শুক্রবার দুপুর ১:২১, ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ. ২৯শে মার্চ, ২০২৪ ইং

শিক্ষায় নারী ও ইসলাম

সোহাগ জাকির

মানব সমাজের সার্বিক উন্নতি ও কল্যাণের জন্য শিক্ষা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শিক্ষা ব্যতীত কোনো জাতি, গোষ্ঠী, ব্যক্তিই তার প্রকৃত অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না। জাতি হারিয়ে ফেলে তার মেরুদণ্ড। আর অশিক্ষা ও কুশিক্ষার কুফলে পড়ে দেশ জাতি তথা সমাজব্যবস্থায় নেমে আসে অমানিশার ঘোর অন্ধকার। যার কারণে পবিত্র কোরআন পাকে বর্ণনা করা হয়েছে- ‘তালাবুল ইলমি ফরিদাতুন আ’য়ালা কুল্লি মুসলিমিন’- অর্থাৎ প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য জ্ঞান অন্বেষণ ফরজ।

ফেরাউন যখন নিজেকে খোদা বলে দাবি করেছিল তখন তার দেশের অধিকাংশ প্রজা তাকে খোদা বলে মেনে নিতে রাজি ছিল না। এরাই ছিল শিক্ষিত সমাজের প্রজা। ফেরাউন যখন এর কোনো সমাধান খুঁজে পাচ্ছিল না, তখন তার প্রধান উপদেষ্টা হামানকে ডেকে বলেছিল, ‘তুমি তো আমার প্রধান উপদেষ্টা এবং এ দেশের সবচেয়ে বিচক্ষণ ব্যক্তি। কাজেই তুমি সিদ্ধান্ত দাও কী কাজটা করলে এ দেশের শতভাগ নাগরিক আমাকে খোদা বলে মেনে নেবে।’ হামান কিছুক্ষণ চিন্তার পরে সিদ্ধান্ত দিয়েছিল এবং বলেছিল- ‘হুজুর, এর একটিমাত্র উপায় হলো- এ দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ করে দিতে হবে এবং দেশের লাইব্রেরিগুলোতে যতগুলো জ্ঞানসমৃদ্ধ বই-পত্র রয়েছে সেগুলো মিশরের নীলনদে ফেলে দিতে হবে। তাহলে দেখবেন এ দেশের প্রতিটি নাগরিক যখন শিক্ষার আলো থেকে চূড়ান্তভাবে বঞ্চিত হবে, তখন তারা গোমরাহির কারণে আপনাকে খোদা বলে মেনে নিতে বাধ্য হবে।’

ইসলাম আবির্ভাবের পূর্বে গোটা পৃথিবী ছিল অন্যায়-অত্যাচার, অবিচার-অশ্লীলতায় পূর্ণ; নারী জাতির প্রতি চরম অবজ্ঞা ও অবহেলা ছিল। নারীরা ছিল পুরুষদের ভোগ্যপণ্য। নবী কারিম (সা.)-এর জন্মের পরে অর্থাৎ তার নবুয়তপ্রাপ্তির পূর্বেও কন্যাসন্তান জন্ম নিলে তাকে জীবন্ত কবর দেওয়া হতো। নতুবা আঁতুড়ঘরে গলা টিপে তাকে হত্যা করা হতো।

হামানের এই কুপ্রস্তাবে ফেরাউন খুশি হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে দেশব্যাপী ফরমান জারি করে- জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল কিতাব মিশরের নীলনদে ফেলে দিতে হবে। এর ফলে ধীরে ধীরে সমগ্র জাতি যখন শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়ে গোমরাহির অতল তলে নিমজ্জিত হয়ে ফেরাউনকে খোদা হিসেবে মেনে নেয়।

এ তো হলো সর্বজনীন শিক্ষার বা শিক্ষাব্যবস্থার কথা। এখন আসুন, নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্বের কথা আলোচনা করি। ইসলাম আবির্ভাবের পূর্বে গোটা পৃথিবী ছিল অন্যায়-অত্যাচার, অবিচার-অশ্লীলতায় পূর্ণ; নারী জাতির প্রতি চরম অবজ্ঞা ও অবহেলা ছিল। নারীরা ছিল পুরুষদের ভোগ্যপণ্য। নবী কারিম (সা.)-এর জন্মের পরে অর্থাৎ তার নবুয়তপ্রাপ্তির পূর্বেও কন্যাসন্তান জন্ম নিলে তাকে জীবন্ত কবর দেওয়া হতো। নতুবা আঁতুড়ঘরে গলা টিপে তাকে হত্যা করা হতো।

এটা ছিল আইয়ামে জাহিলিয়াত অর্থাৎ অন্ধকার যুগের জঘন্যতম প্রথা। কিন্তু নবুয়তপ্রাপ্তির সাথে সাথে রসুলে আকরাম (সা.) নারী জাতিকে মর্যাদার উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করলেন। তাই পবিত্র কোরানের প্রথম শব্দটি ছিল ‘ইকরা’ অর্থাৎ পড়ো। আর তাই মহান রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআনপাকে ঘোষণা দিলেন, “প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য জ্ঞান তলব করা ফরজ।”

ইসলাম নারী-পুরুষ সকলের জন্য শিক্ষাব্যবস্থার দ্বার উন্মুক্ত করেছে। কিন্তু কিছুসংখ্যক ধর্মান্ধ জ্ঞানপাপী তথাকথিত ‘আলেম’ নামধারী নারী শিক্ষাকে না-জায়েজ আখ্যা দিয়ে তাদের ঘরের চার দেয়ালে বন্দি করে রাখার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। জানি না তারা এটা কোন হাদিস বা ধর্মগ্রন্থ থেকে চয়ন করেছে- নারীরা শিক্ষিত হতে পারবে না; তারা শিক্ষিত হলে দেশ ও জাতি গোল্লায় যাবে। এটা তাদের মনোস্তাত্ত্বিক ধ্যান-ধারণা ছিল বলে আমার মনে হয়।

কারণ হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে- ১. নারীরা শিক্ষিত হলে এরা ঘরের বাইরে যেতে চাইবে, তখন হয়তো তাদের পরিভাষায় ইসলাম বিপন্ন হবে। ২. নারীরা শিক্ষিত হলে তারা পুরুষদের অবাধ্য হবে। ৩. পুরুষরা নারীকে নিজের ইচ্ছেমতো যখন তখন সেবাদাসী হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। আরো অনেক কারণে নারীদের শিক্ষার পথ রুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। আমাদের দেশে ব্রিটিশ শাসনামলেও বাঙালি নারীর বাংলা ভাষায় পড়ালেখা করা নিষিদ্ধ ছিল। এ অচলায়তন ভাঙতে ভূমিকা রেখেছিলেন রংপুরের পায়রাবন্ধ গ্রামের বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন।

ইসলাম নারী-পুরুষ সকলের জন্য শিক্ষাব্যবস্থার দ্বার উন্মুক্ত করেছে। কিন্তু কিছুসংখ্যক ধর্মান্ধ জ্ঞানপাপী তথাকথিত ‘আলেম’ নামধারী নারী শিক্ষাকে না-জায়েজ আখ্যা দিয়ে তাদের ঘরের চার দেয়ালে বন্দি করে রাখার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। জানি না তারা এটা কোন হাদিস বা ধর্মগ্রন্থ থেকে চয়ন করেছে- নারীরা শিক্ষিত হতে পারবে না; তারা শিক্ষিত হলে দেশ ও জাতি গোল্লায় যাবে।

নারী জাতির শিক্ষার গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা ইসলামই সর্বপ্রথম দিয়েছিল। নারীরাই সন্তান জন্মের পর তার সন্তানের যাবতীয় শিক্ষার ভার গ্রহণ করে থাকে। সেই শিশুটির সেবা-যত্ন, খাওয়া-দাওয়া, আচার-আচরণ, আদব-কায়দা শিক্ষা দেওয়া সম্পূর্ণ নির্ভর করে শিশুর মায়ের ওপর। কাজেই সুশিক্ষিত মা না হলে সুসন্তান কখনোই হতে পারে না। সে কারণেই নেপোলিয়ান বোনাপার্ট বলেছিলেন- ‘যদি তোমরা আমাকে একজন ভালো (শিক্ষিতা) মা দাও, আমি তোমাদের একটি ভালো জাতি উপহার দেবো’। এ উক্তির বিচার-বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে, নারী জাতি শিক্ষিত না হলে পুরো জাতিই অশিক্ষা ও কুশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে থাকবে।

ইসলাম কখনোই নারীশিক্ষার বিরোধিতা করেনি, বরং নারীশিক্ষাকে উৎসাহিত করেছে। তাই আসুন, আমরা সবার আগে নারী জাতিকে শিক্ষিত করি এবং নারীকে শুধু সেবাদাসী বা ভোগ্যপণ্যের বস্তু হিসেবে ব্যবহার না করে তাকেও মানুষ হিসেবে মর্যাদা দান করি।

সোহাগ জাকির : অনলাইন এক্টিভিস্ট

ক্যাটাগরি: ধর্ম-দর্শন-বিজ্ঞান,  মিনি কলাম

ট্যাগ:

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply