সোমবার সকাল ৭:৩৩, ১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২৯শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং

এভাবেই যাবে আমাদের দিনকাল?

জাকির মাহদিন

অযোগ্য লোকেরা প্রচুর ঘুষ দিয়ে চাকরিতে ঢুকছে। ঢুকে সেসব উসুল করছে। তার উপর স্থানীয় ‘ঘনিষ্ঠদের’ নিয়মিত চাঁদা দিতে হয়। নইলে চাকরি নিয়ে টানাটানি। কিন্তু সব অন্যায়-অপকর্মের সর্বশেষ ও চূড়ান্ত ধাক্কাটা গিয়ে পড়ে জনসাধারণের ওপর।

যেদিকে তাকাই সব হায়েনার দল/ চারিদিকে রাবণ-অসূরের প্রভাব-প্রবল/ মজলুমের কান্না-হাহাকার গগণবিদারী/ নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস-ক্রন্দনে বাতাস ভারী/ এবার তোল আওয়াজ, কর জালেম খতম/ গর্জে ওঠো যতসব বজ্র-কলম/ হত্যা, গুম, লুটতরাজ করছে যে-বা/ এত অন্যায়-অবিচার সহিবে কে-বা/

সবাই সয়েই যাচ্ছে, নিরবে-সরবে। চোখের সামনে সীমাহীন অন্যায় অবিচার। কোনো বাদ-প্রতিবাদ নেই। যদি-বা কখনো বাদ-প্রতিবাদ ও আন্দোলন-সংগ্রম গড়ে উঠে, চারদিকের স্বার্থবাদী মহলগুলো তা হাইজ্যাক করে নেয়। আর কিছু কথিত আন্দোলন-সংগ্রাম আছে যা গড়েই উঠে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে। সুতরাং তা বেশিদূর এগুতে পারে না।

প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কি এভাবেই যাবে আমাদের দিনকাল? ক্রমাগত বাড়বে মিথ্যা ও অসূরের রাজত্ব? কিন্তু কেন? সত্য ও ন্যায়ের সামনে তো মিথ্যা মাথা নুইয়ে পড়ার কথা, পড়তে বাধ্য। যেহেতু সেটা হচ্ছে না, বোঝা গেল সত্য ও ন্যায়ের ‘দাবিদারদের’ মধ্যে সমস্যা আছে। তা ঠিক হয়ে গেলেই প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ও আন্দোলন-সংগ্রাম সঠিক লাইন-লেন্থে এগুবে।

কেমন সময় এলো আজ, মনে হচ্ছে সন্ত্রাসী ও ব্ল্যাকমেইল করা ছাড়া সাংবাদিকের মূল্য নেই, রাজনীতিতে নাম লেখানো ছাড়া ব্যবসায়ের পথ নেই, সিন্ডিকেটের সঙ্গে হাত মেলানো ছাড়া একাকী ভাত নেই, সরকারি কর্মকর্তা-প্রশাসনকে ঘুষ দেয়া ছাড়া গতি নেই। আর সার্বিকভাবে জীবন-জীবিকার কোনো নিরাপত্তা নেই। তথাকথিত গণতন্ত্রের ধাক্কায় ‘উন্নয়নের সড়ক-মহাসড়ক’ থেকে ছিটকে পড়ছে শিক্ষিত লাখো তরুণ। দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে দলে দলে। কেউ গলায় ফাঁস দিচ্ছে। যুবসমাজ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে।

প্রচুর শিক্ষিত, দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ চাকরি হারিয়েছে, পথে বসেছে। অন্যদিকে ঘুষ-দুর্নীতি-তদবির দ্বারা কতিপয় অযোগ্য-অদক্ষ-অসৎ-অল্পবয়েসী এখন ‘বড় কর্তা’। পদে বসেই ধুম-ধারাক্কা অন্যায়-অপরাধ এমনকি খুন-গুম। এসব হচ্ছে কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায়। দেখার কেউ নেই, বলার কেউ নেই। প্রতিবাদ তো দূরের কথা। প্রত্যেকেই নিজের গদি রক্ষার্থে ব্যস্ত। সর্বত্র সিন্ডিকেট। রাষ্ট্রের সর্বনিম্ন কর্মচারী থেকে সর্বোচ্চ পদাধিকারী পর্যন্ত সিন্ডিকেট ও বিশেষ মহলের কাছে বাঁধা। তাই অনেক ক্ষেত্রে ইচ্ছে থাকলেও ঊর্ধ্বতন ব্যক্তি পদক্ষেপ নিতে পারেন না। ইচ্ছে না থাকলে তো কথাই নেই।

কেন এমন হচ্ছে? এর শেষ কোথায়? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম, হাসপাতালে অব্যবস্থাপনা, সাংবাদিকতায় সিন্ডিকেট নির্লজ্জ দালালী, অফিস-আদালতে ঘুষ-দুর্নীতি, পুলিশ-প্রশাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের অভিযোগের পাহাড়। চিহ্নিত ব্যক্তিদের ব্যাপারেও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না অথবা নেয়া হচ্ছে না। তারা যেন দেখেও দেখছে না। এসব সমস্যার ফিরিস্তি আর কত? দিয়ে লাভ কী? প্রশ্ন হচ্ছে, এ সীমাহীন দুর্ভোগ-হতাশা ও জুলুম-নির্যাতন থেকে বাঁচার কোনো পথ সাধারণ মানুষের জন্য আছে কি না? থাকলে সেটা কী এবং কীভাবে?

একটি সদর থানার প্রধান কর্মকর্তার যদি স্থানীয় চাঁদাবাজ, অবৈধ ব্যবসায়ী, চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও রাজনৈতিক সুবিধাবাদীদের সঙ্গে দহরম-মহরম এমনকি প্রকাশ্য চলাফেরা-ওঠাবসা থাকে তাহলে সে শহরের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও অন্যান্য অবস্থা কেমন হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। এটা নির্দিষ্ট কোনো জেলা-শহরের চিত্র নয়, দেশের প্রায় সব জায়গায় একই অবস্থা। অযোগ্য লোকেরা প্রচুর ঘুষ দিয়ে চাকরিতে ঢুকছে। ঢুকে সেসব উসুল করছে। তার উপর স্থানীয় ‘ঘনিষ্ঠদের’ নিয়মিত চাঁদা দিতে হয়। নইলে চাকরি নিয়ে টানাটানি। কিন্তু সব অন্যায়-অপকর্মের সর্বশেষ ও চূড়ান্ত ধাক্কাটা গিয়ে পড়ে জনসাধারণের ওপর। এক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি অনেকটা সৎ ও চৌকস হলে কিছুটা রক্ষে। নইলে জনগণের দুঃখ-কষ্টের শেষ নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, অফিস-আদালত, প্রশাসনে বিশেষ পরিচয়ে খুবই সামান্যসংখ্যক মানুষ বেঁচেবর্তে আছে বৈকি! বাকিদের অবস্থা বর্ণনা ও উপলব্ধির অতীত। এসব কার কাছে বলা যায়? বললে কোনো লাভ আছে কী?

সন্ত্রাস-অপরাধী-দুর্বৃত্ত-দুর্নীতিবাজদের সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে সহসা, আপনা থেকেই। এদের মধ্যে পারস্পরিক অঘোষিত, অলিখিত একটা সমন্বয়-সমঝোতা ও নিয়ম-শৃঙ্খলা গড়ে ওঠে বিশেষ চিন্তা-চেতনা ও চেষ্টা-তদবির ছাড়াই। তাছাড়া এদের রক্ষার্থে কায়েমি স্বার্থবাদী এবং রাষ্ট্রশক্তিসহ অনেক বড় বড় দল-গোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ, সংগঠিত। অন্যদিকে সৎ, ন্যায়নিষ্ঠ ও আদর্শিক ব্যক্তিদের মধ্যে মতবিরোধ-বিশৃঙ্খলা ও সমন্বয়হীনতার অন্ত নেই। কেন? কারণ দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত অন্যায়-অপরাধকে যে মাত্রার সততা ও ন্যায়-নিষ্ঠতার শক্তি দ্বারা ধাক্কা দেয়া দরকার তা খুব কম মানুষেরই আছে। এবং যাদের আছে তারা আবার এসব ‘বাৎচিতে’ অনাগ্রহী।

এভাবেই প্রতিবার স্বল্পস্থায়ী শান্তিপূর্ণ সমাজ ও কালের পর, দীর্ঘ সময়ের জন্য গড়ে ওঠে মিথ্যার রাজত্ব। সহসা এটাকে ভেঙ্গে দেয়া সম্ভব হয় না। আবার না ভেঙ্গেও উপায় নেই। কারণ এদের জুলুম-অত্যাচারের মাত্রা কোনো এক জায়গায় থেমে থাকে না। সব জায়গায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং গুণীতক হারে বাড়তে থাকে।

জাকির মাহদিন : লেখক, কলামিস্ট

zakirmhdin@yahoo.com

ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম,  সম্পাদকের কলাম

ট্যাগ:

[sharethis-inline-buttons]

২ responses to “এভাবেই যাবে আমাদের দিনকাল?”

  1. solaiman library says:

    আপনি যা লিখেছেন তা বাস্তব সত্য। আর এ সত্যের মুখোমুখিই আমরা প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে হচ্ছি। আর সমাধানও আপনি দিয়েছেন বলেছেন । এ অবস্থা পরিবর্তন করতে হবে। বুঝলাম কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাধবে কে?

Leave a Reply