রবিবার দুপুর ২:৩৬, ৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ১৯শে মে, ২০২৪ ইং

ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক আজ কোথায়?

জান্নাতুল মাওয়া ড্রথি

“এতটুকু একটা মেয়ে, এতো বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো? ভাবলো না বাবা মায়ের কথা, আপনজনদের কথা? বলবেন, বাবা মায়ের অসম্মান দেখে এই কাজ করেছে। বাবার কথা শিক্ষক না শোনায় বাবা অসম্মানিত হয়েছেন। আর তার অন্যায় কিছু হয়নি? যার বাবা মার সম্মানের এতো চিন্তা, তার তো অন্যায় করার আগে দুইবার ভাবা উচিত।”

অন্যায় করলাম, শিক্ষক শাসন করলো। বাবা-মাকে নিয়ে গেলাম। ভাবলাম, বাবার ক্ষমতা শিক্ষককে বাধ্য করতে পারবে। কিন্তু ক্ষমতা তো দূরের কথা, অনুরোধেও কাজ হলো না। ব্যস, বাসায় এসেই সুইসাইড নোট লিখে আত্মহত্যা! এরপর বাবা-মায়ের এক কথা- সব দোষ শিক্ষকের। তাদের ‘ক্ষমাহীন’ আচরণের জন্য আমার ছেলে/মেয়ে এই কাজ করেছে। এরপর সবাই মিলে শিক্ষকদের ধরো। কেননা সব দোষ শিক্ষকদের। কতো সহজ সমীকরণ!

আত্মহত্যার মতো জঘন্য কাজ করেও যেখানে পার পেলাম, সেখানে তো নকল করার নাম আসবেই না। বুঝলাম, শিক্ষক এতটা কঠোর না হলেও পারতেন। আজ এই মেয়েটি সুইসাইড করেছে, তাই সব আঙ্গুল শিক্ষকের দিকে। কিন্তু আত্মহত্যার কথা বাদ দিলে দোষটা কার হতো? শিক্ষকদের? প্লিজ ভাই, আপনারা যারা শিক্ষকদের আজ গালি দিচ্ছেন, মানসিক আর শারীরিক টর্চারের কথা বলছেন, আপনারা কেমন শিক্ষকদের কাছে বড় হয়েছেন জানতে খুব ইচ্ছা হচ্ছে।

আরো পড়ুন> শিক্ষা, সামাজিকতা, নৈতিকতা আজ ধ্বংসের মুখে

স্কুল আর কলেজ জীবনে শিক্ষকদের হাতে কম মার খাইনি। দুষ্টুমির জন্য, কখনো কখনো হোমওয়ার্ক না নিয়ে যাওয়ার জন্য। মনে পড়ে না বাড়ি এসে মা অথবা বাবাকে কখনো বলেছি। বরং ভয়ে থেকেছি, যেন তাদের দুজনার সাথে কখনো শিক্ষকদের দেখা না হয়ে যায়। কারণ শিক্ষকদের মুখ থেকে যদি জানতে পারেন আমাদের ফাঁকিবাজি অথবা দুষ্টুমির কথা, উল্টো পিঠের চামড়া থাকবে না। কিন্তু সুইসাইড করবো এমন কথা স্বপ্নেও ভাবিনি, অথবা ভাবার প্রশ্নই আসেনি।

এখন মাঝে মাঝে সেই শিক্ষকদের সাথে দেখা হয়। দেখলে কখনো মাথায় হাত দেন, আবার বুকেও জড়িয়ে ধরেন। যখন তাদের পা ধরে সালাম করি, একটা তৃপ্তি আর শ্রদ্ধা আসে মনে। এই মানুষগুলোর জন্যই আজকের আমরা। আর আজ তারাই অপরাধীর কাঠগড়ায়। আমাদের স্কুলের সবচেয়ে কঠিন শাস্তি পাওয়া ছেলেটাও কোনোদিন আত্মহত্যার কথা ভাবেনি। কিন্তু আজ এসব কি হচ্ছে একবার ভেবেছেন আপনারা? দোষ শিক্ষকদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছেন, কিন্তু একবারও মেয়েটি এবং তার বাবা মার কথা ভেবেছেন?

“অসভ্য আচরণকে আমরা প্রতিবাদের ভাষা বলে চালাচ্ছি। বড়দের কি করে অসম্মান করতে হয় আমরা তা ভালই শিখেছি। কে কি বলবেন জানি না, আমি যেটা সত্যি মনে করি সেটাই বলছি। আমাদের উচিত, আমাদের পরিবারের সন্তানদের সঠিক শিক্ষা দেওয়া। গোঁড়ায় গলদ রেখে আগা ছাঁটলে কোনো ভালো ফল আসবে না। সেই শিক্ষকদের শাস্তি হলে এই মেয়ের বাবা মায়েরও শাস্তি হওয়া উচিত, সন্তানকে সঠিক শিক্ষায় মানুষ না করার জন্য।”

এতটুকু একটা মেয়ে, এতো বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো? ভাবলো না বাবা মায়ের কথা, আপনজনদের কথা? বলবেন, বাবা মায়ের অসম্মান দেখে এই কাজ করেছে। বাবার কথা শিক্ষক না শোনায় বাবা অসম্মানিত হয়েছেন। আর তার অন্যায় কিছু হয়নি? যার বাবা মার সম্মানের এতো চিন্তা, তার তো অন্যায় করার আগে দুইবার ভাবা উচিত। বলবেন, আবেগ। ভাই, তাহলে বলতে হয়, এই আবেগকে প্রশ্রয় দিলে আমাদের সমাজের ভয়ঙ্কর পরিণতি ছাড়া কিন্তু আর কিছুই হবে না।

লেখকের সব লেখা

একটা কথা কারো মনে দাগ কেটেছে কিনা জানি না, কিন্তু আমার মনে লেগেছে। মেয়েটি তার বাবাকে বলেছে, তুমি তোমার ক্ষমতা দিয়েও কিছু করতে পারলে না? ভাবুন তো একবার, সে অন‍্যায় করবে, আর বাবা তার ক্ষমতায় তাকে সেভ করবে। কী মারাত্মক মানসিকতা! অথচ এই আমরাই আবার বলি ক্ষমতার অপব্যবহারের কথা। আজকের সমাজে আমাদের শিক্ষকদেরও নৈতিকতার অবক্ষয় হয়েছে এটা ঠিক। কিন্তু আমাদের সমাজের বাবা মা এবং তাদের সন্তানদের মানুষ করার প্রক্রিয়াটির যে অধঃপতন হয়েছে সেটা কি ভেবেছেন?

কোথায় যাচ্ছি আমরা? আমাদের সেই গুরু-শিষ্য সম্পর্ক আজ কোথায়? আজ অসভ্য আচরণকে আমরা প্রতিবাদের ভাষা বলে চালাচ্ছি। বড়দের কি করে অসম্মান করতে হয় আমরা তা ভালই শিখেছি। কে কি বলবেন জানি না, আমি যেটা সত্যি মনে করি সেটাই বলছি। আমাদের উচিত, আমাদের পরিবারের সন্তানদের সঠিক শিক্ষা দেওয়া। গোঁড়ায় গলদ রেখে আগা ছাঁটলে কোনো ভালো ফল আসবে না। সেই শিক্ষকদের শাস্তি হলে এই মেয়ের বাবা মায়েরও শাস্তি হওয়া উচিত, সন্তানকে সঠিক শিক্ষায় মানুষ না করার জন্য। কারো খারাপ লাগলে কিছু করার নেই, যেটা সত্যি সেটাই আমি বলবই।

ইউনিভার্সিটি অফ লিবারেল আর্টস, ঢাকা

ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম

ট্যাগ: জান্নাতুল মাওয়া ড্রথি

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply