বৃহস্পতিবার ভোর ৫:৫৬, ২৬শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ৮ই মে, ২০২৪ ইং

আদর্শবাদীদের চিন্তা ও কাজের মডেল

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক

কালোত্তীর্ণ আদর্শও কোনো বিশেষ কালে বিশেষ প্রেক্ষাপটেই গড়ে উঠে। স্থানীয়ভাবে গড়ে উঠলেও নিজগুণে আদর্শ কালোত্তীর্ণতা লাভ করে। অন্যদিকে কালোত্তীর্ণ আদর্শও কোনো কাল, স্থান, পরিবেশে ও প্রেক্ষাপটে প্রতিষ্ঠিত হয়।

ব্যক্তি কীভাবে আদর্শের জন্য কাজ করবে তা নিয়ে এই ফর্মুলা বা মডেল। এই মডেল অনুসারে আদর্শকে অনুসরণের ক্ষেত্রে ব্যক্তি তার স্বদেশ ও বিশ্বপরিস্থিতিকে বিবেচনা করবে। সে যা করবে তা তার দেশ ও জাতির জন্য যথোপযুক্ত হবে। একই সাথে তা সমকালীন বিশ্বপরিস্থিতিতেও মানানসই হবে। তবেই তার কাজকর্ম ভারসাম্যপূর্ণ হবে। লোকাল পরিস্থিতি হলো বিশেষ (অর্থে) বিবেচনা, আর গ্লোবাল পরিস্থিতি হলো সার্বিক বিবেচনার বিষয়। এই উভয় বিবেচনাকে সামনে রেখে পথ চললে কোনো বিশেষ সমাজের সদস্য হওয়ার পাশাপাশি কোনো ব্যক্তি বিশ্ব-নাগরিক হিসাবে গড়ে উঠবে।

মানুষ হিসাবে আমরা একই সাথে কোনো বিশেষ পরিবারের সদস্য, কোনো দেশ বা রাষ্ট্রের নাগরিক এবং কোনো বিশেষ রাষ্ট্র-জোটের অন্তর্ভুক্ত। একই সাথে আমরা বিশ্ব পরিবারেরও সদস্য। যিনি নিজেকে বিশ্ব-নাগরিক হিসাবে ভাবেন না তিনি আসলে এখনো ততটা মানবিক হয়ে উঠতে পারেননি। আমরা যখন মানবতার কথা বলি তখন আমরা নিজেদেরকে স্বীয় পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, ভৌগলিকতাসহ সব খণ্ডিত পরিচয়ের উর্ধ্বে এক সাধারণ পরিচয়ের বলয়ে পরিচিত করি। এখানে আমরা সবাই এক ও অভিন্ন। ঐক্যের এই সর্বাত্মক অনুভূতি কারো মধ্যে কাজ না করলে তিনি মানবিক হয়ে উঠতে পারবেন না। মানবিকতা, মানবিকতা ছাড়া অন্য কোনো পরিচয়কে স্বীকার করে না।

আদর্শবাদীরা মনে করে, এসব ‘খণ্ডিত’ পরিচয় আর আদর্শবোধ যেন মুখোমুখি ধরনের কিছু। যেন মানুষকে বেছে নিতে হবে সে বিশেষ কোনো আদর্শকে অনুসরণ করবে, নাকি এসব ক্ষণিক ও ‘সংকীর্ণ’ পরিচয়কে ধারণ করবে। আমার দৃষ্টিতে, এই এপ্রোচটার গোড়াতেই গলদ। এটি ভুল। মানুষের পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক সংশ্লিষ্টতাগুলোকে বাদ দিয়ে কোনো আদর্শ হয় না। আদর্শ কোনো বায়বীয় ব্যাপার নয়। এসব ক্ষণিক ও ‘সংকীর্ণ’ পরিসরেই আদর্শ গড়ে উঠে। স্থানিকতার পথ ধরেই সব আদর্শ আন্তর্জাতিকতায় উত্তীর্ণ হয়েছে। গড়ে উঠার দিক থেকে আদর্শ মাত্রই লোকাল। প্রভাব বিস্তারের দিক থেকে আদর্শ মাত্রই গ্লোবাল। তাই আদর্শের ক্ষেত্রে লোকাল না গ্লোবাল- এমন বাইনারি গ্রহণযোগ্য নয়। কোনো বিশেষ এলাকা ও পরিবেশের মধ্যে না এসে, কোনো এলাকা ও পারিপার্শ্বিকতাকে গড়ে না তুলে কোনো আদর্শ আকাশ থেকে নাযিল হয় না। বরং জমিনের দাবিতে জমিনের উপযোগী হিসাবেই যে কোনো আদর্শের উদ্ভব।

এখানকার ইসলামী আন্দোলনগুলো ভেদবুদ্ধিনির্ভর। যেখানে তারা ছাড়া বাদবাকী সবাই তাদের ‘অপর’ তথা শত্রু। এখানকার ইসলামি আন্দোলনের অভ্যন্তরীণ পরিবেশে ভিন্ন মতের জায়গা নাই। বরং ফোরামের মধ্যে একবার উত্থাপন করে হক কথাটা ভুলে যাওয়াই হলো এখানকার ‘তাওয়াছাও বিল হাক্ব’- এর (পরষ্পরকে সত্যের জন্য পরামর্শ দেয়া, -সুরা আসর) তথাকথিত সাংগঠনিক নিয়ম। এখানে দ্বিমত নিয়ে কেউ টিকে থাকতে পারে না। বরং মতামতের দাসত্বকে এখানে ধর্মীয় আমেজে প্রশংসাযোগ্য মনে করা হয়।

অতএব কালোত্তীর্ণ আদর্শও কোনো বিশেষ কালে বিশেষ প্রেক্ষাপটেই গড়ে উঠে। স্থানীয়ভাবে গড়ে উঠলেও নিজগুণে আদর্শ কালোত্তীর্ণতা লাভ করে। অন্যদিকে কালোত্তীর্ণ আদর্শও কোনো কাল, স্থান, পরিবেশে ও প্রেক্ষাপটে প্রতিষ্ঠিত হয়। সে জন্য আদর্শের মধ্যে যুগোত্তীর্ণতার পাশাপাশি অভিযোজনের ক্ষমতাও থাকতে হয়। নইলে সেই আদর্শ এক ধরনের মধুর কষ্ট-কল্পনাই হয়ে থাকে, ইউটোপিয়া বলতে যা বুঝায়।

আমার আদর্শ ইসলাম। আদর্শ, স্বদেশ ও বিশ্ব- এই মডেলে আদর্শের জায়গায় ইসলাম ও স্বদেশের জায়গায় বাংলাদেশ বসিয়ে দিলে ব্যাপার এমন দাঁড়াচ্ছে- আপনি বাংলাদেশে বসে ইসলাম চর্চা করছেন। এ কাজে আপনাকে ইসলামের মূল উৎস হতেই ইসলামকে যথাসম্ভব শুদ্ধভাবে জানতে হবে। পাশাপাশি নির্মোহভাবে বাংলাদেশ নামক এই ভূখণ্ডের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, ধর্মচেতনা, এর সম্ভাবনা ও সংকটের দিকগুলো সম্পর্কেও আপনার স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে। আপনাকে জানতে হবে সমকালীন বিশ্বের গতি-প্রকৃতি। এই তিন ধরনের বিষয়জ্ঞানকে যখন আপনি সমন্বিত করবেন তখনই আপনার মনে সঠিক করণীয় জ্ঞান উদ্ভাসিত হবে। এর কোনো একদিকেও যদি ঘাটতি থাকে তবে আপনার মধ্যে ভারসাম্যহীনতা ও প্রান্তিকতা তৈরি হবে। অজ্ঞানতার এই বিষবাষ্প হতে বাঁচার কোনো পথ নাই।

দুঃখজনক হলেও সত্য, সমকালীন বাংলাদেশে সমাজতন্ত্রী-সেক্যুলার দল ও ধারাসমূহ এবং ইসলামপন্থী দল ও ধারাসমূহ এই ধরনের একদেশদর্শী, ভারসাম্যহীন ও প্রান্তিক বিবেচনায় ওভারঅল আক্রান্ত। নিজেদের চিন্তার ত্রুটিকে তারা আদর্শের দোহাই দিয়ে ঢাকতে চায়। সেজন্য দেখবেন, এদেশের ইসলামি আন্দোলনের সাথে ঠিক স্বদেশও মিলে না, বিদেশও মিলে না। দুনিয়াব্যাপী লোকেরা কাজ করছে একভাবে, অথচ এখানকার লোকেরা কাজ করছে উল্টোভাবে।

উদাহরণ হিসাবে বলছি, দুনিয়াব্যাপী ‘ইসলামি আন্দোলনগুলো’ তাদের সাংগঠনিক বৈশিষ্ট্যে সমন্বয়ী, বহুত্ববাদী, উদার, বুদ্ধিবৃত্তির দিক থেকে অগ্রসর ও সামাজিক-রাজনৈতিক দিক থেকে বাস্তবধর্মী। অন্যদিকে এখানকার ইসলামী আন্দোলনগুলো ভেদবুদ্ধিনির্ভর। যেখানে তারা ছাড়া বাদবাকী সবাই তাদের ‘অপর’ তথা শত্রু। এখানকার ইসলামি আন্দোলনের অভ্যন্তরীণ পরিবেশে ভিন্ন মতের জায়গা নাই। বরং ফোরামের মধ্যে একবার উত্থাপন করে হক কথাটা ভুলে যাওয়াই হলো এখানকার ‘তাওয়াছাও বিল হাক্ব’- এর (পরষ্পরকে সত্যের জন্য পরামর্শ দেয়া, -সুরা আসর) তথাকথিত সাংগঠনিক নিয়ম। এখানে দ্বিমত নিয়ে কেউ টিকে থাকতে পারে না। বরং মতামতের দাসত্বকে এখানে ধর্মীয় আমেজে প্রশংসাযোগ্য মনে করা হয়। সমাজের অতিউদার ও অতিরক্ষণশীল ধারার মধ্যে এরা কোনো মধ্যবর্তী ধারা তৈরি করতে সক্ষম হয় নাই। এজন্য তাদের কোনো পেরেশানিও নাই। নিজেদেরকে বরং অতিরক্ষণশীল প্রান্তিক অবস্থানে চিহ্নিত করতে পেরে তারা তুষ্ট। স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তি এখানে নিন্দনীয় কাজ। অবাধ্যতার পরিচয়।

আমি বিশেষ কোনো দলকে উদ্দেশ্য করে এসব বলছি না। বাংলাদেশে যারাই দলীয়ভাবে ইসলাম চর্চা করে তাদের সবার মধ্যেই খুব বেশি পরিমাণে এসব নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য স্পষ্টত লক্ষ্য করা যায়। ভাববেন না, দলীয়ভাবে ইসলাম চর্চা করা বলতে আমি শুধু রাজনৈতিক ময়দানে সক্রিয়দের কথাই বলছি। যারা ধর্মীয় সেক্টরে কাজ করছেন তারা এসব একদেশদর্শী প্রান্তিকতায় আরো বেশি নিমজ্জিত। হোক তা প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা অপ্রাতিষ্ঠানিক।

মূলকথা হলো, আশপাশের সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বপরিস্থিতি হতে চোখ ফিরিয়ে আদর্শের এক ধরনের কষ্টকল্পিত তাত্ত্বিক অনুসরণের পরিবর্তে যেখানে আপনি কাজ করবেন সেখানকার পরিবেশ পরিস্থিতি ও সমকালীন বৃহত্তর বিশ্ব পরিস্থিতিকে বিবেচনা করে কাজ করতে হবে। এ ধরনের সামগ্রিক বিবেচনার পরিবর্তে কোনো বিশেষ সংগঠনের বিশেষ কর্মসূচী ও কর্মপদ্ধতি ঠিক না বেঠিক তা নির্ধারণ করতে যাওয়া হলো আলাপ-আলোচনার ভুল পদ্ধতি। আদর্শের মূল জায়গা হতে অংকটা যদি নতুন করে শুরু না করেন তাহলে নিশ্চিত বলতে পারি, আপনার হিসাব কখনো মিলবে না। এমতাবস্থায় আপনি এক পর্যায়ে হতাশ হয়ে ছিটকে পড়বেন অথবা ফ্রুটলেস এক্টিভিজমের গোলক ধাঁধায় জীবন পার করে দিবেন।

অনির্দিষ্টভাবে কাজ করে যাওয়াটা কোনো আদর্শেরই দাবি হতে পারে না। ইসলামও তা বলে না। আল্লাহ তায়ালা বার বার বলেছেন, তোমরা চিন্তা করো, ভাবো, বুদ্ধিকে কাজে লাগাও। সর্বোপরি আল্লাহর ওপর ভরসা করো। সমস্যা হলো, আমরা বেকুবের মতো কাজ করে যাই, আর সগর্বে মনে করি আমি তো ঠিকই আছি। একটু চোখ মেলে যদি দেখতাম, তাহলে বুঝতাম, দেশ ও দুনিয়া কোথায়, আর আমরা কোথায়? নির্বুদ্ধিতাকে যেখানে তাকওয়ার দাবি করা হয় সেখানে আর কীইবা আশা করা যায়? এসব কথা ‘সংগঠনবাদী’ বেকুবদের জন্য নয়। ‘উলুল-আল-বাব’ তথা জ্ঞানী সম্প্রদায় বলতে যাদের বুঝানো হয়েছে তাদেরই জন্য এসব কথা। এই মডেল বা ধারাচিত্র হচ্ছে সমাজ পরিবর্তনে বদ্ধপরিকর অদম্য স্বাপ্নিকদের চিন্তা ও কাজের ক্ষুদ্র নকশা ।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক : শিক্ষক, দর্শন বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

ক্যাটাগরি: ইসলাম,  প্রধান কলাম

ট্যাগ:

[sharethis-inline-buttons]

One response to “আদর্শবাদীদের চিন্তা ও কাজের মডেল”

  1. solaiman library says:

    গড়ে উঠার দিক থেকে আদর্শ মাত্রই (লোকাল), প্রভাব বিস্তারের দিক থেকে আদর্শ মাত্রই (গ্লোবাল)। বোল্ড করা অংশের সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত।
    বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আপনি বলেছেন, ‘ইসলাম’কে এভাবে দেখা হচ্ছে আর পৃথিবীর অনান্য মুসলিম দেশে আরও ভালভাবে দেখা হচ্ছে! আমার মতে শুধু বাংলাদেশ নয়,পুরো বিশ্বেই ইসলাম একরকম। বাংলাদেশ এ ব্যাপারে বর্হিবিশ্বের মতই।
    আপনি বলেছেন, আদর্শ মাত্রই (লোকাল), প্রভাব বিস্তারের দিক থেকে আদর্শ মাত্রই (গ্লোবাল)। ইসলাম যেহেতু আদর্শ তাই সেটা গ্লোবাল। আপনার মতে বাংলাদেশে সঠিক ইসলামি ভাবধারা নেই। আমার মতে ইসলাম শুধুমাত্র বাংলাদেশের জন্য নয়। আজকের বাংলাদেশে ইসলাম যেমনটি রয়েছে পুরো বিশ্বেই তার চেহারা একরকম। কারণ পুরো বিশ্বেই ইসলামের নিয়মকানুন একইভাবে মানা হচ্ছে। তবে ইসলামের অভ্যন্তরীন বিরোধের রূপটা প্রায় কাছাকাছি। যেমন- শিয়া, সুন্নি, মাযহাবি, লা-মাযাহাবি, তাবলিগী, তাবলিগ বিরোধী, শারিয়তি, মারেফতী এছাড়াও রয়েছে অসংখ্য তরীকা বিদ্যমান।

Leave a Reply