বৃহস্পতিবার বিকাল ৪:০৩, ২১শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ৫ই ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং

প্রবীণদের প্রতি অবজ্ঞা আর নয়

৭৯০ বার পড়া হয়েছে
মন্তব্য ০ টি

মানবজীবন পরিক্রমার সর্ব শেষ, অবশাম্ভাবী ও স্বাভাবিক র্পযায় হচ্ছে র্বাধক্য। কারো যদি অকাল মৃত্যু না হয় তবে প্রত্যেককেই এ জীবনের স্বাদ গ্রহন করত হয়। বার্ধক্যের আঘাত র্সবজনীন।সমাজের অনেক সমস্যাই আছে যা পাশ কাটিয়ে বা এড়িয়ে চলা যায় কৌশলে। কিন্তু জন্মের সাথে মৃত্যুর যেমন র্সম্পক,বেঁচে থাকলে বার্ধক্যের সাথেও তেমন। জীবনের এ চিরন্তন নিয়মের কোনো ধরনের ব্যত্যয় ঘটানোর সুযোগ বা পথ মহান সৃষ্টির্কতা রাখেননি।একবিংশ শতাব্দীতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নতি, গনসচেতনতা, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন মৃত্যুহারকে যেমন হ্রাস করেছে,তেমনি মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে।ফলে বিশ্বসমাজে বয়স্কদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৫০ সালে জাতিসংঘের দেয়া এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৬০বছর এবং তদূর্ধ্ব বয়সী জনসংখ্যা তখন ছিল বিশ্বে ২০কোটি, ১৯৭৫ সালে এ সংখ্যা ৩৫ কোটি এবং ২০০০ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৬ কোটি। ২০১০ সালে প্রবীণ জনগোষ্ঠির সদস্যসংখ্যা প্রায় ৭০ কোটি এবং ২০২৫ সালে এই  সংখ্যা বেড়ে হবে ১১০ কোটির ঊর্ধ্বে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও প্রবীণ জনসংখ্যা ক্রমান্ময়ে বেড়ে চলেছে।বর্তমানে বাংলাদেশে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮ শতাংশ। জাতীয় নীতিমালা,২০১৩ অনুযায়ী আমাদের দেশে ৬০ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সী ব্যক্তিরা প্রবীণ হিসেবে স্বীকৃত।

মানুষ জীবনের পথপরিক্রমায় অনেক কিছুর বিনিময়ে যা অর্জন করে তা হলো অভিজ্ঞতা।তাইতো প্রবীণ মানেই অভিজ্ঞতা যা নবীনদের চলার পথে সঠিক দিকনিদেশর্না দিতে পারে। অভিজ্ঞতার আলো দিয়েই নবীনরা  গড়বে দেশ, জাতিকে নেবে সামনের দিকে এগিয়ে, আর রচনা করবে কল্যাণকর সুন্দর জীবনের পথ।বাংলাদেশের সনাতনী শিক্ষায় প্রবীণদের অর্থাৎ পিতা-মাতা,দাদা-দাদী ও গুরুজনদের ভক্তি-শ্রদ্ধা,সেবাশুশ্রূষা করার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হতো।পাশাপাশি ধর্মীয় অনুশাসনে প্রবীণদের সেবা-যত্ন করার অনুপ্রেরণা ছিল যা আজ তথাকথিত আধুনিকতার আঘাতে বিলুপ্ত হহতে চলছে। আবার বাংলাদেশের প্রবীণদের অবস্থা পারিবারিক পর্যায়ে ঐতিহ্যগতভাবে ভালো থাকলেও ক্রমান্ময়ে একান্নভুক্ত পরিবার প্রথা বিলুপ্ত  ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারনে পরিবারে প্রবীণ ব্যক্তির জীবনের নিরাপত্তা আজ কঠিন অবস্থার মুখোমুখি।

প্রবীণরা আজ সমাজে প্রতিনিয়ত অবজ্ঞা ও অবহেলার পাত্রে পরিনত হচ্ছেন;প্রতিকার  করার কেউ নেই। দুখঃজনক হলেও অপ্রিয় সত্যি যে অভাবী পরিবারে বৃদ্ধ পিতা-মাতা ও দাদা-দাদীর অনেকেরই নেই মাথা গোঁজার ঠাঁই। তবে কারো ভাগ্য ভালো হলে ঠাঁই হয় বাড়ির পিছ-বারান্দা, রান্নাঘর বা গোয়ালঘরে।অন্দর মহলে কখনো তাদের ঠাঁই হয়না।অভাব-অনটন হয় তাদের নিত্যসঙ্গী।আধপেটা খেয়ে তাদের থাকতে হয়; অসুস্থ্যতায় মেলে না যথাযথ চিকিৎসা এবং সেই সঙ্গে  থাকে স্বজনদের র্দুব্যবহার।কাকতালীয় ভাবে এমনই ধরনের ঘটনা ঘটে ময়মনসিংহ শহরের হতভাগ্য আব্দুস সাত্তার ভূইয়ার ক্ষেত্রে।তিনি ময়মনসিংহ শহরের কেওয়াটখালী মহল্লার মরহুম আব্দুর রহিম ভূইয়ার  বড় সন্তান। আব্দুস সাত্তার ভূইয়া অবসরপ্রাপ্ত জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসার। তিনি তিন ছেলের জনক।তারা সবাই বিত্তশালী। ঢাকার উত্তরা তিন নম্বর সেক্টরে তার নিজস্ব বাড়ী আছে,যা ছেলেদের নামে রেজিষ্ট্রি করে দিয়েছেন।বড় ছেলে ডাক্তার। নিজস্ব ফ্ল্যাটে স্ত্রী, শ্যালিকা ও শাশুরী নিয়ে থাকেন, অথচ বৃদ্ধ বাবার জায়গা নেই। মেঝ ছেলে ব্যবসায়ী, তাঁরও নিজস্ব বিশাল ফ্ল্যাট আছে। সেখানে প্রায়ই বাইরের ব্যবসায়ীক অতিথিদের নিয়ে পার্টি হয়।অথচ বাবা না খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকেন। ছোট ছেলেও অবস্থাসম্পন্ন। কিন্তু, ’স্ত্রীর সন্তুষ্টির জন্য’ বাবাকে নিজের ফ্ল্যাটে রাখতে পারে না। সব সন্তান স্বাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও বাবার স্থান হয়েছে শেষ পযর্ন্ত মসজিদের বারান্দায়।সাত্তার ভূইয়া অনেক দিন ধরে মসজিদের বাইরে পড়ে আছেন। অনেকে ভিক্ষুক ভেবে দু-চার টাকা ভিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন। ইমাম সাহেব তার খাবার থেকে কিছু অংশ দিয়ে আসছেন প্রতিদিন। সাত্তার সাহেব হঠাৎ একদি গুরুতর অসুস্থ্য পড়লে  তাকে দ্রুত সরকারী জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়; তবে শেষ পযর্ন্ত মারা যান তিনি।হাসপাতার কর্তৃপক্ষ সাত্তার ভূইয়ার বড় ছেলেকে তার মৃত্যুর সংবদ জানালে বলেন, ‘জরুরী মিটিংয়ে আছি, লাশটি আঞ্জুমান মুফিদুর ইসলামকে দিয়ে দিন’। পৃথিবীতে যদি বাবা-মা না আসত তবে কোনো সন্তানকে কল্পনা করা যেত না।অথচ ওয়ারিশ থাকার পরও হতভাগ্য সাত্তার ভূইয়ার লাশকে দাফন করতে হলো বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে।প্রতিদিন আমাদের দেশে সাত্তার ভূইয়ার মতো কত লোককে ওয়ারিশ থাকার পরও বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন হতে হয় ,তার হিসাব ও তাদের পরিচয় কে রাখে?

র্বাধক্য প্রকৃতিরই নিয়ম।সবার জীবনেই র্বাধক্য আসে।প্রকৃতির নিয়মেই এই সময় শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতা হ্রাস পায়।পরর্নিভরতা বেড়ে যায়। এই বয়সে উচ্চ রক্তচাপ,ডায়াবেটিস,কোমড় ব্যাথা, কানে কম শুনা ও চোখে কম দেখা কমন রোগ। এই সময় অনেকেরই স্মৃতি শক্তি প্রায় লোপ পায়। একাকিত্বের শূন্যতায় ভোগেন প্রবীণরা । ছেলেমেয়েরা হয়তো ব্যবসা-বানিজ্য বা চাকরির সুবাদে অন্য শহরে বা দূর দেশে আবস্থান করেন।আর বৃদ্ধ পিতা-মাতা গ্রামের বাড়ীতে একাকী থাকে; তারা কথা বলতে চান, কিন্তু তাদরে কথা কেউ শুনতে চয়না।তাদের কথা শুনার সময় কারোই নেই। বৃদ্ধ বয়সে নিঃসঙ্গ দম্পতিরা পরস্পরের প্রতি র্নিভরশীল হয়ে পড়েন।একজন অরেকজনের সঙ্গে অতীত দিনের কথা বলে সময় অতিবাহিত করেন।তবে এই দুশ্চিন্তা তাদের সব সময় তাড়া করে বেড়ায়-’একজনের কিছু হলে, অন্যজনের কি হবে’?  অনেক সময় এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে অনেক নিঃসঙ্গ দম্পতি একসঙ্গে আত্মহননের মতো ভয়াবহ পথও বেঁছে নেন।আবার অনেক সময় সম্পত্তির মালিকানাসত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য   প্রিয় সন্তান কর্তৃকও বৃদ্ধ পিতা-মাতা খুনের শিকার হন।

আধুনিকতার প্রভাবে বিবাহের পর নিজ সন্তানেরা দ্রুত ভিন্ন পরিবার গঠন করে, ফলে আমাদের দেশের ’যৌথ পরিবার’ ভিত্তি ভেঙ্গে পড়েছে।যার ফলশ্রুতিতে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে প্রবীণরা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় অসহায়বোধ করে। পুত্র ও পুত্রবধূর সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে প্রবীণদের র্বাধক্যে নিজের জীবনধারণের জন্য অন্যের সাহায্য প্রার্থনা করতে হয় যা খুবই বেদনা দায়ক।যারা অভিমানী লোক তাদের জন্য ব্যাপরটা খুবই পীড়াদায়ক হয়ে দাঁড়ায়।অনেক অভিমানী লোক এই সময় সৃষ্টির্কতার নিকট মৃত্যুও কামনা করেন।আবার অনেক ধণী পরিবারের ছেরেমেয়েরা পিতা-মাতাকে গ্রামের বাড়ীতে ফেলে রেখে বিদেশ পাড়ি জমানো কারনে র্আথিক সচ্ছলতা থাকা সত্ত্বেও প্রবীণদের একাকিত্ব নিয়ে নিঃসঙ্গভাবে মৃত্যুবরন করতে হয় যা খুবই দুখঃজনক।

এমনই এক হতভাগ্য পিতা হলেন আব্দুল গফুর সরকার।তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার  পাইকপাড়া মহল্লার মরহুম আব্দুর রহমান সরকারের একমাত্র পুত্র। আব্দুল গফুর সরকারের বর্তমান বয়স ৮৫,তিনি র্দীঘ দিন যাবৎ একটি বেসরকারী ব্যাংকে চাকরি করেছেন;স্ত্রী মারা গেছেন প্রায় এক বছর হলো। আর একমাত্র ছেলে রায়হান সরকার স্থায়ীভাবে যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন। বর্তমানে উনি কাজের লোকেদের কাঁধে ভর দিয়ে বাথরুমে যাতায়াত করেন।কোমড় ও হাঁটুতে প্রচন্ড ব্যথা। এ ব্যথা সহ্য করতে পারছে না। এই ব্যথা থেকে মুক্তি লাভের জন্য সৃষ্টি কর্তার নিকট তিনি সব সময়ই মৃত্যু কামনা করে থাকেন।

পিতা-মাতা দু’জনই সন্তানকে তিল তিল করে মানুষ করে তোলে।তারা সারা দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে নিজেদের যাবতীয় সুখ-শান্তি ত্যাগ করে সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা অটুট রেখে আগামীর পথে আগাতে থাকে। কিন্তু অকৃতজ্ঞ সন্তানেরা ভুলে যায় তাদের পিতা-মাতাকে।অসহায় পিতা-মাতার জন্য একটু জায়গা হয় না তাদের বাসায়।অবশেষে বাবা-মা নিঃউপায় হয়ে আশ্রয় নেন বৃদ্ধা-আশ্রমে।গাজীপুর বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়া ৮০ বছরের এক বৃদ্ধের কাছ থেকে জানা যায় তার জীবনের করুন কাহিনী।তার নাম মিজানুর রহমান,পিতার নাম আবিদুর রহমান,গ্রামের বাড়ী ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলাধীন বারিউরা গ্রামে।তিনি দুই ছেলে ও এক মেয়ের জনক।পেশায় ছিলেন বেসরকারী চাকরিজীবী। দুই ছেলে ও মেয়েকে উচ্চ শিক্ষিত করান। বড় ছেলে ঢাকায় একটি বেসরকারী কোম্পানীতে চাকরি করেন আর ছোট ছেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে ঠিকাদারী ব্যবসা করেন, একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দেন ময়মনসিংহের ঈশ্বরঞ্জ শহরে।তিনি বলেন, আমার সন্তানরা যখন ছোট, টু-থ্রিতে পড়ে তখন, ঈদের দিন সকালে নতুন পাজামা -পাঞ্জাবী পরিয়ে কোলে করে তাদেরকে ঈদগা ময়দানে নিয়ে যেতাম; নামাজ শেষে বাসায় এসে একসঙ্গে বসে সেমাই খেতাম।এসব স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে মিজানুর রহমান কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তিনি বলেন, আমার ছেলেমেয়েরা বড় হলে তাদের বিয়ে দিই। নাতি-নাতনি হয়। কিন্তু সংসারে নানা সমস্যা দেখা দেয় ছেলেদের বিয়ের পর থেকেই।আমি বয়োবৃদ্ধ এবং আমার স্ত্রী না থাকায় আমার সেবা-যত্ন করতে নারাজ ছেলের বউরা।কিছু না হতেই ছেলের বউরা মুখ বেজার করে থাকে। আবার ছেলেরা বাড়ীতে এলে তারা আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে।আর এসব দেখে মেয়ে সহ্য করতে না পেরে আমাকে বেড়ানোর কথা বলে এই বৃদ্ধাশ্রমে রেখে যায়। মাঝে-মধ্যে মেয়ে খোজ-খবর নিতে আসে কিন্তু ছেলেরা কখনো আসে না।এখানে তিনি তিন বছর যাবৎ আছেন।তিনি আরো জানালেন,এখানে তিনি ছেলেদের বাসার তুলনায় অনেক ভালো আছেন।এখানে দেখবাল করার লোক আছে। সবচেয়ে বড় কথা, সমবয়সীদের  সঙ্গ পাওয়া যায়। বিনোদনের ব্যবস্থা আছে। শরীরচর্চার সুযোগ আছে।তবে দুধের স্বাদ কি ঘোলে মেটে!

রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের দেশে প্রবীণদের অবস্থা খুবই বেদনাদায়ক ও করুন। কেননা রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের প্রবীণদের কল্যাণের বিষয়টি সব সময়ই চরমভাবে উপেক্ষিত  হয়ে আসছে।আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় আমাদের প্রবীণদের ন্যূনতম মর্যাদা  প্রদান বা তার কর্মময় জীবনের স্বীকৃতির কোনো ব্যবস্থা নেই।গবেষনা করে জানা যায়, তৎকালীন পাকিস্তান আমলে বেশকয়েকজন মহৎপ্রাণ মানুষ স্বপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে আসেন প্রবীণদের হিতৈষী রূপে। তৎকালীন র্পূব পাকিস্তানের গর্ভনর মোঃ জাকির হোসেনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডাঃ ওয়াহেদ উদ্দিন প্রবীণদের কল্যাণার্থে ১৯৬০ সালের ১০ এপ্রিল প্রতিষ্ঠা করেন “প্রবীণ হিতৈষী সংঘ”। এই  সংস্থার প্রথম প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন গর্ভনর মোঃ জাকির হোসেন এবং সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন ডাঃ ওয়াহেদ উদ্দিন। পরবর্তীতে প্রবীণদের কল্যাণে সংগঠিত হয়ে যারা মূল্যবান অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন:ডাঃ মোহাম্মদ ইব্রহিম, আলমগীর এম. এ.কবীর, আজিজুল হক, বিচরপতি আব্দুল ওয়াদুদসহ আরো অনেক ব্যক্তি। তাদর   অক্লান্ত প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠা “প্রবীণ হিতৈষী সংঘ” আজও প্রবীণদের কল্যাণে কাজ অব্যাহত রেখেছে।তবে অর্থের অভাবে এই সংগঠনটি বিপুলসংখ্যক প্রবীণ মানুষের জন্য  আশানুরূপ কাজ করতে পারছেনা। এই অবস্থায় সরকারী ও বেসরকারী বিভিন্ন  সংস্থার উচিৎ বিপুলসংখ্যক প্রবীণদের কল্যাণে এই সংগঠনের কাজে এগিয়ে আসা।

বাংলাদেশে অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্যে পেনশন প্রথার  প্রচলন রয়েছে সেই বৃটিশ আমল থেকে । কিন্তু দেশের বিপুলসংখ্যক প্রবীণ নাগরিক এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত।তবে আশার কথা বিশ্বের উন্নত সব দেশের সব প্রবীণ মানুষের সামাজিক ও র্আথিক নিরাপত্তার জন্য পেনশন ব্যবহার অনুসরণে আমাদের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়(১৯৯৭-২০০২) প্রবীণদের জন্য চার কোটি টাকা বরাদ্ধ করে। তা থেকে ১৯৯৮ সালের ৩১ মে থেকে দেশের প্রতিটি ওয়ার্ডে বসবাসরত দুস্থ প্রবীণকে মাসিক ১০০টাকা হারে বয়স্কভাতা প্রদান শুরু করা হয়। পরবর্তীতে এই বয়স্কভাতা কিছুটা বৃদ্ধি করা হয়েছে।নিঃসন্দেহে  এ কল্যাণকর কাজের জন্য  তৎকালীন সরকার নন্দিত হয়েছে। তবে চাহিদার তুলনায় এর সংখ্যা ও পরিমানগত অবস্থা খুবই অপ্রতুল।বিগত সরকারের আমলে ২০০২সাল থেকে অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারী শিক্ষক কর্মচারীদের জন্য অবসর সুবিধা ভাতা প্রদানের সূচনা করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহন করেছেন।

র্বাধক্য সমস্যাটি অনুধাবন করে সম্প্রতি প্রবীণবিষয়ক জাতীয় নীতিমালা এবং প্রবীণ বাবা-মার ভরণপোষণে সন্তান-সন্ততির আইনগত বাধ্যবাধকতা র্নিধারণের জন্য বাবা-মা ভরণপোষণ আইন-২০১৩ পাস হয়েছে।সম ও সামর্থ্যবান পুত্র বা কন্যা আইনের বিধান অনুযায়ী পিতা-মাতার ভরণপোষণ না করলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধের জন্য ১লাখ টাকা পযর্ন্ত অর্থদন্ড, অনাদায়ে সর্বোচ্চ তিন মাস কারাদন্ডের বিধান আছে আইনে।

সন্তানকে মানুষ করার জন্য মা-বাবা কত কষ্টই না করেন। অথচ র্কমব্যস্তার অজুহাতে বৃদ্ধ বাবা-মার কোনো ধরনের খোঁজখবর  রাখেন না অনেকে।অসহায় বৃদ্ধ বাবা-মার দায়িত্ব না  নিয়ে উল্টো বাড়ী থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাও অহরহ ঘটছে। এত নিষ্ঠুর হতে পারে ঔরজাত সন্তান! যাকে র্দীঘ ১০ মাস জঠরে ধারন করেছিলেন জন্মদাত্রী মা। এটা চিরন্তন সত্য কথা জগতের  কারও বাবা-মা চিরকাল বেঁচে থাকবেন না।বৃদ্ধ বাবা-মার দেখবাল সন্তানরা করবে, এটা আইন করার প্রয়োজন হয় কেন? এটা বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়। বিষয়টা নৈতিকতা ও মূল্যবোধের। এই  নৈতিক বোধটা মনের ভিতর থেকেই উৎসারিত হতে হবে। ছোটবেলা থকেই এ ব্যাপারে সচেতন হতে শেখাতে হবে নতুন প্রজন্মকে। তাদের সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করত হবে।

কালক্রমে সমাজ বদলে গেছে।একান্নবর্তী পরিবারে সেই কবে ভাঙ্গ ধরেছে,যা আজও অব্যাহত আছে। আজ জীবনটা বেশী যান্ত্রিক হয়ে উঠেছে।সবাই স্বার্থের পিছু ছুটছেন।কেউ কারো সাহায্যে নিঃর্স্বাথ ভাবে এগিয়ে আসছেন না।সবর্ত্রই অস্থিরতা কোথাও শান্তি নেই।স্নেহ, মায়া-মমতার বড়ই আকাল। তাই প্রবীণদের অন্দরমহলের খবর রাখার কেউ নেই,সবাই যার যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত।জীবনের সোনালী সময়ে প্রবীণরা সংসারের যাবতীয় সিদ্ধন্ত নিতেন,সংসারের সব সদস্যরা তার র্নিদেশ মতো চলতো।কিন্তু কালের  প্ররিক্রমায় একসময়ের সংসারের কর্তা বা কর্ত্রী  এখন বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছেন।দুঃখজনক হলেও সত্যি যে সেই কর্তৃত্ব আর নেই। সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষেত্রেও নূন্যতম কোনো ভূমিকা নেই। বাতিল কাগজের মতো গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছেন সংসারে। এই অপমান ও অর্মযাদ সহ্য করা খুবই কঠিন।অনেক সময় প্রবীণরা সন্তানদের এ ধরনর অপমান সহ্য না করতে পেরে স্বেচ্ছায় গৃহত্যাগ করে বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় গ্রহন করেন; আবার অনেকে আত্মহত্যাও করে বসেন।

পৃথিবীর সব সমাজেই প্রবীণদেরকে বলা হয় অভিজ্ঞতায় ভরপুর জীবন্ত ইতিহাস যা অতীত ও বতর্মনের মাঝে যোগসূত্র হিসেবে কাজ করে। তাই এসব জ্ঞানের ভান্ডারকে অবহেলা ও অবজ্ঞা না করে বরং তাদের প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতাকে আমাদের দেশ ও সমগ্র জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতির কাজে প্রয়োগ করতে হবে।প্রবীণদের কল্যাণে আমাদের অতীতের গৌরবময় মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনতে হবে। আমাদের শিক্ষার প্রতিটি স্তরের পাঠ্যসূচিতে প্রবীণদের  প্রতি নবীনদের র্কতব্য ও দায়বদ্ধতার কথা অর্ন্তভূক্ত করতে  হবে যাতে নতুন প্রজন্ম পিতা-মাতা,দাদা-দাদী ও গুরুজনদের র্বাধক্যে সন্মান প্রর্দশন, সেবাদান, ভলণপোষণ ও পরির্চযায় ব্রতী হয়।রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রবীণদের র্মযাদা ও স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য পরিচিতি পত্র প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।রেলওয়েসহ বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী যানবাহনে প্রবীনদের জন্য অন্ততপক্ষে৩০% ভাড়া কম গ্রহণ করতে হবে এবং যাবাহনগুলোতে প্রবীণদের জন্য সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা করতে হবে। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে স্বল্প ব্যয়ে প্রয়োজনে বিনা ব্যয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। সব দুস্থ ও উপযুক্ত বয়স্কদের বয়স্কভাতা দিতে হবে। বয়স্কভাতার  অর্থের পরিমাণ সম্ভবমতো বাড়াতে হবে।এছাড়াও বিশেষ করে প্রবীণ নারীর দেনমোহর ও উত্তরাধিকার সম্পত্তিপ্রাপ্তির নিশ্চিতকরনের ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রবীণদের প্রতি আর অবজ্ঞ ও অবহেলা নয়।আজকের নবীন আগামীর প্রবীণ। আজ যদি আমরা প্রবীণদের অবহেলা ও অবজ্ঞা করি,তাহলে একদিন আমাদেরকেও একই রকম  অবহেলা ও উপেক্ষার শিকার হতে হবে-এই সহজ সত্য কথাটি আমাদেরকে সব সময়ই স্মরন রাখতে হবে।সুতরাং প্রবীণ নাগরিকদেরকে কোনো অবস্থাতেই বোঝা মনে না করে বরং তাদের কল্যাণে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র যথাযথ দায়িত্ব ও র্কতব্য পালন করে ঋণ পরিশোধ করবে আজকের দিনে এই প্রত্যাশা রেখে লেখার যবনিকা টানলাম।

খায়রুল আকরাম খান:ব্যুরো চিফ, দেশ দর্শন।

Some text

ক্যাটাগরি: মতামত, সমাজসেবা

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply

আমি প্রবাসী অ্যাপস দিয়ে ভ্যাকসিন…

লঞ্চে যৌন হয়রানি