বুধবার দুপুর ১২:৫৯, ১১ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২৪শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং

নারীর মানুষ পরিচয়ের চেয়ে লিঙ্গ পরিচয়ই প্রাধান্য পাচ্ছে

জান্নাতুল মাওয়া ড্রথি

চলমান সমাজ, রাষ্ট্র ও অর্থনীতিতে লোভ লালসা এবং ভোগবাদী জীবনকে উৎসাহিত করা হচ্ছে ব্যাপকভাবে। আর এর প্রধান শিকার নারীরা। নারী এখন কেবলই ভোগ্যপণ্য। তাঁর ‘মানুষ’ পরিচয়ের চেয়ে ‘লিঙ্গ’ পরিচয়ই প্রাধান্য পাচ্ছে।

আজ আমাদের সমাজে যে অস্থিরতা বিরাজ করছে, বিশেষ করে নারীর প্রতি অবমাননাকর আচরণ- লাঞ্ছনা, নির্যাতন, ধর্ষণ- এসব একটা রাষ্ট্র ও সমাজের চরম অধঃপতনের প্রমাণ। শুধু যে নারী বা মেয়ে শিশুর ক্ষেত্রে হচ্ছে তা নয়, ছেলে শিশুরাও অনিরাপদ। তারাও এ ভয়ঙ্কর লালসা ও নির্যাতনের শিকার। নারীর ক্ষেত্রে ৬ বছরের শিশু থেকে ৬০ বছরের বৃদ্ধাও বাদ যাচ্ছেন না, যদিও তরুণী এবং মধ্যবয়স্কা নারীরাই প্রদান টার্গেট। প্রশ্ন হচ্ছে, এর মূল সমস্যাটা কোথায়?

তথাকথিত ধর্মান্ধ সমাজের ভাষায় নারীর পোশাক দায়ী। আবার প্রগতিশীল সমাজ বলছে ধর্মান্ধ হুজুরদের ওয়াজ মাহফিলে নারীর প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য এসব হচ্ছে। কারো কারো মতে, নারীর প্রতি রাষ্ট্র ও সরকারের উদাসীন মনোভাব দায়ী; নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না। তাঁরা চাইছে সরকার আরো কঠোর আইন করুক এমনকি এক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করুক। কারো কারো মতে, সরাসরি ক্রসফায়ারে দেওয়া হোক। এককথায়, নানা মুনির নানা মত। তাহলে প্রকৃতপক্ষে সমস্যা কোথায়? আইন করে কিংবা ক্রসফায়ার দিয়ে কি ধর্ষণ ঠেকানো সম্ভব? ওয়াজ মাহফিল বন্ধ করলেই কি সমাজে নারীর প্রতি বিদ্বেষমূলক দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাবে? সরকার পরিবর্তন করলেই কি এই পরিস্থিতির পরিবর্তন আসবে?

প্রকৃতপক্ষে এগুলোর কোনোটাই আসল সমস্যা নয়। সমস্যা আরো অনেক বড়, যার শেকড় গেঁথে গিয়েছে সমাজের অভ্যন্তরে, রন্দ্রে রন্দ্রে ছড়িয়ে পড়েছে বিষ, যা আজ ক্যান্সারে রূপ নিয়েছে। আসলে এর শেকড় আছে আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা, সমাজ ব্যবস্থ্য, শিক্ষা ব্যবস্থায ও ধর্মগুলোর অপব্যাখ্যায়। এটা শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীর একই অবস্থা। বিশেষ করে এশিয়া মহাদেশে। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতেও নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে পাশের দেশ ভারতে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আরো করুণ! এতেই বোঝা যায় সমস্যা কতো গভীরে। কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা বাদ দিলে নারীর প্রতি অবমাননাকর আচরণ কি সমাজে বন্ধ আছে? না, নেই। নারী আজ কোথাও নিরাপদ নয়; কি ঘর কি বাহির। আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ ও শিক্ষাব্যবস্থা এমনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে, তাতে নারী আজ সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ। এর সাথে যোগ হয় ধর্মীয় অপব্যাখ্যা, ধর্মান্ধ গোষ্ঠীগুলোর নারীকে পদদলিত করার অপপ্রয়াস। এর বিপরীতে আবার তথাকথিত প্রগতিশীল সমাজের নারীকে নগ্নভাবে উপস্থাপনের নোংরা খেলা।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কতটুকু মানবিক ও নৈতিক! এতে সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষা কতটুকু দেওয়া হয়? বাংলাদেশে চালু রয়েছে ত্রিমুখী শিক্ষাব্যাবস্থা- বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি মাধ্যম এবং মাদরাসাশিক্ষা (আরবি-উর্দু মাধ্যম) ব্যবস্থা। অথচ আমাদের প্রয়োজন ছিল একমুখী শিক্ষা। এই তিন মাধ্যমে তিন শ্রেণির মানুষ তাদের সন্তানদের পড়াচ্ছেন। যে কারণে সমাজে শ্রেণিভিত্তিক মানসিকতা গড়ে উঠছে ও শেণিবিভক্তি বাড়ছে। এই যে ত্রিমুখী শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষাজীবন শেষ করে নাগরিকগণ সমাজে বিচরণ করছে, এটা কতটা মানবিক ও নৈতিক শিক্ষায় ভরপুর? আমরা যদি লক্ষ্য করি তাহলে দেখব, এদেশে দুর্নীতি, অর্থপাচার এবং রাষ্ট্রদ্রোহী যত যা আছে এর সবটাই শিক্ষিত সমাজের কার্যকলাপ। তাহলে আমরা কী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলেছি, যেখানে হিংসা, স্বার্থপরতা, লোভ লালসা এবং সমাজের প্রতি ও মানুষের প্রতি বিশেষ করে নারীর প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব ও ধর্ষণ নির্যাতন বাড়ছে?

শিক্ষিত চাকরিজীবী নারীরা যে সঠিক মূল্যবোধের পরিচয় দিচ্ছেন, তাও কিন্তু না। পরিবার, সমাজ, শিক্ষাব্যবস্থা, অর্থনীতি, রাষ্ট্র তাঁকে এমন মানসিকতায় গড়ে তুলছে, যেখানে সে তাঁর স্বাধীনতা বলতে বুঝে অর্থ উপার্জন। অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকেই সে মুক্তির একমাত্র পথ ভাবছে। সমাজ এখন সব রকমের কুসংস্কার আর অন্ধশিক্ষায় ভরপুর। স্বাধীনতা আর মুক্তির নামে তাঁকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে ভোগের পণ্য হিসেবে। অনৈতিক সম্পর্ক ও স্বেচ্ছাচারী জীবনকে সে স্বাধীনতা ভাবছে। আর এগুলোর বাইরে আছে ধর্মান্ধদের ধর্মীয় অপব‌্যখ্যার চিরাচরিত সেই ভয়ঙ্কর সমাজচিত্র। যেখানে নারী মানসিক ও শারীরিক উভয়ভাবেই নির্যাতিত।

সার্টিফিকেটধর্মী এ শিক্ষাব্যবস্থায় কিছু নির্দিষ্ট সিলেবাস দেওয়া হয়, যা প্রকৃত জ্ঞাননির্ভর শিক্ষার ধারেকাছেও নেই। এ তিন মাধ্যেমের শিক্ষা ব্যবস্থায় এর ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়ছে আজকের সমাজে। এর বেশিরভাগ শিকার হচ্ছে পরিবারে ও সমাজে নারীরা। এই অসম্পূর্ণ, নৈতিকতাবিবর্জিত কর্পোরেট শিক্ষা সমাজ, পরিবার ও রাষ্ট্রকে ভালো কিছু দিতে পারছে না। রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা এই ব্যবস্থা পরিবর্তনে কোনো আগ্রহও দেখাচ্ছে না। বরং এই ব্যবস্থাকেই উৎসাহিত করছে।

তথাকথিত গণতন্ত্রের নামে যে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠেছে সেটাই বা কতটা নিরাপদ? গণতন্ত্রে স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারিতা চলছে। আমাদের বলা হচ্ছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না তাই সমস্যা বাড়ছে। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সত্যিই কি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে! যে সমাজে এমন অদ্ভুত মানসিকতা বিরাজ করে, রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে তাদের কতটা সঠিক ভূমিকা থাকতে পারে। আমরা সমাজের নাম করে কত প্রকার অবান্তর ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করেছি। আর এর সবচেয়ে বড় শিকার নারীরা। চলমান সমাজ, রাষ্ট্র ও অর্থনীতিতে লোভ লালসা এবং ভোগবাদী জীবনকে উৎসাহিত করা হচ্ছে ব্যাপকভাবে। এর প্রধান শিকার নারী। নারী এখন কেবলই ভোগ্যপণ্য। তাঁর ‘মানুষ’ পরিচয়ের চেয়ে ‘লিঙ্গ’ পরিচয়ই প্রাধান্য পাচ্ছে।

আরো পড়ুন> শাস্তি দিয়ে ধর্ষপ্রবণতা ঠেকানো অসম্ভব

একজন প্রতিবাদী নারী সমাজের চোখে নষ্টা। এ সমাজে নারীকে হতে হবে বিলাসী, সংসারমনা, চারদেয়ালবদ্ধ। যে বুঝবে কম, জানবে কম, শুনবে কম। সে শুধু সব নিয়মের সাথে তাল মেলাবে। জানা এবং বুঝাটা এই সমাজ নিতে পারে না। আবার এই নিয়মগুলো ভেঙে যখন নারী বের হতে চাইছে, তখন বাইরে তার জন্য এমন একটা অস্থিরতা তৈরি করে রাখা হয়েছে, যেখানে তাঁকে টিকতে গেলে হতে হবে স্বেচ্ছাচারী, সমাজবিরুদ্ধ, ইত্যাদি ইত্যাদি। নয়তো সে টিকতে পারবে না।

শিক্ষিত চাকরিজীবী নারীরা যে সঠিক মূল্যবোধের পরিচয় দিচ্ছেন, তাও কিন্তু না। পরিবার, সমাজ, শিক্ষাব্যবস্থা, অর্থনীতি, রাষ্ট্র তাঁকে এমন মানসিকতায় গড়ে তুলছে, যেখানে সে তাঁর স্বাধীনতা বলতে বুঝে অর্থ উপার্জন। অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকেই সে মুক্তির একমাত্র পথ ভাবছে। সমাজ এখন সব রকমের কুসংস্কার আর অন্ধশিক্ষায় ভরপুর। স্বাধীনতা আর মুক্তির নামে তাঁকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে ভোগ্যপণ্য হিসেবে। অনৈতিক সম্পর্ক ও স্বেচ্ছাচারী জীবনকে সে স্বাধীনতা ভাবছে। আর এগুলোর বাইরে আছে ধর্মান্ধদের ধর্মীয় অপব‌্যখ্যার চিরাচরিত সেই ভয়ঙ্কর সমাজচিত্র। যেখানে নারী মানসিক ও শারীরিক উভয়ভাবেই নির্যাতিত। নারীকে আত্মাহীন ও অভিশাপ থেকে শুরু করে সমাজের একটা ‘জড় জীব’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এখানে নারীর কোনো বাকস্বাধীনতা নেই, সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার নেই। সে শুধু স্বামীর জৈবিক চাহিদা পূরণ, সন্তান লালন-পালন আর সংসারের কাজ করবে। তার অন্য কোনো গঠনমূলক ভূমিকা থাকতে পারবে না পরিবার, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে। তাঁকে আপাদমস্তক একটা তাঁবু হয়ে হয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে।

শুধুমাত্র নির্দিষ্ট একটা ধর্ম নয় বরং সকল ধর্মের তথাকথিত হুজুর-পণ্ডিতদের প্রধান টার্গেট নারী। ধর্মের নামে জাতপাত, বিভেদ ও নারীই এদের প্রধান টার্গেট। ধর্মগ্রন্থগুলোর বাইরে মনগড়া ধর্মীয় ব্যাখ্যা তৈরি করছে তথাকথিত ধর্মগুরুরা। এই যখন আজকের অবস্থা, তখন শত শত মিটিং-মিছিল-আন্দোলন কিংবা আইন কোনো কাজেই আসবে না নারীর উপর আগ্রাসন ঠেকাতে। এই গভীর সমস্যা থেকে বের হতে আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, সমাজ ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। আজকের এই রাষ্ট্র, সমাজ ও শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হবে।

এই ভোগবাদী, স্বার্থবাদী অস্থির শিক্ষা ও সমাজব্যবস্থা পরিবর্তন করতে হবে। আর তার সাথে বন্ধ করতে হবে ধর্মীয় অপব্যাখ্যা। ধর্মীয় অপব্যাখ্যার বিষয়ে নিতে হবে কঠোর অবস্থান। এভাবেই শুধু নারী নয়, পুরো সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রত্যেক নাগরিক নিরাপদ থাকবে। নারীও তাঁর প্রকৃত মুক্তি লাভ করবে। সমাজের এই দাসত্ব থেকে বেরিয়ে তাঁর সত্যিকারের সেই মুক্তির সন্ধান মিলবে।

জান্নাতুল মাওয়া ড্রথি: গবেষক ও কলামিস্ট

ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম

ট্যাগ: জান্নাতুল মাওয়া ড্রথি

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply