ ইং

জিপিএ ফাইভ, অনার্স-মাস্টার্স: সাফল্য না অভিশাপ?

তোফায়েল আহমদ

“জিপিএ ফাইভের তীর এ পর্যন্ত যতোগুলো প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, এক পৃথিবী জিপিএ ফাইভ মিলেও একটি প্রাণ ফিরিয়ে আনতে পারবে না। অথচ এমন অনেক মেধা এদের মধ্যে থেকে যাওয়া অসম্ভব নয়, যে মেধা কোটি জিপিএ ফাইভ থেকেও দামী।”

শিক্ষা কী? শিক্ষা কেন? শিক্ষার কাজ কী? বর্তমানের এসব কি সত্যিই শিক্ষা, না অন্যকিছু? এসব শিক্ষা শান্তি এনে দিচ্ছে, নাকি শিক্ষার নামে চলছে ‘জিপিএ ফাইভ ও অনার্স-মাস্টার্স-বিসিএস ব্যবসা’! নোংরা প্রতিযোগিতা? যে কোনো মূল্যে ওটা চা-ই চাই। প্রাথমিক শিক্ষায় যারা জিপিএ ফাইভ পাচ্ছে তারাই সফল; যারা পাচ্ছে না তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ ও বিফল- এই মনোভাব আমাদের কী করছে, উন্নতি না অবনতি? আর্থিক অপচয়? মানসিক অবক্ষয়? মগজ ঘুরান। চিন্তা-চেতনার বিকাশ ঘটান। সব পরিষ্কার ফুটে উঠবে।

কী করছে সমাজ জিপিএ ফাইভ পেতে ও অনার্স-মাস্টার্স করতে? টাকার ছড়াছড়ি, প্রশ্নপত্র ফাঁস, স্যারের সাথে ছাত্রীর অনৈতিক যোগাযোগ, ছাত্র-ছাত্রীর মায়ের স্যারের প্র‌তি গায়ে-গা আন্তরিকতা। আরো কতো কী! এসবের প্রমাণ টানা লেখার অপচয় বৈ আর কী? এছাড়াও জিপিএ ফাইভ না পেলে মরে যেতে হবে, ঘুমের ট্যাবলেট খেতে হবে, গলায় দঁড়ি দিতে হবে। এসব আত্মহননের মনোভাব‌ে কেন একজন শিক্ষার্থীর গ‌ড়ে ওঠ‌ছে?

দেশে শিক্ষিতের হার বাড়ার সাথে সাথে দুর্নীতিও বাড়ছে সমানতালে। ‘তাইতো গরীবের ত্রাণ, কেড়ে খায় নেতা মহান’। শিক্ষা যদি নীতি-নৈতিকতার বিকাশ ঘটাতো তাহলে শুধু গরীবরাই নয়, কো‌নো মানুষই তা‌দের অধিকার হারাতো না। দেশের কাজের টাকা আত্মসাৎ হয়ে যেতো না। নতুন ব্রিজ ভেঙে পড়তো না। নতুন রাস্তায় গর্ত হতো না। ড্রেনের ওপরে দেওয়া স্ল্যাব সপ্তাহ, মাস না যে‌তেই ভেঙ্গে পড়তো না। টেন্ডার নিয়ে দু’দলের মধ্যে ঝগড়া হতো না।

আরো পড়ুন> করোনা খুলে দিলো ‘তাহাদের’ মুখোশ

এই করোনায় বের হওয়া রেজাল্ট দেখে আমাদের ফুলবাড়িয়া উপজেলার এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। সে ‘স্বর্ণপ্লাস’ পায়নি। তাই সে বড় কিছু হতে পারবে না। বড় রকম ঘুষ খেতে পারবে না। মোটা বেতন পাবে না। জীবনের সব ব্যর্থতা তার হৃদয়জুড়ে। আপনি যদি তাকে বেঁচে থাকতে প্রশ্ন করতেন, তুমি লেখাপড়া করে কী করবে? নিশ্চিত সে একসাগর স্বপ্নের কথা বলে দিতো। ভালো একটা চাকরির কথা সর্বপ্রথম বলতো। চাকরি মানেই মাসশেষে নিশ্চিত টাকা। অথচ টাকা চাকরি না করেও কামানো যায়।

“বর্তমান সময়ের যুব সমাজ চিন্তা করে, যে টাকা খরচ করে লেখাপড়া করবে সে টাকা খরচ করে বিদেশে চলে যাবে। কেননা সে পড়াশোনা শেষ করে চাকরি পাবে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঘুষ দিয়েও না। তাহলে পড়ালেখা করে লাভ কী? চাকরিও পেলো না। টাকাও পেলো না। নৈতিকতা তো উদ্দেশ্যই না।”

কলমের খোঁচায় টাকা কামানোর চাকরিমুখী শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তে এমন একটা কর্মবান্ধব শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা এখন সময়ের দাবি। যেখানে ব্যর্থ হওয়ার গ্লানি থাকবে না। নিরাশা থাকবে না। আবিষ্কারক মনোভাব থাকবে সবার ভেতর। জিপিএ ফাইভের তীর এ পর্যন্ত যতোগুলো প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, এক পৃথিবী জিপিএ ফাইভ মিলেও একটি প্রাণ ফিরিয়ে আনতে পারবে না। অথচ এমন অনেক মেধা এদের মধ্যে থেকে যাওয়া অসম্ভব নয়, যে মেধা কোটি জিপিএ ফাইভ থেকেও দামী।

এখন ভাবতে হবে, ভবিষ্যতে যেন আর খবর না আসে সর্বনাশা ‘স্বর্ণপ্লাস’ কোনো ছাত্র-ছাত্রীর জীবন গ্রাস করেছে। হারানো হাজার সম্পদ আর ফিরে পাওয়া যাবে না। তবে ব্যর্থ হওয়ার গ্লানি বয়ে আর যেন কোনো সম্পদ হারিয়ে না যায়- আমরা সে চেষ্টা করতে পারি। সরকার সে চেষ্টা করতে পারে। একেকটা মানুষ একেকটা খনি। কেউ স্বর্ণের খনি। কেউ রূপার খনি। ফেল করা মানুষটাও অনেক কিছু করতে পারে। অনেক পাশ করা মানুষ থেকেও দামী কিছু।

বর্তমান সময়ের যুব সমাজ চিন্তা করে, যে টাকা খরচ করে লেখাপড়া করবে সে টাকা খরচ করে বিদেশে চলে যাবে। কেননা সে পড়াশোনা শেষ করে চাকরি পাবে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঘুষ দিয়েও না। তাহলে পড়ালেখা করে লাভ কী? চাকরিও পেলো না। টাকাও পেলো না। নৈতিকতা তো উদ্দেশ্যই না। সুতরাং বর্তমান সময়ের শিক্ষা বাণিজ্যের নিষ্ফল শিক্ষার গতি পরিবর্তন করে মনুষ্যত্বধর্মী ও কর্মমুখী শিক্ষার প্রচার প্রসার অতীব জরুরি।

যেখানে শিক্ষা হবে আদর্শ এবং মনুষ্যত্বের বিকাশ ও নীতিনৈতিকতা শেখার মাধ্যম। কর্ম হবে উপার্জনের মাধ্যম। শিক্ষাটা অল্প পরিমাণে হলেও যেন প্রকৃত শিক্ষা হয়। ধরা যাক একজন শিশুকে শুধু একটি শিক্ষা দেওয়া হলো- ‘মিথ্যা বলা মহাপাপ’। একটি শিশু শিখতে শিখতে পিএইচডি করে এলো বাইরে থেকে। কিন্তু সে কোনো শিক্ষাই আমলে আনলো না বরং সে লোভে পড়ে গেলো। বড় পদ পেলো। দুর্নীতি করে টাকার পাহাড় জমালো। কিন্তু প্রথম শিশু একটি শিক্ষাই সারাজীবন পালন করলো। কোনোদিন মিথ্যা বললো না। নিশ্চয়ই প্রথম শিশুই প্রকৃত শিক্ষিত বলে স্বীকৃত হবে।

“শিক্ষা কী? শিক্ষা কেন? শিক্ষার কাজ কী? বর্তমানের এসব কি সত্যিই শিক্ষা, না অন্যকিছু? এসব শিক্ষা শান্তি এনে দিচ্ছে, নাকি শিক্ষার নামে চলছে ‘জিপিএ ফাইভ ও অনার্স-মাস্টার্স-বিসিএস ব্যবসা’! নোংরা প্রতিযোগিতা? যে কোনো মূল্যে ওটা চা-ই চাই। প্রাথমিক শিক্ষায় যারা জিপিএ ফাইভ পাচ্ছে তারাই সফল; যারা পাচ্ছে না তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ ও বিফল- এই মনোভাব আমাদের কী করছে, উন্নতি না অবনতি?”

মাস্টার্স করা ছেলেটা বেকার ঘুরছে। চাকরি পাচ্ছে না। একের পর এক ইন্টারভিউ দিচ্ছে। কারো হচ্ছে, কারো হচ্ছে না। যার হচ্ছে না তার কথা কেউ ভাবছে না। অথচ সেও তার জীবনের আঠারোটি বসন্ত পার করেছে বইয়ের পাতা উল্টিয়ে। পরীক্ষার খাতায় কলম চালিয়ে। সে যদি ইন্টারভিউতে দুটি উত্তর না দিতে পারে তাহলেই তার সব বৃথা? সে কী করবে? একরকম পঙ্গু সে। কোনো কাজ শেখেনি সে। জীবনের মূল্যবান সময় খরচ করেছে স্কুল, কলেজ, ভার্সিটির আঙিনায়। এরপর ব্যর্থ হবার যন্ত্রণায় একদিন সে পা বাড়ায় অপরাধজগতে। মা-বাবা বুঝেন তারা টাকা খরচ করে সন্তানকে শিক্ষিত পঙ্গু বানিয়েছেন। বিপদ কত বড়! সেটাতো তারা বুঝেন।

হাজার হাজার শিক্ষিত ছেলেমেয়ে বেকার বসে আছে। একটা দেশ কীভাবে উন্নতি করবে? এরা কোনো কাজ করছে না। চাকরির সার্কুলার খুঁজছে। এ্যাপ্লিকেশন করছে। নিয়োগ হবে দশজন, প্রার্থী দশ হাজার। তার ম‌ধ্যে আছে টাকার মার। বাকিরা কী করবে? এমনসব অস্থিরতা নিয়ে দেশটা টিকে আছে এটাই তো খোদার বড় দয়া। সময় এখন স্লোগান ছুঁড়েছে, ‘শিক্ষিত বেকার নয়, আমাকে কর্মী দাও‘। প্রতিটি শিক্ষার্থীর কোনো না কোনো ‘কর্মশিক্ষা’ থাকবে- এভাবেই গড়ে তুলতে হবে আমাদের বর্তমানকে। হাতে শুধু কলম নয়, কর্মও চাই।

করোনার জন্য হয়তো খবর পাওয়া যায়নি কতজন শিক্ষার্থী জিপিএ ফাইভ না পাওয়ায় আত্মহত্যা করেছে। তবে একজনও না করুক- আমরা এটাই চাই। ফুলবাড়িয়ার ছেলেটি মাত্র পাঁচ নম্বরের জন্য জিপিএ ফাইভ পায়নি। আহ! সে তো চলেই গেল। ভাসিয়ে গিয়েছে গোটা একটা পরিবারকে শোক আর কলঙ্কের সাগরে। আত্মহত্যা খুবই নিকৃষ্ট কাজ। তার জন্য ক্ষমা নেই। আর সমাজও এটাকে খুবই ঘৃণা করে। তুমি মরে যাবে ঠিকই মেরে তোমার পরিবারকে দাফন না করে।

জানি না তার মা কীভাবে সবর করছে! বাবা কীভাবে বুঝাচ্ছে তার পিতৃপরমহৃদয়কে। তার ভাইবোনদের হাহাকার ভাসিয়ে দিচ্ছে কত সাগরের পর সাগর। জীবনের উপর জুলুম টেনে এভাবে মরে যাওয়া কোনোভাবেই শোভনীয় নয়। সুতরাং ‘কর্মবান্ধব মনুষ্যত্বশিক্ষা হোক বেঁচে থাকার মোমবাতি’।

লেখকের ব্লগ

তোফায়েল আহমদ: কবি ও কলামিস্ট

ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম

ট্যাগ: তোফায়েল আহমদ

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply