বৃহস্পতিবার রাত ৯:৩৪, ১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২রা মে, ২০২৪ ইং

চারদিকে মিথ্যার ভিড়ে সত্য অন্তরালে

জান্নাতুল কারার তিথি

খুব ছোটকালে আমাদের বাবা-মায়েরা আমাদের কিছু প্রবাদ বাক্য শেখাতেন। যেমন- সদা সত্য কথা বলতে হয়, অথবা স্পষ্টভাষী শত্রু নির্বাক বন্ধু অপেক্ষা ভালো, অথবা অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে দুজনে সমান অপরাধী, অথবা দুষ্ট গরুর চেয়ে শুন্য গোয়াল অনেক ভালো ইত্যাদি। এই প্রবাদ বাক্য যারা ভাব সম্প্রসারণে ব্যবহার করেছে, তারা প্রকৃত অর্থে ভাগ্যবান। আর যারা তাকে ধারণ করে ফেলে তারা হচ্ছেন অপরাধী।

বর্তমানে এমন এক যুগে আমাদের বাস, যেখানে সত্যকে মিথ্যার দাড়িপাল্লায় তুলতে আমরা তৎপর। আর স্পষ্ট কথা বলা হচ্ছে বড় পাপের লক্ষণ। এমন এক যুগে আমাদের বাস, যেখানে বিশ্বাস করা হয় একবেলা নামাজ না পড়লে বা ঠাকুরকে প্রসাদ না চড়ালে নরক বা জাহান্নামে যেতে হবে। কিন্তু মিথ্যা কথা বললে জান্নাত বা স্বর্গ পাওয়া যেতেও পারে।

আরো পড়ুন> সন্তানের অভিভাবকত্ব প্রশ্নে নারীর সমান অধিকার নয়?

বর্তমানে মানুষ ধর্মের বাণী টেনে জান্নাত-জাহান্নামের বিচার করে। তার মানে হচ্ছে- তুমি যদি একটা বোরখা বা হিজাব পড়তে পারো (সেটা স্টাইলিশ হলে বা বোরখার উদ্দেশ্য সাধিত না হলেও স্রস্টা মাইন্ড খাবেন না), আর দেখাতে পারো যে তুমি নামাজী এবং ধর্মবাণী বিতরণে পটু হও; তবে তুমি মিথ্যা বল বা মিথ্যাকে সমর্থন করো যেটাই করো না কেন, তোমার জান্নাত বা স্বর্গে যেতে সমস্যা নাও হতে পারে। কিন্তু তোমার পোশাক যদি সেইসব নামধারী ধার্মিকের মতো না হয়, আর যদি সত্যকে ধারণ করো বা স্পষ্ট ভাষায় ঠিককে ঠিক আর ভুলকে ভুল বলো, তবে নরকের দরজা তোমার জন্য অপরিহার্য।

“বর্তমানে এমন এক যুগে আমাদের বাস, যেখানে সত্যকে মিথ্যার দাড়িপাল্লায় তুলতে আমরা তৎপর। আর স্পষ্ট কথা বলা হচ্ছে বড় পাপের লক্ষণ। এমন এক যুগে আমাদের বাস, যেখানে বিশ্বাস করা হয় একবেলা নামাজ না পড়লে বা ঠাকুরকে প্রসাদ না চড়ালে নরক বা জাহান্নামে যেতে হবে। কিন্তু মিথ্যা কথা বললে জান্নাত বা স্বর্গ পাওয়া যেতেও পারে।”

বর্তমান সময়ে একটা সত্যকে মানুষ সত্য বলতে ভয় পায়। স্পষ্টভাবে ভুলকে ভুল আর ঠিককে ঠিক বলতে ভয় পায়। তাদের কাউকে সত্যের সপক্ষে দাড়াতে বললে তারা তাকে ‘মনে হয় বা হয়তো’- এই শব্দগুলো দিয়ে উপস্থাপন করে। ভাবটা এমন যে, সত্য বললে যদি তাদের ‘ইমেজে’ দাগ লাগে? এই যুগে স্পষ্ট কথা বলা মানুষদের সংখ্যা কম। তারচেয়েও কম তাদের পছন্দ করা মানুষের তালিকা। সেখানে ‘মনে হয় বা হয়তো’ বলা মানুষেরা কখনো চাইবে না মিথ্যার দিক থেকে ডিজিটালজ মানুষদের চোখে ছোট হতে বা নিজেদের সঙ্গী হারাতে।

আমরা এমন এক যুগে আছি, যেখানে নির্লজ্জের মতো অকপটে মিথ্যা চর্চা করা যায় এবং সেই মিথ্যাকেও নির্লজ্জের মতো সমর্থন করা যায়। সেখানে স্রস্টাকে সত্যের সপক্ষে অবস্থানকারীদের জন্য একটু তো কষ্ট করতেই হয়। এখনকার জামানায় বোরখা-হিজাব পরিহিতা মানুষেরা নামাজ আর কোরআন নিয়ে এমন ব্যবসায় নেমেছেন যে স্বয়ং স্রস্টাকেও ঢাল হয়ে দাড়াতে হয় এই গুটিকয়েক নরকবাসীর পাশে৷

“আমরা খুব সহজে স্বর্গ-নরকের হিসাব করি, কিন্তু কর্মের দিকে নজর দেই না। আমরা ধরে নেই, পরকাল এই নামাজ পড়ে পার করা যাবে। কিন্তু একবারও ভাবি না, জীবনের সমস্ত নামাজের ফজিলতও একটা মিথ্যার জন্য হারাতে হতে পারে। চারপাশে ভণ্ডদের দৌরাত্যে প্রকৃত স্রস্টাপ্রেমীরা আজ অন্তরালে”

আমরা খুব সহজে স্বর্গ-নরকের হিসাব করি, কিন্তু কর্মের দিকে নজর দেই না। আমরা ধরে নেই, পরকাল এই নামাজ পড়ে পার করা যাবে। কিন্তু একবারও ভাবি না, জীবনের সমস্ত নামাজের ফজিলতও একটা মিথ্যার জন্য হারাতে হতে পারে। চারপাশে ভণ্ডদের দৌরাত্যে প্রকৃত স্রস্টাপ্রেমীরা আজ অন্তরালে। তাই হয়তো এ যুগে কিছু মানুষ আল্লাহকে খোঁজে পুস্তকে, আর কিছু মানুষ কর্মে। তাই সবাই ‘মনে হয় বা হয়তো’ বলতে পারে না। তাদের সত্য এতটাই জোরালো থাকে যে, এইসব শব্দের দরকার হয় না।

লেখকের সব লেখা

কলেজ জীবনে একজন শিক্ষিকার কাছে শুনেছিলাম, “অন্যায় দেখলে কেউ প্রতিবাদ না করুক তুমি করো, কেউ স্পষ্ট কথা না বলুক তুমি বলো, দেখবে, ওই ধার্মিকদের ভিড়ে দাঁড়ানো স্রস্টা তোমার দুয়ারে একবার হলেও আসবেন।” কথাটা শুধু শোনার জন্য শোনা হয়তো হয়নি, ধারণ করা হয়ে গিয়েছিলো। আরেকবার জনৈক একজন ভালো মানুষের মুখে শুনেছিলাম, “অন্যায়ের প্রতিবাদ করা মানুষদের সাথে অন্যায় হয় এক-দুই বা তিন বার, কিন্তু অন্যায়কারীর সাথে হয় বারবার।” জানি না, এর সত্য কতটুকু। তবে এইটুকু বুঝতে পারছি, স্রস্টা এই মিথ্যা পুঁজি করা ধার্মিক (মনে হয় বা হয়তো) আর স্পষ্টভাষী অধার্মিকদের মাঝে জান্নাতী কারা হবেন তা নিয়ে বড্ড বিপাকে আছেন…

জান্নাতুল কারার তিথি : এডভোকেট, ঢাকা জজ কোর্ট

ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম

ট্যাগ: জান্নাতুল কারার তিথি

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply