শুক্রবার দুপুর ২:০০, ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ. ২৯শে মার্চ, ২০২৪ ইং

দুঃখকে ব্যবহার : জন্মই কি আজন্ম পাপ?

জাকির মাহদিন

‘মানুষ’ বলতেই তার নিজস্ব ও স্বতন্ত্র একটা অনুভব-অনুভূতি, শিক্ষা-অভিজ্ঞতা, কষ্ট-ভালোবাসা প্রভৃতির সমন্বিত মানসিক এক বিশাল ও রঙিন জগত। এ জগত মহাবিশ্বের চেয়েও অনেক অনেক বড় এবং মূল্যবান। এর নিরাপত্তাবেষ্টনীও বড় মজবুত। কেউ নিজে না চাইলে দুনিয়ার কোনো শক্তি নেই সেখানে প্রবেশ বা আক্রমণ করার।

পৃথিবীর মাটি খুব বেশি নয়। সাগরের পানিও যথেচ্ছ নয়। বাতাস প্রয়োজনের তুলনায় সামান্যই। আকাশেরও একটা সীমা আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু এই সমাজে, এই দেশে, এই বিশ্বে একই জমিনের উপরে ও আকাশের নীচে, আপনার আমার আশপাশে অসংখ্য লাঞ্ছিত-বঞ্চিত-প্রতারিত, অসহায়-দুর্বল, সহায়-সর্বস্বহীন মানুষ আছেন যাদের দুঃখের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই।

কষ্ট-অশান্তির শেষ নেই। বিপদ-আপদ, বালা-মুসিবত একটার পর একটা লেগেই থাকে, যাকে বলে মড়ার ওপর খাড়ার ঘাঁ। প্রতিমুহূর্তে প্রাণপণ সংগ্রাম চালিয়ে তিল তিল করে তাদের বাঁচতে হয় সুখের জন্য নয়, আরো বেশি দুঃখ ভোগের জন্য। চারপাশের এত উন্নয়ন, এত চাকচিক্য, আলো ঝলমল, ফুর্তিবিলাস এদের বিন্দুমাত্র উপকারে আসে না। কেন এ জীবন? কী তার অর্থ? এ মৃতপ্রায় বেঁচে থাকার মানে কী? জন্মইবা কেন? ‘জন্মই আজন্ম পাপ’?

অথচ এই অভিশপ্ত জীবনেও মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসার কেন অমন আকুতি? এই জীবন থাকলেই-বা কী গেলেই-বা কী? কিন্তু না, তবুও বাঁচতে চাই। যে কোনো মূল্যেই হোক, আপাতত বেঁচে থাকাটাই যেন প্রথম কথা। তারপর অন্যকিছু ভাবা যাবে। এই অতৃপ্ত, অসুখী, তুচ্ছ কিংবা পাপ-পঙ্কিলতাপূর্ণ জীবনেও যখন আরো বড় কোনো দুর্যোগ-দুর্ঘটনা ঘটে বা মৃত্যুকে খুব কাছাকাছি দেখতে পাওয়া যায়, তখন বোঝা যায় এর মূল্য কত! আরো একটিমাত্র মুহূর্ত, আরো একটিমাত্র দিন, মাস, বছর বাঁচবার কী তীব্র বাসনা! কী প্রচণ্ড আকুতি! অবশ্য কেউ কেউ এসব কষ্ট-ক্লেশ ও মানসিক যাতনার চাপ সইতে না পেরে স্বেচ্ছায় চলেও যায়। কোথায়? দূর অজানায়!

ঠিক এই মুহূর্তে যে শুক্রকণা ও ডিম্বকণা ‘মানুষ’ হিসেবে অনুমোদন লাভ করেছে, সেই সমন্বিত কণাটিরও রয়েছে দুটো আলাদা বংশ, শিক্ষা ও পরিবেশগত ইতহাস-ঐতিহ্য-অভিজ্ঞতা এবং শূন্যহাতে (অবশ্য তখনো তার হাত সৃষ্টি হয়নি) কঠিন সংগ্রামে বিজয়ের গৌরবোজ্জ্বল অতীত

বর্তমান পৃথিবীতে মানুষ আছে অন্তত সাতশত কোটি। প্রতিমুহূর্তে বিশ্বে জন্ম নিচ্ছে একাধিক মানবশিশু। গড়পড়তা দেখলে মনে হবে অন্য প্রাণী-প্রজাতির মতোই মানুষও এক শ্রেণির প্রাণী বা প্রজাতিবিশেষ। কিন্তু আলাদা করে বিচার করলে দেখা যাবে জীবিত সাতশত কোটি মানুষের প্রত্যেকেরই রয়েছে জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, তিক্ত বাস্তবতার মুখোমুখি সংগ্রাম, চিন্তাভাবনা ও অনুভব-অনুভূতির এক বিচিত্র সমাহার। চিন্তা-চেতনা-অভিজ্ঞতার এক একটা বিশাল মানসিক জগত। এ জগত তার নিজস্ব, স্বতন্ত্র, বিশিষ্ট। প্রাণীজগত দূরের কথা, দ্বিতীয় কোনো মানুষের পক্ষেই অন্য কারো স্বাতন্ত্র্য ও নিজস্বতা চুরি কিংবা কপি করা সম্ভব নয়। ভবিষ্যতে যদি কোনো যন্ত্রের মাধ্যমে করাও যায় তবেও যন্ত্র তো নয়ই, কোনো মানুষও তা ধারণ করতে পারবে না। করতে গেলে সেই বাস্তবতার তিক্ত-পিচ্ছিল পথ পেরিয়েই তাকে আসতে হবে অথবা নিজস্বতা বিসর্জন দিতে হবে।

‘মানুষ’ বলতেই তার নিজস্ব ও স্বতন্ত্র একটা অনুভব-অনুভূতি, শিক্ষা-অভিজ্ঞতা, কষ্ট-ভালোবাসা প্রভৃতির সমন্বিত মানসিক এক বিশাল ও রঙিন জগত। এ জগত মহাবিশ্বের চেয়েও অনেক অনেক বড় এবং মূল্যবান। এর নিরাপত্তাবেষ্টনীও বড় মজবুত। কেউ নিজে না চাইলে দুনিয়ার কোনো শক্তি নেই সেখানে প্রবেশ বা আক্রমণ করার। শুধু প্রাপ্তবয়ষ্ক নয়, সদ্য ভূমিষ্ঠ মানবশিশুরও একটা মূল্যবান অতীত এবং অনুভূতিজগতের এক বিশাল ইতহাস-ঐতিহ্য-অভিজ্ঞতা আছে।

শুধু তাই নয়, ঠিক এই মুহূর্তে যে শুক্রকণা ও ডিম্বকণা ‘মানুষ’ হিসেবে অনুমোদন লাভ করেছে, সেই সমন্বিত কণাটিরও রয়েছে দুটো আলাদা বংশ, শিক্ষা ও পরিবেশগত ইতহাস-ঐতিহ্য-অভিজ্ঞতা এবং শূন্যহাতে (অবশ্য তখনো তার হাত সৃষ্টি হয়নি) এক কঠিন ও অসম সংগ্রামে বিজয়ের গৌরবোজ্জ্বল অতীত। কোটি কোটি শুক্রকণা ও ডিম্বকণার মানবদৌড়ে মাত্র দুটিই মনোনীত এবং বিজয়ী। এ দুটি মিলে আবার একটি। স্বীকৃতি লাভের পরমুহূর্ত থেকেই আবার শুরু আরেক কঠিন সংগ্রাম। কষ্ট-অশান্তি, হাসি-কান্না, ভালোবাসা-ভালোলাগার আরেক বিচিত্র জগত। বিচিত্র অভিজ্ঞতা।

আচ্ছা, মানবমনের এই যে অসীম দুঃখ, হতাশা, অতৃপ্তি; এর কি কোনোই মূল্য নেই? এ থেকে কি আবিষ্কৃত হতে পারে না মহামূল্যবান কিছু? যা ব্যবহার করে ঠিক বিপরীত দিকে চালিত করা যায় মন ও জীবনকে? দুঃখ কি ব্যবহার করা যায়? কীভাবে? কী লাগে দুঃখকে ব্যবহার করতে? ধন-সম্পদ, যশ-খ্যাতি? নাকি জ্ঞান, চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি?

আজ প্রতিমুহূর্তে কত-শত মানুষ হা-হুতাশ করছে, আত্মহত্যা করছে। অথচ আমরা ভাবতে পারছি না সেই মায়ের গর্ভে থাকতেই আমরা ভ্রুণ হত্যার শিকার হইনি। ভ্রুণপরবর্তী সময়টিও আমরা উপভোগ করার সৌভাগ্য লাভ করেছি। এরপর আজ পর্যন্ত বেঁচে থাকার এক পরমতম সৌভাগ্য লাভ করেছি। সুতরাং কেন এত হা-হুতাশ, অতৃপ্তি? কেন নিজেকে নিজে শেষ করে দেওয়ার তীব্র বাসনা? অন্যকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা? বরং প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের উপভোগ করা উচিত। এই বিশাল আকাশ, বিস্তৃত জমিন, অসংখ্য ঘাসপাতা-তৃণলতা; আমার কীসের অভাব?

‘মানুষ’ হিসেবে ‘অনুমোদন’ বা স্বীকৃতি লাভের প্রথম দিনের মতো অভাব কি আজ আমার আছে? তখন তো হাত-পা-চোখ-মুখ-নাক কিছুই ছিল না। মায়ের পেটের চেয়ে এই মহাবিশ্ব কতগুণ বড়? এতে বসবাস ও বিচরণের অধিকার আমি পেয়েছি। সম্পদ, যশখ্যাতি, প্রতিপত্তি, ক্ষমতা আমাদের যাদের কপালে জোটেনি, বাহ্যিকভাবে এর একটা কষ্ট আছে (অন্যদিকে এর একটা উপকারিতাও অনস্বীকার্য)। মানসিকভাবেও কি সে কষ্ট ভোগ করব? তাহলে তো দ্বিগুণ ক্ষতি। অন্তত মানসিক কষ্ট থেকে বাঁচবার কোনো পথ আছে কি না তা খুঁজে দেখার কোনোই প্রয়োজন নেই? তাছাড়া, যাদের ওসব আছে তারা কি আমাদের চেয়ে খুব একটা ভালো? সুখী? কখনোই না। যতই লুকোচুরি করি না কেন, প্রভাব, খ্যাতি, যোগ্যতা, অর্থ, ডিগ্রির প্রলেপ দেই না কেন, মূলত মনের ভেতরের এক কোণে দুঃখ-কষ্ট, অশান্তি-অভিমান, হতাশা-একাকিত্ব লুকিয়ে আছে ছাইচাপা আগুনের মতো। অনুকূল পরিবেশ ও অনুকূল সময় পেলেই দাউ দাউ করে যা জ্বলে উঠে। সহসা বিস্ফোরিত হয় অগ্নিবোমা।

আজ, এই মুহূর্তে, যখন আমি বা আপনি এই লেখাটা লিখছি বা পড়ছি, এ পৃথিবীর অনেক তরুণ, ধনীর দুলাল, নববিবাহিতা স্ত্রী মৃত্যুশয্যায় শায়িত। হ্যাঁ, এই কয়েক মুহূর্তে অনেকে চলেও গিয়েছেন। তাদের চেয়ে বেশি দুঃখী অন্তত এই মুহূর্তে আপনি বা আমি নই। তাহলে আমরা কি সুখী নই?

আচ্ছা, মানবমনের এই যে অসীম দুঃখ, হতাশা, অতৃপ্তি; এর কি কোনোই মূল্য নেই? এ থেকে কি আবিষ্কৃত হতে পারে না মহামূল্যবান কিছু? যা ব্যবহার করে ঠিক বিপরীত দিকে চালিত করা যায় মন ও জীবনকে? দুঃখ কি ব্যবহার করা যায়? কীভাবে? কী লাগে দুঃখকে ব্যবহার করতে? ধন-সম্পদ, যশ-খ্যাতি? নাকি জ্ঞান, চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি? কেউ কিছু জানেন? যদি দুঃখকে চিন্তা ও জ্ঞানের মাধ্যমে মানবমনের সুপ্ত শক্তি ও সম্পদের ভাণ্ডার উন্মুক্তকরণে ব্যবহার করা যায় তাহলে দুঃখই হোক আমাদের বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন। অথবা অন্ততপক্ষে মাল-মসলা।

জাকির মাহদিন : সাংবাদিক, কলামিস্ট

zakirmahdin@yahoo.com

ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম,  সম্পাদকের কলাম

ট্যাগ:

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply