শুক্রবার বিকাল ৪:৫৫, ৩রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ১৭ই মে, ২০২৪ ইং

উত্থাপিত সড়ক পরিবহন বিল চরম জটিলতাপূর্ণ

বিলের বিবরণ দেখে রীতিমতো বিশ্রেষকগণ মনে করছেন, সরকারি তহবিল পূর্ণ করার আরেকটা নতুন ফাঁদ- ২০১৮ এর সড়ক পরিবহন বিল। এছাড়াও তারা বলছেন, শুধু সরকারি তহবিল নয়, কিছু সরকারি কর্মকর্তার ব্যক্তিগত তহবিলও পরিপূর্ণ হবে এতে। যারা ক্ষমতাশীল, তাদের মাঝে নীতি-পরায়ণতার অভাবে দেশে যখনই কোনো উন্নত সেবা প্রদানের লক্ষ্যে নিয়ম-নীতি প্রণয়ন করা হয়, তখনই তারা তাদের দুর্নীতির হাতকে প্রসারিত করে।

শরীফ উদ্দীন রনি : অতীতের মতো এখনো অপরাধকে ‘আইন’ দ্বারা প্রতিহতের অপচেষ্টা চলছে। দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা ‘সড়ক নিরাপত্তা আন্দোলনকে’ দমানোর এর চেয়ে ভালো উপায় আর কী হতে পারে! কোনো নিয়ম কানুন-ছাড়া অতিসহজেই অর্থের বিনিময়ে অল্প সময়ে অল্প পরিশ্রমে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া যায়। আবার অর্থ ছাড়া সকল কাগজপত্র ঠিকঠাকভাবে জমা দিয়েও ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে গিয়ে চালকদের হিমশিম খেতে হয়।

শুধু যে পরিবহন ক্ষেত্রে এমন তা নয়, বাংলাদেশের প্রায়ই সকল সেক্টরের অবস্থাই এমন। এমতবস্থায় কী করে সড়ক পরিবহন বিল ২০১৮ কাগজপত্রের উপর জোর প্রধান করে প্রনয়ণ করা হলো? হাজারো প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে সংসদে উত্থাপিত ‘সড়ক পরিবহন বিল ২০১৮’। আবান্তর কিছু বিষয় যোগ করা হয়েছে এ বিলে, যা আবার ক্ষেপিয়ে তুলতে পারে গাড়ির চালক ও সহকারীদের।

গত ১৩ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হয়েছে বহুল আলোচিত সড়ক সড়ক পরিবহন বিল-২০১৮। কিন্তু এটা চরম জটিলতাপূর্ণ বলে মন্তব্য করছেন বিশ্লেষকগণ। তারা মনে করছেন, এতে সমস্যা সমাধান হবে দূরের কথা, বরং আরো সমস্যা সৃষ্টি হবে এবং জটিলতাও তৈরি করবে চরমভাবে। অন্যদিকে ড্রাইভার-কন্ট্রাক্টররা বলছেন, তারা এর আগা-মাথা কিছুই বুঝেন না। এছাড়াও বিলটি একেবারেই অস্পষ্ট বলে অনেকে জানাচ্ছেন।

সকল পেশায় দক্ষতা অর্জনের পূর্বশর্ত হলো উন্নততর প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যে কাজ সহজে আয়ত্ব করা যায়, তাতে স্কুল-কলেজ-মাদরাসার প্রচলিত শিক্ষা সহায়ক ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ। আজকের বাস্তবতা এ কথা বার বার আমাদের নিকট প্রমাণ করে দিচ্ছে। অন্যদিকে প্রচলিত শিক্ষা মানুষকে যেভাবে গড়ে তুলছে, তাতে মনে হয় ১ম শ্রেণি পাস করা কোনো লোকও পিয়নের চাকরিই করতে ইচ্ছুক হবে না। সেখানে কী করে ৫ম শ্রেণি পাস করা একজন লোক ড্রাইভারের এসিস্ট্যান্ট হবেন বলে আশা করা যায়? অন্যদিকে শুধু অষ্টম শ্রেণি পাস করা লোকই নয়, অক্ষরজ্ঞানহীন লোকও যোগ্যতাবলে অনেক ক্যারিশমিটিক কাজ করতে পারে। সেখানে তাহলে কেন গাড়ির চালক হতে হলে অষ্টম শ্রেণি পাস হওয়া জরুরি? অনেকের মনেই এমন প্রশ্নও জন্ম নিচ্ছে।

এ দিকে প্রতিটি সেক্টরই একে অপরের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। তাই কোনো বিল উত্থাপনের পূর্বে অব্যশই সার্বিকভাবে বিবেচনা করা জরুরি। শুধু একটি সেক্টরের কথা ভেবে বিল উত্থাপন করা অনেকটা কানামাছি খেলার মতোই। সামনে যা পাওয়া যায় তাই ধরতে হয়। এতো কগজপত্র করার ঝামেলা কীভাবে সহজ করা যায়, সে বিষয় নিয়ে এখনো পর্যন্ত কোনো মতামত প্রদান করা হয়নি। অন্যদিকে গাড়ি চালকদের মনে প্রশ্ন, যেখানে বৈধভাবে কাগজপত্র জমা দিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে নাকানি-চুবানি খেতে হয়, সেখানে দেশের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্থ সেক্টর শিক্ষাবিভাগ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তাদের অধীনে পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র সংগ্রহ করতে গিয়ে না জানি কতটা হয়রানির শিকার হতে হয়।

বিলে শুধু অর্থকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে বেশি। সড়ক অনিরাপদ হয় শুধু উন্নততর ব্যবস্থার অভাবের কারণেই, সেটা ভুল ধারণা। চালকদের উন্নত প্রশিক্ষণ ও রাস্তার উপযোগী যানবাহন না হলেও সড়ক অনিরাপদ হতে বাধ্য। এছাড়াও পথচারীর পথ পারাপারে অসচেতনতা, ঝুঁকিপূর্ণ ও অনুন্নত সড়ক, ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্বে অবহেলা, চালকদের অসচেতনতার মতো বহু বিষয় জড়িয়ে আছে।

বিলের বিবরণ দেখে রীতিমতো বিশ্রেষকগণ মনে করছেন, সরকারি তহবিল পূর্ণ করার আরেকটা নতুন ফাঁদ- ২০১৮ এর সড়ক পরিবহন বিল। এছাড়াও তারা বলছেন, শুধু সরকারি তহবিল নয়, কিছু সরকারি কর্মকর্তার ব্যক্তিগত তহবিলও পরিপূর্ণ হবে এতে। যারা ক্ষমতাশীল, তাদের মাঝে নীতি-পরায়ণতার অভাবে দেশে যখনই কোনো উন্নত সেবা প্রদানের লক্ষ্যে নিয়ম-নীতি প্রণয়ন করা হয়, তখনই তারা তাদের দুর্নীতির হাতকে প্রসারিত করে। সেক্ষেত্রে অর্থকে প্রাধান্য না দিয় ন্যায়-নিষ্ঠা, উন্নততর প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার দিকে নজর দেওয়া উচিত ছিল বলে অনেকে মন্তব্য করছেন।

বিদ্যমান আইনের ১১৭টি ধারা ও ১২টি তফসিলের স্থলে ১৪টি অধ্যায়ে ১২৬টি ধারা রয়েছে। নিরাপদ সড়ক পরিবহন ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণের জন্য মাঝেমাঝে এক বা একাধিক বিষয়ে আদেশ দেওয়া ও নীতিমালা প্রণয়নের বিধান রাখা হয়েছে এই বিলে। ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা অন্যূন ৮ম শ্রেণি বা সমমান রাখাসহ প্রতিবন্ধীবান্ধব মোটরযান প্রবর্তন এবং গণপরিবহনে নারী, শারীরিক প্রতিবন্ধী, বয়স্ক ব্যক্তি ও শিশুদের জন্য আসন সংখ্যা নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে। যা আগেও ছিল। পরিবহন সেক্টরে উন্নত সেবার জন্য জিডিটালাইজেশন কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়নসহ সরকারি কর্মচারীদের অর্পিত দায়িত্ব পালনে অবহেলা বা ত্রুটিপূর্ণভাবে পালনের কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে বা কোনো সড়কের ডিজাইন বা নির্মাণ বা রক্ষণাবেক্ষণজনিত বা তদারকির ওপর বর্তাবে এবং প্রচলিত আইনে বিধান হবে। কোনো ব্যক্তির বেপরোয়া ও অবহেলাজনিত গাড়ি চালানোর কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে এবং সেই দুর্ঘটনায় কেউ আহত বা নিহত হলে সর্বোচ্চ ৫ বছর কারাদণ্ড বা ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে সড়ক পরিবহন বিল-২০১৮ উত্থাপন করা হয়েছে। এই বিলে এমন আরো বহু বিধান রয়েছে যা শুধু মাত্র কাগজে কলমে পাস হলেও বাস্তবে তার ছিটেফোটাও দেখা যায় না।

ক্যাটাগরি: প্রতিনিউজ,  প্রধান খবর

ট্যাগ:

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply