শুক্রবার সকাল ১০:৫৪, ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং

ক্ষমা কী ও কেন?

ড. এমদাদুল হক

ক্ষমা মহত্ত্বের লক্ষণ। কেন? কারণ, ক্ষমার মাধ্যমে অহং ও স্বার্থের উপর আঘাতকে প্রতিহত করা হয়। তাই ক্ষমার পর্যায়ক্রমিক অনুশীলনে অহংভাব দূর হয়, স্বার্থবাদিতা দূর হয় এবং ধীরে ধীরে উদারতা ও মহত্ত্ব প্রকট হয়। পক্ষান্তরে, ক্ষমার স্থলে যদি শাস্তি প্রদান কিংবা প্রতিশোধ নেওয়া হয়, তবে অহং বৃদ্ধি পায় এবং ব্যক্তিস্বার্থের উৎকট গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। এমনটি যারা করে, তারা কখনো সরল পথের সন্ধান পায় না। জীবন তাদেরকে নিয়ে যায় দুর্গম গিরিপথে, যেখানে পদে পদে থাকে বিপদের আশঙ্কা ও পতনের ভয়। শুধুমাত্র নিঃশর্ত ক্ষমা ও সহযোগিতার মাধ্যমেই জীবন সৌন্দর্যমণ্ডিত হয় এবং প্রশান্তির স্পর্শ পাওয়া যায়।

যে প্রকৃতই বিনয়ী, যার অহংবোধ থাকলেও দুর্বল সে ব্যক্তিগত আক্রমণে আঘাতপ্রাপ্ত হয় না; সে প্রতিশোধ নিয়ে শত্রু বাড়ানোর উদ্যোগ নেয় না, বরং সমন্বয় করে মিত্রতার পথে অগ্রসর হয়। কারোর উপর প্রতিশোধ নেওয়ার মানেই হলো মূর্খতার স্তরে পতিত হওয়া। ক্ষমা হচ্ছে নিজের বিপক্ষে যাওয়া সত্ত্বেও তার বিপক্ষে না যাওয়া। কারো বিপক্ষে গেলে নিজের পক্ষে অগ্রসর হওয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই ক্ষমা শুধু মহত্ত্ব নয়- আত্মবিকাশের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গও বটে।

ক্ষমা না করে ক্রোধ ও প্রতিশোধের স্পৃহা পুষে রাখলে নিজেরই বেশি ক্ষতি হয়। অগ্নি তো উনুনকেই জ্বালায় সবচেয়ে বেশি। তাই ক্ষমা করে দেয়া কাউকে কিছু দেয়া না, এটি নিজেকেই দেয়া। যে যা করে তা তারই। যদি কেউ আমার সঙ্গে অন্যায় করে থাকে, তবে এটি তার কর্ম। আমি যদি ক্ষমা করে দেই, তবে তা আমার কর্ম। যেমন কর্ম, তেমন ফল। শত্রুতা দ্বারা শত্রুতা প্রশমিত হয় না, মিত্রতা দ্বারা শত্রুতা প্রশমিত হয়। রক্ত দ্বারা ওজু করা যায় না। অপবিত্রতা দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করা যায় না।

আজ যে আমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী, আমাকেও তার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী হওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। তাই ক্ষমা করে দেওয়ার মাধ্যমে ক্ষমা পাওয়ার পথটি প্রশস্ত রাখা উত্তম। ভুলের উপলব্ধি ও ভুল সংশোধন করার আন্তরিক প্রচেষ্টা ব্যতীত ক্ষমা চাওয়া আত্মপ্রবঞ্চনা। যে ব্যক্তি বারবার একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করে, আর বারবার ক্ষমা প্রার্থনা করে, সে আসলে ক্ষমা চায় না, অপরাধের মেয়াদ বৃদ্ধি করে। এমন মানুষ দিনে ৫বার ক্ষমা চায় কিন্তু একবারও অপরাধ থেকে বিরত থাকে না। তারা সারাজীবন ক্ষমা চাইলেও যেমন ছিল তেমনই থেকে যায়।

যে প্রকৃতই বিনয়ী, যার অহংবোধ থাকলেও দুর্বল সে ব্যক্তিগত আক্রমণে আঘাতপ্রাপ্ত হয় না; সে প্রতিশোধ নিয়ে শত্রু বাড়ানোর উদ্যোগ নেয় না, বরং সমন্বয় করে মিত্রতার পথে অগ্রসর হয়। কারোর উপর প্রতিশোধ নেওয়ার মানেই হলো মূর্খতার স্তরে পতিত হওয়া। ক্ষমা হচ্ছে নিজের বিপক্ষে যাওয়া সত্ত্বেও তার বিপক্ষে না যাওয়া।

মানুষ কার ক্ষতি সবচেয়ে বেশি করে? কার সঙ্গে সবচেয়ে বেশি অপরাধ করে? মানুষ নিজেই নিজের ক্ষতি করে সবচেয়ে বেশি। মানুষ নিজেই নিজের বিপক্ষে যায় সবচেয়ে বেশি। মানুষ নিজের সঙ্গেই নিজে অপরাধ করে সবচেয়ে বেশি। তাই নিজের কাছে নিজে ক্ষমা চাওয়া এবং নিজেকে নিজে ক্ষমা করা চাই সর্বাগ্রে। নিজেকে ক্ষমা না করা পর্যন্ত অন্যকে ক্ষমা করার যোগ্যতা অর্জন করা যায় না।

‘আমি নিজেকে ক্ষমা করে দিলাম’- এটি বললেই কি নিজেকে ক্ষমা করা হয়? হয় না। নিজেকে ক্ষমা করতে হলে প্রথমে আন্তরিকভাবে স্বীকার করতে হয় যে, আমি ভুল করেছি। এবং এমন কিছু করতে হয়, যাতে ঐ ভুলের সংশোধন হয়, ক্ষতিপূরণ হয় ও নিজেকে ক্ষমা করার ক্ষেত্রটি প্রশস্ত হয়। যদি নিজেকে ক্ষমা করা যায়, তবে পাপবোধ দূর হয়। তাই নিজেকে শুদ্ধ রাখার একমাত্র পথ ক্ষমা। নিজেকে ক্ষমা করা মানে নিজেকে ভালোবাসা। প্রতিবেশীকে ভালোবাসা ভালো, শত্রুকে ভালোবাসা আরো ভালো কিন্তু নিজেকে ভালোবাসা সবার উপরে।

যে নিজেকে ভালোবাসে সে নিজেকে শাস্তি দেয় না, নিজের সঙ্গে নিজে মিথ্যা বলে না। নিজে নিজের ক্ষতি করে না। যে নিজেকে ক্ষমা করতে পারে না, সে কীভাবে আশা করতে পারে যে ঈশ্বর তাকে ক্ষমা করবেন? যে নিজেকে ভালোবাসতে পারে না, সে কীভাবে আশা করতে পারে যে, ঈশ্বর তাকে ভালোবাসবেন? ক্ষমা ঐশ্বরিক গুণ। ঈশ্বর পরম ক্ষমাশীল। তিনি নিজে ক্ষমা করেন আর আশা করেন, আমরাও যেন এমনটা করি। যদি কেউ ক্ষমা চায়, তবে তাকে ক্ষমা করে দেই এবং নিজের মধ্যে ঐশ্বরিক গুণ অনুভব করি। যদি কোনো ব্যক্তির কাছে অপরাধ করে থাকি, তবে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে কোনো লাভ হবে না।

যতক্ষণ পর্যন্ত ক্ষমা চাওয়ার এবং ক্ষমা করার বিষয় আছে ততক্ষণ পর্যন্ত অপরাধবোধ ও বিচারও আছে। তার মানে, বিচার তিনিই করতে পারেন যার মধ্যে দ্বৈততা আছে- যিনি ভালোকে ভালোবাসেন আর মন্দকে ঘৃণা করেন এবং মন্দকে শাস্তি দিতে সক্ষম।

আল্লাহর কাছে সেই অপরাধগুলোর ক্ষমা চাওয়া বিধেয়, যা তার কাছে করা হয়েছে। ব্যক্তির কাছে অপরাধ করলে ব্যক্তির কাছে ক্ষমা চাওয়া বিধেয়। সন্তানের সব অপরাধ মাতাপিতা ক্ষমা করে দেন, কারণ সন্তানের প্রতি মাতাপিতার প্রেমে কোনো খাদ নেই। যেখানে প্রেম আছে সেখানে অপরাধকে অপরাধ মনেই হয় না। ক্ষমা প্রেমেরই আরেক নাম। প্রেমহীন ক্ষমা অহং বৃদ্ধির কৌশল মাত্র। প্রথমে বিচার এরপর ক্ষমা- অহং-এর রাজনীতি। অহং খুবই ফন্দিবাজ। কখনো কখনো সে ক্ষমা প্রদর্শন করে নিজেকে আরো শক্তিশালী করার জন্য, বাহবা পাওয়ার জন্য কিংবা পরবর্তী আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। সুবিধা মতো অহং বিবৃতি দেয়- ‘এটি ক্ষমার অযোগ্য’।

যে ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য, তাকে ক্ষমা করার মধ্যে মহত্ত্ব কোথায়? প্রাপ্য দিলে কি আর মহত্ত্ব হয়? মহত্ত্ব তখনই হয় যখন ক্ষমার অযোগ্যকেও ক্ষমা করা যায়। কে ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য, আর কে অযোগ্য- এটি বিচার্য বিষয় নয়, বিচার্য বিষয় হলো- আমি ক্ষমা করার মতো যোগ্যতা অর্জন করেছি কিনা, আমি প্রেমময় হতে পেরেছি কিনা। আমি মানুষকে ভালোবাসতে পারছি কিনা যেভাবে নিজ সন্তানদের ভালোবাসি। কাউকে ক্ষমা করার জন্য তাকে বিচার করতে হয়। কারো কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্যও নিজের বিচার করতে হয়। নিজেকে ক্ষমা করতে হলেও নিজের বিচার নিজে করতে হয়।

যতক্ষণ পর্যন্ত ক্ষমা চাওয়ার এবং ক্ষমা করার বিষয় আছে ততক্ষণ পর্যন্ত অপরাধবোধ ও বিচারও আছে। তার মানে, বিচার তিনিই করতে পারেন যার মধ্যে দ্বৈততা আছে- যিনি ভালোকে ভালোবাসেন আর মন্দকে ঘৃণা করেন এবং মন্দকে শাস্তি দিতে সক্ষম। যিনি এক, ভালো-মন্দের দ্বৈততা থেকে যিনি মুক্ত, তিনি বিচার করবেন কী প্রকারে?

. এমদাদুল হক : লেখক, সমাজচিন্ত্যক

 

ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম

ট্যাগ:

[sharethis-inline-buttons]

One response to “ক্ষমা কী ও কেন?”

  1. খায়রুল আকরাম খান says:

    ক্ষমা মানব জীনের মহৎ গুন। ক্ষমার কোন বিকল্প নাই। বার বার ক্ষমা করা উচিত নয়। ব্যক্তির কাছে ক্ষমা চাইলে ক্ষমা পাওয়া যায়;কিন্তু অনেক সময় অাদাতের কাছে ক্ষমা চাইলে চড়ম শাস্তি পেতে হয়।সেই সময় ব্যক্তির কি করা উচিত তা অালোকপাত করা হয়নি।

Leave a Reply