শুক্রবার বিকাল ৫:৩২, ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং

প্রশ্নবিদ্ধ ‘কওমি শিক্ষা’ ও ‘কওম’ এর সংজ্ঞা

জাকির মাহদিন

শিক্ষা বিষয়টা এতটাই মৌলিক, গভীর, ব্যাপক, তাৎপর্যপূর্ণ ও প্রভাববিস্তারকারী যে একমাত্র এটাই ‘মানুষ’ পরিচয়ের মূল ভিত্তি। প্রকৃত শিক্ষা কখনোই মানুষে মানুষে বিভাজন তৈরি করবে না। সম্ভ্রান্ত, নীচু কিংবা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার, আলেম-মুফতি বলে কাউকে আলাদা চোখে দেখবে না। সবার মূল পরিচয় হবে মানুষ। অথচ সমাজে এখন ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার, মাওলানা-মুফতি, এমপি-মন্ত্রী সবই আছে, কেবল ‘মানুষ’ নেই। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মূল সমস্যা এখানেই। সাধারণ ও ধর্মীয় শিক্ষা এখন এমনই নষ্ট হয়েছে যে এ শিক্ষিতরা নিজেদের শুধুই মানুষ পরিচয় প্রচণ্ডরকম লজ্জাবোধ করেন। পেশাগত পরিচয়, কর্মদক্ষতা ও ডিগ্রিগুলো না বললে যেন তাদের পরিচয় পূর্ণতা পায় না।

প্রকৃত শিক্ষার সঙ্গে আজকের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কোনোই মিল নেই। দীক্ষা তো পরের কথা, ‘শিক্ষা’রই কোনো নাম-গন্ধ নেই বর্তমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। মূল শিক্ষা বাদ দিয়ে বা শিক্ষার মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ভুলে গিয়ে এর গৌণ ও আনুষঙ্গিক বিষয়গুলোকেই শিক্ষা নামে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। এক বা একাধিক ভাষা শিক্ষা, বৈষয়িক শিক্ষা ও কারিগরী শিক্ষার চাপে মনুষ্যত্বের শিক্ষা, মানসিক শক্তি অনুসন্ধান ও মানবিকতা বিকাশের শিক্ষা, সৃষ্টিগত প্রাপ্তশিক্ষা সম্পূর্ণই হারিয়ে গেছে। জানি, এখানের কিছু কথা বা পরিভাষা পাঠকের কাছে কঠিন ঠেকবে। কারণ সেই বিষয়গুলো আমাদের চিন্তা-চেতনা এমনকি ধ্যান-ধারণা থেকেও একেবারেই হারিয়ে গেছে। যে কারণে সাধারণ ও কথিত উচ্চশিক্ষায় দূরের কথা, মাদরাসা শিক্ষায়ও ‘সৃষ্টিগতভাবে প্রাপ্তশিক্ষা’র কোনো অনুসন্ধান ও পর্যালোচনা নেই।

মহান আল্লাহ কোরআনে বলেছেন, “আমি মানুষকে কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছি; এমনকিছু যা সে জানত না।” -সূরা আলাক। “তিনি অসীম দয়ালু। শিখিয়েছেন কোরআন। মানুষকে তিনি সৃষ্টি করেছেন। বর্ণনা (ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ) শিখিয়েছেন।” -সূরা রাহমান। এমনকি মহান আল্লাহ আমাদের পরীক্ষাও নিয়েছেন। জিজ্ঞেস করেছেন, “আমি কি তোমাদের পালনকর্তা নই?” এর সঠিক উত্তর দিতেও আমরা সমর্থ হয়েছি। বলেছি, “নিশ্চয়”। অথচ এখন ধর্মীয় শিক্ষা হয়ে পড়েছে বিনিময়নির্ভর, অতি সঙ্কুচিত, বেতনধারী, ‘জী হুজুর’মার্কা, সার্টিফিকেটমুখী, স্বীকৃতিমুখী।

সবার মূল পরিচয় হবে মানুষ। অথচ সমাজে এখন ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার, মাওলানা-মুফতি সবই আছে, কেবল ‘মানুষ’ নেই। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মূল সমস্যা এখানেই। সাধারণ ও ধর্মীয় শিক্ষা এখন এমনই নষ্ট হয়েছে যে এ শিক্ষিতরা নিজেদের শুধুই মানুষ পরিচয় প্রচণ্ডরকম লজ্জাবোধ করেন। পেশাগত পরিচয়, কর্মদক্ষতা ও ডিগ্রিগুলো না বললে যেন তাদের পরিচয় পূর্ণতা পায় না।

সার্টিফিকেট এখন একটা হলেও চলে না, অনেকগুলো চাই, অনেক প্রকারের চাই। অথচ এসব পাবার মূল উদ্দেশ্যই ধর্মবিরোধী। কারণ এসবের প্রতি আকর্ষণ, দুর্বলতা, ব্যস্ততা, পেরেশানি স্রষ্টাপ্রদত্ত শিক্ষাকে ভুলিয়ে দেয়। সৃষ্টিগতভাবে ‘প্রাপ্তশিক্ষা’ নষ্ট করে ফেলে। বর্তমান শিক্ষা, শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপদ্ধতি মানুষের মানসিক সুপ্ত শিক্ষা ও শক্তি বিকাশের পক্ষে সহায়ক নয় বরং উল্টো। তাই এসব যাদের ভাগ্যে জোটে তারাও অন্তরে শান্তি বোধ করেন না। আরও অধিক আশা, বিভিন্ন ব্যক্তি-দল-প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মানসিক দ্বন্দ্ব, পারিবারিক-সামাজিক সম্পর্কের অবনতি, জাগতিক সুখ ও প্রাপ্তিতে উচ্ছ্বাস বা কথিত তৃপ্তি আর দশজন সাধারণ মানুষ বা উচ্চাকাঙ্ক্ষী শিক্ষিত শ্রেণির মতোই তারা ধারণ করেন।

জেনারেল শিক্ষায় বাংলা-ইংরেজির প্রাধান্য, আর মাদরাসা শিক্ষায় আরবির প্রাধান্য। এসবই মূলত ভাষা, মৌখিক বা লিখিত। জ্ঞান (ইলম) আর ভাষা এক নয়। সাধারণ ও ধর্মীয় শিক্ষায় ভাষাগত ও অন্যান্য বাহ্যিক কিছু পার্থক্য থাকলেও মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের দিক থেকে কোনো পার্থক্য নেই। কওমি অঙ্গনের যারা বাইরে চিৎকার করেন অসংখ্য সমস্যায় জর্জরিত মাদরাসা শিক্ষার আখেরাতমুখিতা, আল্লাহমুখিতা, দৃঢ় চরিত্র ইত্যাদি নিয়ে, সেসব নিয়ে কথা বাড়াতে চাই না।

সম্পাদকের অন্যান্য কলাম পড়ুন

শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কথা বলতে গেলে সাধারণ ও ধর্মীয়- কোনো শিক্ষাকেই আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। সাধারণ মানে সাধারণ, এটা সবার লাগবেই। আর ধর্মও অপরিহার্য। সুতরাং সাধারণ শিক্ষাব্যস্থায় যেমন প্রয়োজনীয় ধর্মশিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে, তেমনি ধর্মীয় শিক্ষাব্যস্থায়ও প্রয়োজনীয় সাধারণশিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে (এক্ষেত্রে উভয় কর্তৃপক্ষেরই চরম দুর্বলতা, অযোগ্যতা, অসততা ও অবহেলা লক্ষ করা যায়)। এটা সার্থকভাবে করা গেলে শেষপর্যন্ত একমুখি শিক্ষা বাস্তবায়িত হবে। কিন্তু বাংলাদেশের যা অবস্থা, যুগ যুগ ধরে পরিকল্পিতভাবে যে ‘বিভাজন’ চলে আসছে, তাতে খুবশীঘ্র এ ধরনের একমুখি শিক্ষার পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। তাই মনুষ্যত্ব ও মানসিক শক্তির বিকাশকে প্রাধান্য দিয়ে, সাধারণ ও ধর্মীয় শিক্ষার সার্থক সমন্বয়ে ভবিষ্যতে একমুখি শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এ দুটো শিক্ষাব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রেখে সমস্ত শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে।

‘কওম’ মানে জাতি। কিন্তু কোন্ জাতি? জাতির সঠিক সংজ্ঞাটা কী? কীসের ভিত্তিতে মানুষের ‘জাত’ নির্ণিত হবে? বর্তমানবিশ্বে জাতি বলে যা স্বীকৃত তা ইসলাম সমর্থিত নয়। আবার তথাকথিত ইসলামিস্টরা ‘জাতি’র যে সংঘাতধর্মী চরিত্র, বিভাজন ও আকৃতি দাঁড় করাচ্ছে তা মানবতাবিরোধী, প্রকৃতপক্ষে ধর্মবিরোধীও। তাহলে কওমিপন্থীরা ‘কওমি শিক্ষা’ বলতে কী বোঝাচ্ছেন? এ শিক্ষায় ও শিক্ষাব্যবস্থায় একজন শিক্ষার্থীর সামগ্রিক জ্ঞান, চেতনা ও যোগ্যতা কতটুকু বিকশিত হয়? নাকি এর দ্বারা শিক্ষার্থীর মধ্যে সমাজবিচ্ছিন্নতা, জাতিবিচ্ছিন্নতা, নৈরাশ্যবোধ, উগ্রবাদ, ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা, ধর্মীয় বিভ্রান্তি, রাষ্ট্রীয় অসঙ্গতি সৃষ্টি হয় তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অবশ্যই দেখতে হবে।

জেনারেল শিক্ষায় বাংলা-ইংরেজির প্রাধান্য, আর মাদরাসা শিক্ষায় আরবির প্রাধান্য। এসবই মূলত ভাষা, মৌখিক বা লিখিত। জ্ঞান (ইলম) আর ভাষা এক নয়। সাধারণ ও ধর্মীয় শিক্ষায় ভাষাগত ও অন্যান্য বাহ্যিক কিছু পার্থক্য থাকলেও মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের দিক থেকে কোনো পার্থক্য নেই।

কথিত জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের এই আধুনিক যুগে মানুষ আসলেই কতটা শিক্ষিত বা কতটা মূর্খ তা নির্ণয় ও নিশ্চিত হবার পথ-প্রয়োজন দুটোই আছে। শিক্ষার বাস্তবতা, কার্যকারিতা, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, প্রভাব-পরিধি নিয়ে সীমাহীন সন্দেহ-সংশয়, দ্বন্দ্ব-হতাশা ও বিতর্ক তৈরি হওয়ার কারণেই মূলত আজকের এ মনুষ্যত্ববোধ ও মনুষ্যত্বচর্চার চরম সংকট। ধর্মীয়, রাজনৈতিক, শাসনতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক- সমস্ত সংকটের মূল কারণ এখানেই- শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থার মৌল ত্রুটি। একদল নিজেদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ‘কওমি শিক্ষা’ বলে দাবি করছেন। অথচ ‘কওম’ এবং ‘শিক্ষা’র কোনো সংঘাতমুক্ত, বিতর্কমুক্ত, সমস্যামুক্ত ও মীমাংসাধর্মী সংজ্ঞা দিচ্ছেন না। অন্যদল সাধারণ শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষা বলতে যা দেখাচ্ছে তা পুরোটাই মূর্খামূর্খি ও ‘মূর্খমূর্খখেলা’। একদল শিশু-কিশোরের চোখ বেঁধে কানামাছি খেলার মতো।

বাংলাদেশের শতকরা ক’জন নাগরিক প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডি পেরানোর সুযোগ পায়? শত-সহস্র বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে যারা ‘শিক্ষার্থী’ হিসেবে নিজেদের পরিচিত প্রতিষ্ঠিত করে, তাদের মধ্যে কওমি শিক্ষার্থীদের মতো অসহায়, হতাশ, কর্মবিমুখ, সাধারণ বোধ-বুদ্ধিহীন আর হয় না। কেন এমন? যুগ যুগ ধরে এর পেছনে দায়ি কারা? আজ পশুত্বচর্চা ও নীতিনৈতিকতাহীনতার এই চূড়ান্ত সংকটকালে বাস্তবতা উপলব্ধি ও স্বীকার করা দায়িত্বশীলদের থেকে অবশ্যই নতুন প্রজন্ম আশা করতে পারে। কেন আজকের কওমি শিক্ষার্থীরা কওমি ডিগ্রির পাশাপাশি আলিয়া ও স্কুল-কলেজ থেকে ডিগ্রি নিতে মহামূল্যবান সময়, মেধা ও অর্থ অপচয় করতে বাধ্য হচ্ছে? কওমি শিক্ষকগণ কি এসব জানেন না?

‘কওম’ মানে জাতি। অর্থাৎ মানবজাতি। হাজারো দেশ-জাতি, ভাষা-বর্ণ, সমাজ-রাষ্ট্রের বাধা, দুরত্ব ও সীমাবদ্ধতা ভেদ করা একটি একক, বৈষম্যহীন ও মনুষ্যত্বচর্চাকারী শ্রেষ্ঠতর মানবজাতি। যে জাতি অন্যের ভাষা, বর্ণ, ভূখণ্ড, সংস্কৃতির প্রতি ঘৃণা ছড়াবে না। নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করায় মগ্ন থাকবে না। কথিত শিক্ষা, সৌন্দর্য, ডিগ্রি, সম্পদ, ক্ষমতা ইত্যাদির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে না। যে জাতি অন্যের প্রতি সহমর্মিতা, সহযোগিতা, সুশিক্ষা দানেই ব্যস্ত থাকবে। যে জাতি যতবেশি শ্রেষ্ঠ হবে, সে জাতি ততবেশি অন্য ‘জাতিদের’ প্রতি দায়িত্ববোধ ও দায়িত্বপালনেই সর্বদা ব্যস্ত থাকবে।

জাকির মাহদিন : সম্পাদক, দেশ দর্শন
zakirmahdin@yahoo.com

ক্যাটাগরি: ইসলাম,  ধর্ম-দর্শন-বিজ্ঞান,  প্রধান কলাম,  সম্পাদকের কলাম

ট্যাগ:

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply