রবিবার সকাল ৭:৫৬, ২৮শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ১৩ই অক্টোবর, ২০২৪ ইং

বাংলাদেশে ঈদ উৎসব : সেকাল একাল

৮৬০ বার পড়া হয়েছে
মন্তব্য ০ টি

ঈদ একটি আরবী শব্দ। অর্থ খুশী বা আনন্দ। মুসলিমদের জীবনে ঈদ আসে বছরে দু’বার একটি হলো “ঈদুল ফিতর” আর অন্যটি হল “ঈদুল আজহা”। ইতিহাস অধ্যয়ন করে জানা যায়, মহানবী হযরত মোহাম্মদ সা. এর মদিনা হিজরতের পূর্বে সিরিয়া, পারস্য, মদিনা, মক্কা, ইয়েমেন প্রভৃতি রাজ্যের জনগণ পারসী (মাজুসী) ধর্মের অনুসারীদের প্রভাবে বছরে দু’বার শরতের পূর্নিমায় “নওরোজ” উৎসব এবং বসন্তের পূর্ণিমায় “মিহিরজান” উৎসব উদযাপন করতো। উৎসবগুলো চলতো একনাগার ২/৩ দিন পর্যন্ত। উৎসবস্থলে অবাধে চলতো মদ্যপান, জুয়াখেলা, কুস্তি প্রতিযোগিতা, হাস্যরস, নারীভোগ, পাশাখেলা, দাঙ্গাসহ নানারকম অসামাজিক ও অমানবিক কার্যকলাপ। মহানবী সা. মদিনা হিজরতের পর এসব কর্মকান্ড স্বচক্ষে দেখে ব্যথিত হলেন। এমন যন্ত্রনাদায়ক ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রানের উদ্দেশ্যে তিনি আনুমানিক ৬২৪ খ্রীস্টাব্দে সমগ্র মুসলমানদের জন্য উক্ত দু’টি উৎসব সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষনা করেন।

অতঃপর তিনি ঐশিক আদেশে মুসলমানদের জন্যে প্রবর্তন করেন “ঈদুল ফিতর” উৎসব। আর “ঈদুল আযহা” উৎসব প্রবর্তন করেছিলেন সমগ্র মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম আ.। উক্ত উৎসব দু’টি সমগ্র মুসলিম জাহানের জন্য মানবিক ও ধর্মীয় বিধান। সমগ্র মুসলিম উম্মাহর কাছে এই দুই ঈদের তাৎপর্য অপরিসীম। রমজান মাসের রোজা পালনের পর শাওয়াল মাসের প্রথম তারিখে মুসলিম জাহানে “ঈদুল ফিতর” উৎসব উদযাপিত হয়ে থাকে, ঈদুল ফিতরের আভিধানিক অর্থ উপবাস ভঙ্গগের উৎসব আর “ঈদুল আযহা” উৎসব উদযাপিত হয় জিলহজ্জ মাসের দশ তারিখে। ঈদুল আযহার আভিধানিক অর্থ কুরবানীর উৎসব। এই উৎসব দু’টি পালনের ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। সমাজের প্রতিটি লোক তার সামর্থ অনুসারে এই উৎসব দু’টি উদযাপন করে থাকে। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে উক্ত উৎসব দু’টি উদযাপনের ক্ষেত্রে আমাদের বাঙালী মুসলিম সমাজ ও সম্প্রদায়ের মধ্যে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে।

রমজান মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে পূর্ব বঙ্গের তথা বাংলা দেশের  সমগ্র মুসলিম সম্প্রদায়ের মাঝে ঈদুল ফিতর পালনের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। ঈদ উপলক্ষে নতুন পোশাক, গৃহ সজ্জা, ফিতরা প্রদান এবং বিশেষ খাবারের আয়োজন অত্যাবশক। আজ থেকে ৫০ বছর আগে এখানকার মতো নানা রঙের রেডিমেড জামাকাপড় পাওয়া যেত না; দর্জির দোকানে গিয়ে পাজামা-পাজ্ঞাবি, শার্ট-প্যান্ট বানাতে দিতে হতো। সে সময়-তেমন ভিড় থাকত না, দোকানে লোকজনের সংখ্যাই ছিল কম। পিতা বা চাচা ছেলে-মেয়েদের জন্য পাজামা-পাঞ্জাবি, প্যান্ট-শার্ট, সালোয়ার-কামিজ তৈরীর কাপড় বাজার থেকে ক্রয় করে আনতেন। তখন মেয়েদের জন্য আলাদা কোনো দর্জির দোকান ছিল না বিধায় মাই মেয়েদের কাপড় সেলাই করে দিতেন। মেয়েরা এখনকার মতো বাইরে যেতেন না শাড়ী- কাপড় বা প্রসাধনী সামগ্রী কিনতে। আপনা- আপনিই পুরুষেরা তাদের জন্য শাড়ী-কাপড় ও প্রসাধনী সামগ্রী আনতেন মেয়েদের জন্য, বড় বোনদের জন্য। এমনকি দাদা-দাদী, নানা-নানী, চাচা-চাচী সবার জন্যই কাপড়চোপড়, স্যান্ডেল-জুতা কেনা হতো। তবে বিশেষ প্রয়োজন হলে মেয়েরা ফেরীওয়ালাদের কাছ থেকে পছন্দ অনুযায়ী বিছানার চাদর, সেলোয়ার-কামিজের কাপড়, চুড়িও অন্যান্য অলঙ্কার কিনতেন। এখনকার মতো তখন কোনো শপিং মল ছিল না। তখনকার কাপড়ের দোকান, কসমেটিকের দোকান ও স্বর্ণকারের দোকান গুলো ছিল সাদামাটা। তবে অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা বড় বড় ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে করাচী অথবা বোম্বে থেকে দামী কাপড়চোপর, গহনা, ঘড়ি, পারফিউম ও জুতা স্পেসাল অর্ডার দিয়ে আনতেন।

আজ থেকে ত্রিশ বছর পূর্বে শিশু-কিশোররা ঈদের নতুন জামা-কাপড় ও জুতা কেনার পর তা ট্রাং অথবা আলমারীতে লুকিয়ে রাখতেন। কেউযেন দেখে না ফেলে, দেখে ফেললে একই ডিজাইনের কিনে ফেলবে। নিজের জিনিস অন্যের চেয়ে আলাদা হওয়া চাই। এই লুকিয়ে রাখার মধ্যেই ছিল ঈদের অগ্রীম আনন্দ। বর্তমানে শিশু-কিশোরদের মধ্যে এ ধরনের প্রবনতা নেই, তারা বর্তমানে ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ডিজাইনের পছন্দনীয় পোশাক বাছাই করে নিতে পারে অতি অল্প সময়ে। এখন গোপনীয়তা বলতে কিছু নেই। কে কতটা আনকমন ডিজাইনের পোশাক ক্রয় করেছে তা ঈদের পূর্বে বন্ধু মহলে প্রদর্শনের মাধ্যমেই যেন যত বাহাদুরী।

মাত্র এক দশক আগেও ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় হতো ঈদ কার্ডের মাধ্যমে। রঙচঙে আকর্ষনীয় ডিজাইনের ঈদকার্ডে বাছাই করা পদ্যের ছন্দে পাওয়া যেত আন্তরিকতার ছোয়া। ঈদ আনন্দের সাথে জড়িয়ে ছিল কার্ড আদান-প্রদানের সংস্কৃতি। শহর ও গ্রাম- সবখানেই ছিল এর রমরমা ব্যবসা। বর্তমানে ঈদ কার্ডের সেই জোয়ার নেই। যন্ত্রসভ্যতা সব কেড়ে নিয়েছে। হাতের মুঠোয় থাকা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে খুদে বার্তা দিয়ে ঈদ উদযাপনে রঙিন জানালা খুলে দেয়া হচ্ছে। এ জানালা দিয়ে কত ভালবাসা, কত স্মৃতি এসে ঢুকে পড়ে এই অন্তরটাতে- এইতো ঈদের আনন্দ। আগামী প্রজন্ম হয়তো ঈদকার্ড চোখেই দেখবে না কখনো, হয়তো ঐতিহ্যবাহী ঈদ কার্ডের কথা জানতে পারবে বই পড়ে। ঈদ কার্ড বিক্রির আর আদান-প্রদানের সেই সোনালী দিন গুলো এখন ধূসর অতীত।

ঈদের আনন্দ শুধু একার নয় বরং সবার। পরিবার পরিজনের সঙ্গে ঈদ করার মজাই আলাদা। তাই এই ঈদের ২/৩ দিন পূর্বে নাড়ীর টানে স্বজনদের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করার জন্যে চাকুরীজীবি, ব্যবসায়ী ও প্রবাসীরা শত ব্যস্ততার মাঝে কিছু দিনের সময় নিয়ে যানবাহনের প্রচন্ড ভিড় উপেক্ষা করে জীবনের ঝুকি নিয়ে গ্রামের বাড়ীতে ছুটে আসে। আত্মীয়-স্বজনদের মুখ দর্শনের পর তারা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আসার শত কষ্ট ভূলে যায়। এখানেই ঈদ আনন্দের অন্যতম সার্থকতা। পূর্বে বাংলাদেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে যেতে প্রায় ২/৩ দিন সময় লেগে যেতো। কিন্তু বর্তমানে যোগাযোগ ব্যবস্থা অতি উন্নত হওয়ার কারণে মাত্র ১২ ঘন্টার মধ্যেই কাংখিত স্থানে পৌছা যায়।

প্রচলীত প্রথা অনুযায়ী ঈদ উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ ছিল ঈদের নতুন চাঁদ দেখা। আজ থেকে ৫০ বছর আগে শিশু-কিশোর, যুবা ও বৃদ্ধরা উনত্রিশ রোজার সন্ধাবেলায় পশ্চিম আকাশে তন্ন তন্ন করে ঈদের নতুন চাঁদ খুজতে থাকতো। তখন চারিদিকে চলতো দারুণ উৎকন্ঠা। এমন সময় হঠাৎ মেঘমুক্ত পশ্চিম আকাশে শুভ্রসরু সুতার মতো বাকাঁ এক ফালি চাঁদ অস্পষ্ট ভাবে দেখা যেতো। ক্রমান্বয়ে যখন নতুন ঈদের চাঁদ সবার দৃষ্টি গোচর হতো তখন উপস্থিত সবাই উচু স্বরে সমানভাবে খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলতো “আলহামদুলিল্লাহ”। যদি আকাশ মেঘাছন্ন থাকতো তা হলে নতুন চাঁদ দেখা যেতো না। তখন সবাই মহা দুশ্চিন্তায় পরে যেতো রোজা কি ২৯ হবে না ৩০ শে হবে। তখন রেডিও-টেলিভিশনের এত প্রচলন ছিল না। এই অবস্থায় নতুন চাঁদের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্যে গঞ্জে লোক পাঠানো হতো, উক্ত লোক ফিরে এসে নতুন চাঁদ দেখার খবর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চারি দিকে খুশীর বন্যা বয়ে যেতো, তখন শিশু-কিশোররা খুশীতে আত্মহারা হয়ে বিভিন্ন আতশবাজী ফুঁটাতো। আর অবস্থাপন্ন ব্যক্তিরা গ্রামফোন রেকর্র্ডে “রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ” কবি নজরুল ইসলামের এই বিখ্যাত গানটি অনেক বার বাজাতো। এই সময় বাড়ীর অন্দর মহল ও রান্না ঘরে হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে যেতো। সকাল বেলা কি কি রান্না হবে তার প্রস্তুতি। কত রকমের সেমাই হবে, পাটালি গুড়ের পায়েসটাতে নারিকেলের গুড়া দিতে হবে কিনা, ভোনা খিচুড়ি হবে নাকি পোলাও হবে। পোলাও হলে মাংস কি শুধু গরুর হবে, নাকি পাশাপাশি মোরগের ঝালফ্রাইও করতে হবে? কোর্মাটা হবে কিনা এসব রান্নার আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যেতেন বাড়ীর মহিলারা। কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম ইন্টারনেটের বদৌলতে বাড়ীর ড্রইং রোমে বসে গুগলে সার্চ দিয়ে ঈদের নতুন চাঁদ উঠার খবর জানতে পারে কয়েক মিনিটের মধ্যে। তাদের নিকট নতুন চাঁদ দেখার আনন্দ একেবারে পানসেটে।

