বুধবার দুপুর ১২:১৩, ১১ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২৪শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং

বেকারদের বিয়ে এবং পতিতা ও পাত্রীর সাদৃশ্য

জাকির মাহদিন

১. বিয়ের ক্ষেত্রে যদি অর্থকেই প্রাধান্য দেয়া হয় তবে বুঝতে হবে এই পাত্রী এবং পতিতায় কোনো পার্থক্য নেই। পতিতা একরাত্রের জন্য বিক্রি হয় আর পাত্রী বহু রাত্রের জন্য, এই যা পার্থক্য! ২. আজ যে চারদিকে ধর্ষণ-শিশুধর্ষণ-হত্যা হচ্ছে, এর বীজ বুনা হয়েছে বিশ-ত্রিশ বছর আগেই। আমাদের বাপ-চাচা-দাদা-শিক্ষক-গুরুরা নিজেদের আচার-আচরণ, চাহিদা, দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মকাণ্ড দিয়ে তিলে তিলে এর ভিত রচনা করেছেন!

দেশে থাকা শতকরা চল্লিশভাগ বেকার ছেলে একান্ত সৎ এবং গরিব বলেই বেকার। এর পেছনে তাদের অযোগ্যতা, অসততা বা কোনো অলসতা নেই। এদেরকে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র যথাযথ মূল্যায়ন না করে দেশ কখনোই শান্তি ও শৃঙ্খলায় এগিয়ে যেতে পারবে না, আপনা থেকেই পিছিয়ে পড়বে। এরা যথাযথ মূল্যায়ন পেলে দেশ মাত্র দুই বছরে উন্নতির শীর্ষে আরোহণ করতে পারে। অন্যদিকে এরা যদি ষোলো আনার মধ্যে মাত্র ছয় আনা অসৎ হয়, নিজেদের অধিকার জবরদস্তিমূলক আদায়ে পথে নামে, তবে মাত্র ছয়মাসে দেশ তামা হয়ে যাবে। কারণ এদের শক্তিটা একটু বেশিই, কিন্তু সেটা তারা দেখায় না বা প্রয়োগ করে না।

যেসব মেয়ে এবং তাদের অভিভাবক ছেলে সৎ ও যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও কেবল বেকারত্ব অথবা ‘ইনকাম’ কম দেখে বিয়ে দেয় না, এরা উচ্চ-ইনকামধারী ছেলের ঘরে গিয়ে নিজেও নষ্ট হয়, পদে পদে অবমাননা ও হেনস্থার শিকার হয়, স্বামীর ঘরেও আগুন লাগায়। তাছাড়া সমাজে হত্যা, ধর্ষণ ইত্যাদি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে; সেই বেকারদের দ্বারা নয়, অন্যদের দ্বারা। আর পাত্রী কোনো পতিতা নয় যে তাকে অর্থ দিয়ে কিনতে হবে। বিয়ের ক্ষেত্রে যদি অর্থকেই প্রাধান্য দেয়া হয়, তবে বুঝতে হবে এই পাত্রী এবং পতিতায় কোনো পার্থক্য নেই। পতিতা একরাত্রের জন্য বিক্রি হয়, আর পাত্রী বহু রাত্রের জন্য। এই যা পার্থক্য!

আজ যে চারদিকে ধর্ষণ-শিশুধর্ষণ-হত্যা হচ্ছে, এর বীজ বুনা হয়েছে বিশ-ত্রিশ বছর আগেই। আমাদের বাপ-চাচা-দাদা-শিক্ষক-গুরুরা নিজেদের আচার-আচরণ, চাহিদা, দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মকাণ্ড দিয়ে তিলে তিলে এর ভিত রচনা করেছেন! আমরাও এভাবেই গড়ে উঠেছি, গড়ে উঠছি। শিক্ষিত-অশিক্ষিত-উচ্চশিক্ষিত মেয়েরা নিজেদের কেবল একটা যৌনবস্তু হিসেবেই তৈরি ও উপস্থাপন করছে। অভিভাবকরা এক্ষেত্রে সরাসরি সহযোগী। এরা পাত্রদের একধরনের সেক্সুয়াল ব্ল্যাকমেইল করে ‘দর কষাকষি’ করে। তাছাড়া পুরো বিশ্ব, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিজ্ঞান ও কথিত ধর্মগুলোও যেহেতু ভোগবাদে বিশ্বাসী এবং এতেই গা ভাসাচ্ছে, সেহেতু পতিতাব্যবসা থেকে তেমন কেউই মুক্ত নেই।

পাত্রী কোনো পতিতা নয় যে তাকে অর্থ দিয়ে কিনতে হবে। বিয়ের ক্ষেত্রে যদি অর্থকেই প্রাধান্য দেয়া হয়, তবে বুঝতে হবে এই পাত্রী এবং পতিতায় কোনো পার্থক্য নেই। পতিতা একরাত্রের জন্য বিক্রি হয়, আর পাত্রী বহু রাত্রের জন্য। এই যা পার্থক্য!

প্রতিযোগিতা হওয়ার দরকার ছিল কে কত অল্প টাকায় অধিক সুখী ও তৃপ্ত হতে পারে, কে কত অল্প ব্যবহারিক সামগ্রীতে সন্তুষ্ট ও নিজের সুস্থ চিন্তা-চেতনার বিকাশ ঘটাতে পারে। তা না হয়ে হল সম্পূর্ণ উল্টো। ছেলেরা নিজেদের ক্ষণভঙ্গুর যৌন কামনা মেটাতে অধিক পয়সা রুজির বাজারে নিজেদের বিক্রি করে যৌনবস্তু বা একজন দীর্ঘমেয়াদি পতিতা খরিদ করে। এতে সামান্য সময়ের যৌনচাহিদা মিটলেও বাকিসব ভেঙ্গে পড়ে। ধীরে ধীরে পরিবারের প্রতিটি সদস্য মানবিক জীবনবোধ হারিয়ে পাশবিক জীবনে মেতে ওঠে।

এদিকে একটি সীমিত সম্পদের রাষ্ট্রে অধিক পয়সা রুজির প্রতিযোগিতায় যখন কয়েক কোটি যুবক নামে, তখন স্বাভাবিক বাজারব্যবস্থা বিশৃঙ্খল হয়ে কয়েক লাখ যুবক কথিত ‘সফলতা’ লাভ করে। বাকি কোটি কোটি যুবক বেকারত্ব, হতাশা, নেশা ইত্যাদির কানাগলিতে ঘুরতে ঘুরতে মৃত্যুদুয়ারে উপস্থিত হয়। অন্যদিকে লক্ষ লক্ষ অধিক বয়েসী যুবতীও বছরের পর বছর অবিবাহিতই থেকে যায়। ফলে বাড়ে পতিতালয়, অবৈধ গর্ভপাত, হত্যা-আত্মহত্যা, ধর্ষণ-শিশুধর্ষণ ইত্যাদি। বাড়ে বৈষম্য, বিশৃঙ্খলা, নীতি-নৈতিকতা ও ধর্মে সন্দেহ। বাড়ে প্রতারণা, নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, অবিশ্বাস ও স্বার্থপরতা।

আগেই বলেছি, শতকরা চল্লিশভাগ বেকার/অল্প রোজগারী ছেলে দেশপ্রেমিক, সৎ এবং যোগ্য। এদের বেকারত্ব-অল্পরুজির মূল কারণ রাষ্ট্রীয় সীমাহীন শোষণ, বৈষম্য এবং পুঁজিবাদের অবাধ প্রতিযোগিতা। সুতরাং এদের বয়স ত্রিশ পার হলে (বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায়) সমাজ ও রাষ্ট্র এদের কর্মসংস্থান/বেকারভাতা এবং বিয়ের ব্যবস্থা করা অবশ্য কর্তব্য। তা না করলে সরকারকে বিচারের আওতায় আনা যাবে। আর কোনো সরকারি কর্মকর্তা যদি এদের বিয়ের বিরুদ্ধে কথা বলে, তবে তার ফাঁসির দাবি তোলাও যৌক্তিক।

আর্থসামাজিক সমস্যার মূল কারণ বৈষম্য এবং বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি। আর এটা লালন করছি আপনি আমি সবাই। এটা যদি আমরা মাত্র একশো জন নিজেদের মধ্যে এই মুহূর্তে ভেঙ্গে দেয়ার প্রতিজ্ঞা করতে পারি, এতেই ইতিহাস সৃষ্টি হবে। অন্যদিকে রাষ্ট্রও দশ-বিশ বছরের জন্য সর্বোচ্চ পুঁজির একটা সীমা নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। সুখী-সুন্দর জীবন যাপনে অসীম পুঁজির কোনোই প্রয়োজন নেই।

এদিকে ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবেও একটা ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। যেসব অবিবাহিতা মেয়ের বয়স ২৫/৩০ পার হয়েছে, এদের ধরে ধরে ওদের সঙ্গে বিয়ে দিতে হবে। এখানে বেকারত্ব বা অল্পরুজি কোনো সমস্যা না। সমস্যা হচ্ছে অতিরিক্ত চাহিদা ও বিলাসী মনোভাব। এটি ত্যাগ করে চারটি হাত কাজ করলে বিশ্বকেও জয় করা সম্ভব। তাছাড়া বৈষম্য কমাতে এবং আর্থসামাজিক ও সামগ্রিক ভারসাম্য সৃষ্টি ও রক্ষায় সচ্ছলরা অসচ্ছলদের খুঁজে খুঁজে বের করে আত্মীয়তা করতে হবে। নইলে সামগ্রিক ভারসাম্য আপনা থেকেই ভেঙ্গে পড়বে।

আর্থসামাজিক সমস্যার মূল কারণ বৈষম্য এবং বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি। আর এটা লালন করছি আপনি আমি সবাই। এটা যদি আমরা মাত্র একশো জন নিজেদের মধ্যে এই মুহূর্তে ভেঙ্গে দেয়ার প্রতিজ্ঞা করতে পারি, এতেই ইতিহাস সৃষ্টি হবে। অন্যদিকে রাষ্ট্রও দশ-বিশ বছরের জন্য সর্বোচ্চ পুঁজির একটা সীমা নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। সুখী-সুন্দর জীবন যাপনে অসীম পুঁজির কোনোই প্রয়োজন নেই। তাই একটা সমবণ্টন ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন মালিকানা নির্ধারণ করে দিতে হবে, বিশেষ একটা সময় পর্যন্ত। সরকার মাত্র ত্রিশভাগ সৎ হলেই এটা সম্ভব।

আমি নিজে বেকারদের কর্মসংস্থানের কাজ নিয়ে মাঠে নামলে আশা করি বিনাপুঁজিতে অন্তত দশ লক্ষ বেকারের কর্মসংস্থান করতে পারব। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, যেহেতু এদের চাহিদা অসীম (কেবল সুযোগের অভাবে সীমিত), তাই এদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন না করে এবং উপযুক্ত প্রশিক্ষণ না দিয়ে সুযোগ সৃষ্টি করলে এই দশ লক্ষ বেকারের দুই লক্ষ আবার দশ বছরের মাথায় সরাসরি শোষক হয়ে যাবে। এর মধ্যে পঞ্চাশ হাজার শোষক পরবর্তী আরো দশ-বিশ লক্ষ বেকারত্ব সৃষ্টির কারণ হবে। শ্রমিকদের শোষণ ও নির্যাতন করবে।

অন্যদিকে আমিও পর্যাপ্ত জ্ঞানগত সহযোগিতার অভাবে ড. ইউনুস বা ফজলে হাসান আবেদের মতো একজন বড় মাপের ‘মহাজন’ বা ‘মহাশোষক’ হয়ে যেতে পারি। কারণ এসব কাজে দেশি বিদেশি প্রচুর আর্থিক সহযোগিতা এবং মিডিয়ার সমর্থন পাওয়া যায়। কারণ এরা চায়, এদের ‘গদি’ ঠিক রেখে আপনি যা ইচ্ছে করুন।

চলবে…

জাকির মাহদিন : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

zakirmahdin@yahoo.com

 

 

ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম,  সম্পাদকের কলাম

ট্যাগ: জাকির মাহদিন

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply