বুধবার ভোর ৫:২৫, ১১ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২৩শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং

প্রযুক্তির ছোঁয়ায় গ্রামীণ বৈচিত্র্যতায় প্রভাব

আদিত্ব্য কামাল

প্রযুক্তি বিজ্ঞানের আবিষ্কার। প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার নির্ভর করে তার পরিচালকের ওপর। পৃথিবীর যত সৃষ্টি রয়েছে তার সব কিছুকে যেমন ভালো কাজে ব্যবহার করা যায় তেমনি তা মন্দ কাজেও ব্যবহার করা যায়। ভালো ও মন্দ কাজে ব্যবহার ব্যক্তির পরিচালনার ওপরই নির্ভর করে।

প্রযুক্তির মাধ্যমে পৃথিবীকে এগিয়ে নিতে হবে। মানুষের কল্যাণে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে হবে। কিছু কিছু প্রযুক্তি মানুষের কল্যাণের জন্য নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আণবিক বোমা জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরকে ধ্বংস করে দিয়েছিল।

প্রযুক্তির কল্যাণেই সারা পৃথিবী একটি গ্রামে পরিণত হয়েছে। হাতের মুঠোয় পুরো বিশ্ব। প্রযুক্তির কল্যাণে নিমিষেই সারা বিশ্বের যে কোনো খবর পৌছে যায় মানুষের কাছে। হাজার হাজার মাইল দূরে অবস্থানকারী মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়।

প্রযুক্তি মানুষের কল্যাণের জন্য আবিষ্কার হলেও কোন কোন সময় মানুষের অকল্যাণ ডেকে আনে। মোবাইল ফোন বর্তমান সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি। মোবাইল ফোন সহজ লভ্য হওয়ায় যোগাযোগের ব্যবস্থা সহজতর হয়েছে বটে কিন্তু এই মোবাইল ফোনের অপব্যবহারে শিকারও মানুষ কম হচ্ছে না। তেমনি ফেইস বুক সামাজিক যোগাযোগের একটি অন্যতম মাধ্যমে। কিন্তু সেখানে বিপত্তির অভাব নেই। কত রকমের অঘটন ঘটছে এই দুটি প্রযুক্তির মাধ্যমে। তাই বলে কি-প্রযুক্তির দোষ। না; প্রযুক্তি উদ্ভব মানুষের কল্যাণে। শুধুমাত্র ব্যবহার বিধির যথাযথ নিয়ম-কানুন না থাকায় অপকর্মের সৃষ্টি হচ্ছে; ঘটছে হাজারও রকমের দুর্ঘটনা।

আজকের প্রযুক্তি মানুষের জ্ঞানের পরিধিকে অনেক গুণ বৃদ্ধি করেছে। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় মানুষ বিশ্বজগৎটা হাতের মুঠো নিয়ে আসতে পেরেছে। মুহূর্তের মধ্যে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের খোঁজ-খবর নেয়া সম্ভব হচ্ছে। কর্মক্ষেত্রের উন্নতি হয়েছে। হাজার রকমের কর্মক্ষেত্রের সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষিত সমাজ প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে নিজেকে তুলে ধরতে পারছে ধরিত্রির বুকে। ফুটিয়ে তুলছে নিজের কর্মদক্ষতা। তবু প্রত্যেকটি ভালো কিছুর পেছনে অনেক খারাপ কর্মকাণ্ড লুকায়িত থাকে। যা মেধা ও কর্মদক্ষতা এবং উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে খুঁজে বের করতে হয় এবং ভালোগুলো রেখে খারাপগুলো পরিত্যাগ করতে হয়। কিন্তু চাইলে মানুষ খারাপের পরিধি থেকে বের হতে পারে না। খারাপ কর্মকাণ্ড মানুষকে জাদুর মতো আকৃষ্ট করে রাখে। একটি গোলক ধাঁ ধাঁ মধ্যে পরিবেষ্টিত করে রাখে; যেখান থেকে সহজে বের হওয়া মুশকিল ব্যাপার। তবে ভালো ও খারাপের অধিকাংশটাই নির্ভর করে মানুষের রুচিবোধের উপর। প্রযুক্তি ব্যবহার করে কেউ বিকৃত মস্তিষ্কের অধিকারী হয়ে অনেক অপকর্ম করে থাকে, যা পরিবার, সমাজ ও জাতীর জন্য কলংকিত অধ্যায় রচনা করে আবার অনেকেই প্রযুক্তির ছোঁয়া পেয়ে পরিবার, সমাজ ও জাতীর মাথা উঁচু করে।

আবার এই প্রযুক্তির ছোঁয়া কিভাবে আমাদের গ্রামের বৈচিত্র্যতাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। দিনে দিনে মানুষের মধ্যে শহরে শহরে ভাবের উদয় হচ্ছে আর গ্রামীণ বৈচিত্র্যগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। ইট, পাথর, কাঠ গ্রামীণ জীবনটাকে বদলিয়ে দিচ্ছে। সেই মাটির ঘর আর ছনের ঘর খুঁজে পাওয়া দুষ্কর ব্যাপার হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন ডিজাইনের বিল্ডিং এবং টাইলসের কারুকার্য গ্রামের মানুষগুলোর মনে যেন নেশা ধরিয়ে দিয়েছে। একের পর এক নতুন নতুন ঘর-বাড়ি তৈরি হচ্ছে। ভরাট হচ্ছে ফসলী জমি আর মুক্তজলাশয় ও পুকুরগুলো। খাল-বিল, নদী-নালা ক্রমান্বয়ে ভরাট হয়ে কোন কোনটি অস্তিত্বহীন হয়ে আছে। কোনটি যদিও রয়েছে তবে, তা অর্ধমৃত অবস্থায় রয়েছে। যে সব পুকুর রয়েছে সেগুলোর মধ্যে পূর্বের বৈচিত্র্যতা এবং জলের স্বাদ, গন্ধের অস্থিত্ব নেই। মাছচাষীরা বিষাক্ত খাবার প্রয়োগ করে জলগুলোকে কেমন যেন বিষাক্ত বিষাক্ত করে ফেলেছে। গোসল করতে রুচিবোধ হয় না, সাতার কাটার প্রশ্নেই উঠে না। কিছুক্ষণ থাকলেই শুরু হয়ে যায় চুলকানি। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ এখন আর পুকুরের জল ব্যবহার করে না। ধোয়া, মুছাসহ গৃহস্থালী কোন কাজেই পুকুরের জল ব্যবহার করে না। ঘরে ঘরে প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগে গেছে। ইলেক্ট্রিক মটরের মাধ্যমে মাটির নিচ থেকে জল উত্তোলন করে ট্যাংকি ভর্তি করে রাখে এবং প্রয়োজন মতো ব্যবহার করে থাকে। অথবা উন্নতমানের টিউবওয়েলের জলের মাধ্যমে খাওয়া-দাওয়া, ধোয়া-মুছা ও গোসলের কাজ সমাধান করে। ফলে পুকুরে জল ভালো থাকুন আর নাই থাকুক, তাতে কারো কিছু আসে-যায় না; অল্প কিছু গরীব ও সাধারণ পরিবারের মানুষ ছাড়া। যাদের একান্ত কোন উপায় নেই; তারা তো বাধ্য হয়েই মাছের খাবারে নষ্ট হয়ে যাওয়া জলের উপরই নির্ভর করতে হয়। মাছ চাষ লাভজনক হওয়ায় এবং প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে মানুষ কোন পুকুর আর খালি রাখতে চায় না। যাদের সম্ভব হয় নিজেরাই মাছ চাষ করে অন্যথায় লীজ প্রদান করে থাকে। লীজ গ্রহীতারা অধিক ফলনের প্রত্যাশায় যা-তা খাবার ফেলে পানির প্রকৃত অবস্থার বিনষ্ট করে ফেলে। এমনও দেখা যায় মরা মুরগি, মরা গরু, মরা হাঁস, মুরগির বিষ্টা, মল-মূত্র, গরুর মল অবাধে পুকুরে ফেলছে। এতে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে কিন্তু দেখার যেন কেউ নেই।

গ্রামের মধ্যে শহরের প্রার্দুভাব চলে এসেছে। নেই গ্রামীণ মেঠো পথ, খোলা আকাশ আর মুক্ত হওয়া। কেমন যেন আবদ্ধ আবদ্ধ মনে হয়। বিদেশী বিভিন্ন প্রজাতির গাছ-পালার বাগান বৃদ্ধি হওয়ায় সকাল-বিকাল পাখিদের কলরব শুনা যায় না। দেশি ফলদ বৃক্ষের অভাবে তারাও যেন পর পর হয়ে গেছে। ছেড়ে গিয়েছে আমাদের গ্রামীণ জনপদ। পাখিদের কলরবে এখন আর ঘুম ভাঙ্গে না; মানুষের কলরবেই ঘুম ভাঙ্গে। আমরা আজ বাঙালিয়ানা কে ক্রমান্বয়ে ছেড়ে দিয়ে বিদেশীয়ানায় মশগুল হয়ে গিয়েছি। খাওয়া-দাওয়া, উঠ-বসা, চাল-চলন, কথা-বার্তায় বাঙালির সরল প্রকৃতির ছোঁয়া পাওয়া যায় না। আত্মার আত্মীয়তার বন্ধনে ছেদ পড়েছে-মানুষগুলো আত্মকেন্দ্রীক হয়ে গেছে। ধর্ম-কর্ম পালনের ক্ষেত্রও আগের মতো সামাজিক বন্ধন নেই; প্রত্যেকটি মানুষ নিজের মতো করে ধর্ম-কর্ম পালন করতে চায়। সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানগুলো জাঁকজমকপূর্ণ হয় না। গুটি কতেক মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।

বিভিন্ন কারনে গ্রামীন প্রাকৃতিক পরিবেশ ও ভারসাম্যতা বিনষ্ট হয়েই চলেছে। অপরিকল্পিত গৃহায়ন নির্মাণের ফলে খাল-বিলগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় দেশি মাছগুলো হারিয়ে গিয়েছে। এখন ইচ্ছে হলে দেশি মাছ পাওয়া কঠিন ব্যাপার। দেশি মাছের আদলে চাষের মাছ পাওয়া যায় কিন্তু দেশি মাছের স্বাদটা পাওয়া যায় না। সেই সাথে দেশি ফলগুলোও হারিয়ে যাচ্ছে। আম, জাম, কাঁঠাল, আনারস, পেয়ারাসহ দেশি ফলের গাছগুলো ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাওয়ায় দেশি ফলের চাহিদা পুরণ হচ্ছে না। ফলে বিষাক্ত ফরমালিন যুক্ত ফল একান্ত বাধ্য হয়ে খেতে হয়। এই বিষয়ে আমার এক বন্ধু হাস্যরস করে বলেছিলেন, বড়ই দুঃখ হয় যে টাকা দিয়ে বিষ কিনে আপনজনদেরকে খাওয়াচ্ছি। দু’চোখের সামনে তার কথার প্রতিফলন হর-হামেশা দেখতে পাচ্ছি।

জ্ঞান-বিজ্ঞানের এসব আবিষ্কার মানুষের জন্য অভিশাপ নয়। এগুলোর মানুষকে উন্নতির দিকে নিয়ে যায়। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে তা সবার জন্য হয়ে ওঠবে কল্যাণকর।

মনে রাখা জরুরী জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে কোনো আবিষ্কার তথা প্রযুক্তি কোনোটিই খারাপ নয়। তবে এটি নিশ্চিত করতে হবে যে চাইলে যে কেউ এসব আবিষ্কার বা প্রযুক্তি সঠিক কাজে লাগাতে সক্ষম। আবার চাইলে মন্দ কাজেও ব্যবহার করতে সক্ষম।

সুতরাং জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষের জন্য কল্যাণকর। এর চিন্তা-ভাবনা-গবেষণাও কল্যাণকর। এর সঠিক ব্যবহারও কল্যাণকর। প্রযুক্তিকে মানুষ যখনই কল্যাণমূলক কাজ তথা সঠিক কাজে ব্যবহার করবে তখনই এটি মানুষের জন কল্যাণকর হবে।

আদিত্ব্য কামাল: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

ক্যাটাগরি: মিনি কলাম

ট্যাগ:

[sharethis-inline-buttons]

Comments are closed.