অতীত কাল থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াসহ পৃথিবীর প্রায় ৪৪% দেশের মুসলিমগণ “ইংরেজী ক্যালেন্ডার” (গ্রেগরী ক্যালেন্ডার) অনুসরণ করে “গ্রীনিচ মীন টাইম” অনুযায়ী সৌদিআরবের ১/২ দিন পর রোজা ও ঈদ উৎসব পালন করে আসছেন। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পর চাঁদপুর, নোয়াখালী, কিশোরগঞ্জ জেলাসহ আরো কিছু জেলার অতি নগন্য লোকজন ক্ষুদ্রপরিসরে অতি গোপনে সৌদীআরবের সাথে মিল রেখে রোজাও ঈদ উৎসব পালন করে আসছে। এমতাবস্থায় সরকারের উচিত ধর্মীয় ও বৈজ্ঞানীক ভিত্তিতে পর্যবেক্ষন করে এমন একটি সুষ্ঠু সমাধান বের করা যাতে পৃথিবীর যে কোনো স্থানে চাঁদ দেখা যাওয়ার পর বিশ্ব্যাবপী একই দিনে রোজা ও ঈদ পালন করার ক্ষেত্রে আর কোন অসুবিধার সৃষ্টি না হয়। এতে ঈদের আনন্দ বহুগুনে বৃদ্ধিপাবে এবং পাশাপাশি দীর্ঘ দিনের এই ফেৎনা-ফাসাদের চির অবসান হবে।

ঈদের আসল আনন্দ পাওয়া যায় চানরাতে। অর্থাৎ ঈদের আগের দিনের রাতে। এই সময় সল্প আয়ের মানুষেরা পরিবারের জন্য শেষ মুহুর্তের কেনাকাটা করেন। অবশ্য মধ্যবিত্তরাও করেন। আবার উচ্চবিত্তরাও করেন। একটা বিষয় খুবভাল লাগে সবার চোখে-মুখে একধরনের আনন্দ থাকে। যিনি বিক্রি করছেন তারও, যিনি কিনছেন তারও। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো সবাই এত ফুরফুরে মেজাজে থাকেন, দেখা যায় একটার জায়গায় তিনটি জিনিস কিনে ফেলেছেন। আর অচেনা একজন অন্যজনকে হাসিমুখে “ঈদ মোবারক” বলছেন, এমন দৃশ্য শুধু চানরাতে দেখা যায়। পূর্বে চানরাতে শিশু-কিশোর, বৃদ্ধ-যুবারা চুল কাঁটা ও দাড়ি কামানোর জন্যে হুড়াহুড়ি করে নাপিতের দোকানে প্রবেশ করতো; এ সময় দীর্ঘক্ষণ তাদের অপেক্ষা করতে হতো। অতঃপর উক্ত কাজ সমপন্ন হওয়ার পর তারা ছুটে চলতো টুপি, আতর ও জায়নামাজ কেনার জন্য। সেখানেও প্রচন্ড ভিড়। উক্ত কেনাকাটা শেষ হওয়ার পর তারা মেয়েদের জন্যে স্নো-পাউডার, নেইলপলিশ ও কাচা মেহেদী পাতা ক্রয় করে বাসায় ফিরতো। মেয়েরা এসব জিনিস পেয়ে ভীষণ খুশী হতেন। রাতের খাবার শেষ হওয়ার পর পর এ বাড়ী সে বাড়ীতে ধুম পরে যেত হাতে মেহেদী দেয়ার। আর ছেলেরা এ সময় বাড়ীর অন্দর মহল ও বৈঠকখানা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রঙ্গিন কাগজ ও ঝড়ির মালা দিয়ে ঘর সাজার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তো। এভাবে সারা রাত সরগম হয়ে থাকতো। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় “বিউটি পারলার”, “সেলুন”,“ডিপার্টমেন্টাল স্টোর” ও “ইন্টারনেটে কেনাকাটার” ব্যবস্থা থাকার কারণে চানরাতের সরগম অনেকটাই কমে গেছে।

ঈদের দিন কাক ডাকা ভোরে মা-বাবারা বাড়ীর সবাইকে ঘুম থেকে তুলে প্রত্যেকের হাতে কঁচি নিমগাছের ঢাল দিয়ে দিতেন মেসওয়াক করার জন্য। অতঃপর মহিলারা রান্না ঘরে চলে যেতো সকালের নাস্তা তৈরী করার জন্যে আর পুরুষেরা গোসল করার জন্যে যেতেন নদী বা খালে; সেখানে সুগন্ধী সাবান দিয়ে খুব আয়েসের সঙ্গে গোসল করে বাসায় প্রত্যাগমন করতেন। তারপর মায়ের হাতের তৈরী গরম গরম নানা ধরনের সুমিষ্ট পায়েস, সেমাই, চাউলের রুটি ও পিঠা খেয়ে ঈদের নামাজ পড়ার জন্য নতুন পাজামা-পাঞ্জাবী পড়ে তৈরী হতেন। এসময় সবার চোখের পাতায় বাদশাহী সুরমা ও গায়ে সুগন্ধী আতর মাখা হতো। অতঃপর বাবা ছোটদেরকে নিয়ে ঈদের ময়দানের দিকে যাত্রা করতেন। সবাই নীচু স্বরে “তাকবীর” বলতেন। তবে ঈদুল আযহার দিন উচ্চ স্বরে “তাকবীর” বলতে হতো। এসময় বাবা ফকির-মিসকিনদের মধ্যে “সদকায়ে ফিতর” এর টাকা বিতরন করে দিতেন।

ঈদের ময়দানে লোক সমাগম বেশী হতো বলে দেরীতে পৌছলে শেষ কাতারে বসতে হতো। ইমাম সাহেবের ধর্মীয় বয়ান শেষ হওয়ার পর পরই ঈদের নামাজ শুরু হয়ে যেতো। ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী ঈদের নামাজ অতিরিক্ত “ছয় তাকবীরের সঙ্গে” পরতে হয়। কিন্তু নামাজ পড়ার সময় অতিরিক্ত ছয় তাকবীর দিতে গিয়ে বড়দের তুলনায় ছোটদের বেশী ভূল হতো। প্রথা অনুযায়ী নামাজ শেষে ধনী-গরীব, পরিচিত-অপরিচিত সবাই একজন আরেক জনের সাথে উদার মন নিয়ে কুলাকুলি করতে হয়। এই পর্বটি খুবই আনন্দদায়ক। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী এ সময় সবাই যার যার আত্মীয়- স্বজনদের কবর জিয়ারত ও দোয়া খায়ের করে পায়ে হেঁটে বাসায় ফিরতো। কিন্তু বর্তমানে এসব প্রথা ও রীতি প্রায় বিলীন হওয়ার পথে। শহর ও মহানগর গুলোতে যেসব খোলা ময়দানে আগে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হতো সেগুলো এখন প্রভাবশালীদের দখলে। তাই ঈদের জামাত এখন খোলা ময়দানের পরিবর্তে জামে মসজিদ গুলোতে অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়াও বর্তমানে কিছু কিছু যুবক ইমাম সাহেবের খুৎবা কর্ণগোচর না করে নামাজ অসমাপ্ত রেখে ঈদের জামাত থেকে হস্তদস্ত হয়ে বাসায় ফিরেন।

বহুকাল থেকে ঈদের দিন সকাল দিকে ঈদের ময়দানে মেলা বসতো। দোকানীরা হরেক রকমের খেলনা ও মন্ডা-মিঠাই বিক্রি করতো। ঈদের জামাত থেকে ফিরার পথে শিশুরা মেলা থেকে বাঁশের বাঁশী, বেলুন, ডুগডুগী বিভিন্ন ধরনের মিঠাই কিনে বাসায় প্রত্যাগমন করতো। বাসায় আসার পর ছোট-বড় সবাই মা-বাবা ও দাদা-দাদীর পা ছুয়ে সালাম করে সেলামি নিতো। এই সেলামি নেওয়াতে ছিল গভীর মমত্ববোধ ও আনন্দ। অতঃপর আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে আশির্বাদ ও সেলামি নেওয়ার উদ্দেশ্যে শিশু-কিশোররা সম বয়সী বন্ধু-বান্ধবদের সাথে নিয়ে বাড়ী বাড়ী গিয়ে মুরুব্বীদের পা ছুয়ে সালাম করতো এবং তাদের কাছ থেকে সেলামি নিতো। এই সেলামির টাকা গুলো তারা কমপক্ষে দিনে ১০/১২ বার গুনতো। ঈদ উৎসব শেষ হওয়ার সপ্তাহখানেক পর টাকা গুলো মাটির ব্যাংকে জমা রাখতো। এই সেলামির রীতি এখনো প্রচলন আছে।

ঈদের মূল আনন্দ পাওয়া যায়, দুপুর অথবা রাতের রকমারী খাবারের দ্বারা অতিথি আপ্যায়নের মাধ্যম। এই প্রীতি ভোজে বিভিন্ন পদের খাবার থাকতো। খাবার গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো- পোলাও, ভোনা খিচুড়ী, তেহারী, চিনিগুড়া চাউলের সাদা ভাত, রুই মাছের ভুনা, চিতল মাছের গুপ্তা, মুরগীর কুরমা, গরুর মাংসের ভোনা, শামী কাবাব, চাউলের রুটি, তুন্দুরী রুটি, দই, বুরহানী ইত্যাদি। এই প্রীতিভোজের প্রচলন আজও অটুট আছে।

আজ থেকে ৫০ বছর আগে রেডিও-টেলিভিশন ও সিনেমার এত ব্যাপক প্রচলণ ছিল না। তাই ঈদের দিন দুপুরের খাবারের পর অলস সময় পার করার জন্যে শিশু-কিশোররা বয়স্ক আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের কিচ্ছা-কাহিনী ও উপদেশমুলক গল্প শোনে বেশ আনন্দ পেতো। এভাবে সময় গড়িয়ে বিকাল আগত হলে শিশু কিশোর ও যুবকরা দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে গিয়ে ফুটবল, ভলিবল, ডাংগুনি, কাবাডী, দাড়িয়াবান্দা, মোরগ লড়াই, লাঠিখেলা, ঘুড়ি উড়ানো ইত্যাদি খেলা খেলে সময় পার করে সন্ধ্যার দিকে বাড়িতে ফিরতো। রাতের খাবারের পর অবস্থাপন্নদের বাড়ির বৈঠক খানা বা উঠানে বসতো পুঁথি পাঠ, ফকিরী গান ও পালা গানের আসর। স্থানীয় গায়েন ও কবিয়ালরা উক্ত আসরে গান ও পুথিঁ পাঠ পরিবেশন করতেন। ভোর পর্যন্ত চলতো এই পুথিঁ পাঠ ও গানের আসর। বর্তমানে মাঠের অভাবে শিশু কিশোররা একান্ত ইচ্ছা থাকার পরও খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতে পারছে না। তবে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের ৭ দিন ব্যাপী প্রচারিত নাটক, সিনেমা, ছায়াছবির গান, টকশো, টেলিফিল্ম, ম্যাগাজীন অনুষ্ঠান, নাচসহ নানাবিধ বিনোধন মূলক অনুষ্ঠান দেখে, হাই ভলিয়মে ব্রান্ডের গান শোনে, ফেসবুকে চেট করে, ও বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে ঈদ উৎসবের আনন্দ উপভোগ করেন।

আবহমান কাল থেকে আমাদের দেশে ঈদের পরের দিন নায়র-নায়রিরা বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসতো। খুব আনন্দ হতো। বাড়ির সামনে গেট বানিয়ে “ঈদ মোবারক” লিখে রাখা হতো। কিন্তু হ্যায়! বর্তমানে নায়র-নায়রিরা আগের মতো বাবার বাড়িতে আর বেড়াতে আসে না। তারা এখন জাফলং, কোয়াকাটা, সেন্টমার্টিন দ্বিপ, রাঙ্গামাটি, কাশ্মির, দার্জিলিং, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ইত্যাদি জায়গায় বেড়াতে যায় এবং ঈদের আনন্দ উপভোগ করেন।

ঈদুল ফিতর শেষ হওয়ার দু’মাস ৯ দিন পর সমগ্র মুসলিম জাহানে “ঈদুল আযহা” উৎসব উদযাপিত হয়। ঈদুল আযহার দিনে আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য অর্জনের জন্য প্রতিটি অবস্থাপন্ন মুসলমানদের হালাল পশু জবাই করা ওয়াজিব। আমাদের দেশে সাধারণত গরু, মহিষ ও ছাগল এই তিন ধরনের পশুই কুরবানী দেওয়া হয়। আজ থেকে ৪০ বছর পূর্বে স্থানীয় কৃষকরা গৃহপালিত পশু কোরবানী দিতেন ও স্থানীয় বাজারে অতি সীমিত আকারে সরবরাহ করতেন। তবে চট্টগ্রাম ও ঢাকার বেপারীরা সিন্দু, শাহিওয়াল ও মিরকাদিমী প্রজাতের গরু দেশের সর্বত্র সরবরাহ করতো। কিন্তু বর্তমানে লোকসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে ভারত থেকে জারসি প্রজাতের গরু প্রচুর পরিমানে আমদানী করতে হয়। অতীত কাল থেকে এখন পর্যন্ত হাটের দামী পশুগুলো অবস্থাপন্নরাই ক্রয় করে থাকেন। পূর্বে মধ্যবিত্তরা তাদের সন্তানদেরকে সঙ্গে নিয়ে ৭ জন শরীকদারসহ ১০/১৫ দিন আগে থেকে পশু ক্রয় করার জন্য বিভিন্ন হাটে গিয়ে পছন্দনীয় পশু তন্ন তন্ন করে খোজ করতেন। শেষ পর্যন্ত সপ্তাহ খানেকের মধ্যে কাংখিত পশু ক্রয় করতে সক্ষম হতেন। কোরবানীর জন্য ক্রয়কৃত পশুটির গলায় ঝড়ির মালা ও ঘঙ্গুর পরিয়ে বাসায় আনতেন। তখন চারদিকে হুলস্থুল পরে যেত। অতঃপর শিশু কিশোরেরা পশুটির পরিচর্যার কাজে লেগে যেতেন। কোরবানীর পশুর পরিচর্যা ও প্রদর্শন নিয়ে পাড়া ও মহল্লার ছেলেদের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগীতা চলতো।

এই প্রতিযোগিতার মধ্যেই নিহিত ছিল ঈদের অগ্রীম আনন্দ ও উল্লাস। বর্তমানে সর্বশ্রেণীর লোকেরা স্থান সংকুলানের অভাবে ঈদের ১/২ দিন পূর্বে কোরবানীর পশু ক্রয় করেন। ঈদুল আযহার সময় নতুন কাপড় কেনার আগ্রহ তেমন থাকে না। কাংখিত পশু কেনার আগ্রহ থাকে অত্যাধিক। চানরাতে মসলাপাতি, সেমাই, ছুরি ও চাপাতি কেনার ধুম পরে যায়। আর কর্মকাররা ব্যস্ত থাকে পুরনো দা, ছুরি শান দেওয়ার কাজে। ঈদের দিন ভোরে শিশু কিশোরেরা নদী বা খালে গিয়ে মনের আনন্দে গোসল করতো, ডুব দিয়ে লাই খেলা খেলতো এবং পাশাপাশি কুরবানীর পশুটিকে উত্তম ভাবে গোসল করাতো। ঈদের নামায শেষ হওয়ার পর বিভিন্ন মসজিদের ইমাম ও মোয়াজ্জিন সাহেবগণ রাস্তার পাশে প্রস্থ জায়গায় খুব দক্ষতার সঙ্গে পশু জবাই করতেন। তবে পাগলাটে ধরনের পশু হলে জবাই করতে বেশ বেগ পেতে হতো। পশু জবাই করার কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর সবাই ব্যাতিব্যস্ত হয়ে পড়তো মাংস কাটার কাজে। মাংস কাটা শেষ হওয়ার পর তা সমহারে তিন ভাগ করা হতো। একভাগ নিজেদের জন্যে, আরেকভাগ ফকির-মিসকিনদের জন্য ও অন্য ভাগ প্রতিবেশি ও আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে বিলি-বন্টন করা হতো। এছাড়াও পশুর চামড়ার বিক্রয়কৃত সম্পূর্ণ টাকাই ফকির মিসকিনদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়া হতো। এভাবে মাংস বিতরণ সম্পন্ন করতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যেতো। কোরবানীর পশু পরিচর্যা থেকে শুরু করে এর মাংস বিতরন, প্রতিটি পর্বেই ছিল ঈদের অতুলনীয় আনন্দ, কিন্তু বর্তমানে খাল-বিল, নদী-নালা ও দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ বেদখল হয়ে যাওয়ার কারনে বর্তমান প্রজন্ম ঈদের এই নির্মল আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

আবহমান বাংলার ঐতিহ্য অনুযায়ী ঈদের আনন্দ চলে তিন দিন পর্যন্ত। আমাদের দেশের যেসব পরিবারের সন্তান ও আত্মীয়-স্বজনরা জার্মানী, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, কেনাডা, সুইডেন, ডেনমার্ক ইত্যাদি দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন তারা ঈদের দিন কোনো সরকারী ছুটি পান না। তাই সেখানে তারা জাঁকজমকভাবে ঈদ উৎসব পালন করতে পারে না। তবে বর্তমানে ইন্টারনেটের বদৌলতে ভিডিও কল ও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অতিঅল্প সময়ের মধ্যে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন। পূর্বে স্বজনরা কিন্তু এই ধরনের সুযোগ কখনো পায় নি। ঈদের পরের দিন সকাল দিকে বাড়ির ছোটরা সকালের নাস্তা সম্পন্ন করে একনাগার ২/৩ দিনের জন্যে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যেতেন, আর সঙ্গে করে উপহার স্বরূপ নিয়ে যেতেন কুরবানীর পশুর রান্না করা মাংস, বাড়ির গাছের মৌসুমী ফল ও মায়ের হাতের তৈরি বিভিন্ন ধরনের পিঠা-পুলি। ৩/৪ দিন পর স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুনরায় খোলতো। অতঃপর ছোট-বড় ও মুরুব্বীরা যার যার কাজে ফিরে যেতো। এই ভাবেই সুদুর অতীত কাল থেকে আজ অবধি আবহমান বাংলায় ঈদ আনন্দ উৎসব পালিত হয়ে আসছে।

বর্তমানে প্রযুক্তিগত উন্নতির বদৌলতে ঈদ উৎসব উদযাপনের মৌলিক ব্যবস্থায় অল্প-স্বল্প পরিবর্তন হচ্ছে। তবে এই পরিবর্তনের ফলে ঈদের মূল আবেদন যাতে বিকৃত না হয়ে অটুট থাকে সেই দিকে সর্বদা খেয়াল রাখতে হবে। ঈদ উৎসব হোক সবার জন্যে। ঈদ আনন্দ সর্বত্র ছড়িয়ে যাক; প্রশাস্তির সুবাতাস বয়ে যাক, ঈদ সবার জন্য হোক নির্মল উৎসবের নাম, এই প্রত্যাশা রেখে লেখার যবনিকা টানলাম।

খায়রুল আকরাম খান : ব্যুরো চীফ, দেশ দর্শন

Some text

ক্যাটাগরি: সাহিত্য, স্মৃতিচারণ

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply

আমি প্রবাসী অ্যাপস দিয়ে ভ্যাকসিন…

লঞ্চে যৌন হয়রানি