শুক্রবার রাত ১২:৩০, ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ. ২৮শে মার্চ, ২০২৪ ইং

রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তোলাই কেন্দ্রীয় কাজ -সাক্ষাৎকার

আবুল কাসেম ফজলুল হক

শহবাগ সংলগ্ন পরিবাগের বাসায় সাক্ষাৎকার গ্রহণ

অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক। একজন নম্রভদ্র রুচিশীল ব্যক্তিত্ব। রাষ্ট্রচিন্তাবিদ। গত পঞ্চাশ বছরের লেখালেখিতে অন্তত নিজের জন্য চিন্তার একটি স্বাধীন জায়গা আবিষ্কার করেছেন, যা থেকে তিনি একচুলও নড়তে প্রস্তুত নন; যতক্ষণ না সঠিকভাবে কেউ চ্যালেঞ্জ কিংবা সমালোচনা করেন। সেই চ্যালেঞ্জ বা সমালোচনা যদি পাল্টা সমালোচনার ধোপে টেকে, তবে তিনি যেমন শক্ত তেমনই নরম। অত্যন্ত স্বাধীন ও দৃঢ়চেতা এই মনীষী জাতির প্রতি এক প্রবল দরদ অনুভব করেন। বুকে লালন করেন এক সীমাহীন আশা- একদিন এই জাতি ঠিকই আবার মাথা তুলে দাঁড়াবে, সেই একাত্তরের মতো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেশ দর্শন সম্পাদক জাকির মাহদিন

জাকির মাহদিন : আপনার সাম্প্রতিক লেখাগুলোয় ‘শান্তি ও সমঝোতার’ বাণী প্রবলভাবে উপস্থিত। কিন্তু শান্তি ও সমঝোতার শর্ত হিসেবে যে ধরনের কৌশলগত ও তাত্ত্বিক এবং জাতীয় ঐক্যের স্পৃহা সৃষ্টিকারী বক্তব্য প্রয়োজন, তেমন কোনো বক্তব্য নেই কেন? অথবা অন্যভাবে বলতে গেলে, জাতিকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঐক্যবদ্ধ করার মতো প্রেরণদায়ি লেখা এবং জাতি এ মুহূর্তে যে একজন ‘প্রবীণ হিরো’ চায়- আপনার বক্তব্য ও লেখনীতে সেসব উপাদান নেই কেন?

আবুল কাসেম ফজলুল হক : জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তোলাটাই এখন আমাদের কেন্দ্রীয় কাজ। কিন্তু প্রকৃত দল, সংগঠন এবং নেতার অভাবে সেটা হচ্ছে না। লেখকদের মধ্যে লেখকসুলভ বৈশিষ্ট্য একেবারেই কমে গেছে। তাদের মধ্যে ইন্টেলেকচুয়াল ক্যারেক্টার (বৌদ্ধিক চরিত্র) একেবারেই নেই। পাকিস্তান আমলে যেমন ছিল, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রথম আট-দশ বছরও যেমন ছিল, এখন সেটা নেই। আমাদের দেশে এখন লেখক-বুদ্ধিজীবী বলে যারা পরিচিত তারা বিভিন্ন সিভিল সোসাইটির মেম্বার হয়ে গেছে। বৈদেশিক টাকায় যেসব সংস্থা-সংগঠন চলে যেমন ইলেকশন ওয়াচ, ডেমোক্র্যাসি ওয়াচ ইত্যাদি। এসবই সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন। এগুলোর যারা সদস্য ও কর্তাব্যক্তি তাদের বোধ-বুদ্ধি চিন্তাভাবনা সংগঠন ও বাইরের দ্বারা নির্ধারিত, নিয়ন্ত্রিত। তাই এদের কথাবার্তা ও কাজ সময়ের দাবির সঙ্গে খাপ খায় না।

সময়ের দাবি- গণতন্ত্রকে সফল করা। গণতন্ত্র কী, গণতন্ত্র কী নয়, গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা কীভাবে সম্ভব, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য রাজনৈতিক দলের গুরুত্ব কতটুকু এসব নিয়ে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে আলোচনা করা। এ জাতীয় আলোচনা আজ নেই। আমার একটা বই আছে- ‘গণতন্ত্র ও নয়া গণতন্ত্র’ নামে। কিন্তু এদিকে আমি বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষিত সমাজের কোনো আগ্রহ লক্ষ্য করি না। তাছাড়া কেউ কেউ একা-একলা যৎসামান্য যাই চিন্তা করে, সেসব বই-পুস্তকেই সীমাবদ্ধ।

একটা বিস্তৃত পাঠ আন্দোলন দরকার। এসবে এখন আগ্রহ নষ্ট হয়ে গেছে। ফেসবুক-অনলাইনে তরুণরা এবং অনেক প্রবীণরাও চলে গেছেন। ওসবে খুব ছোট পরিসরে কিছু ভালো চিন্তার বিকাশ ঘটলেও আসলে স্ক্রিনে পড়া, বিশেষ করে ‘চিন্তা’র কাজটা হয় না। ফেসবুকটা মূলত কৌতুকবোধ ও যোগাযোগের জন্য। কিন্তু একটা জাতি গঠন, সমাজ গঠন ও রাষ্ট্র গঠনের জন্য পাঠ ও চিন্তার কাজটা বিস্তৃত পরিসরে নেয়া অপরিহার্য। প্রতিবছর প্রায় দশ হাজার বই বের হয়। এর মধ্যে অন্তত দশটা বই নিয়ে যে বিস্তৃত পরিসরে আলোচনা প্রয়োজন তা অনুপস্থিত। গত ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছরে আমাদের চিন্তাশক্তি প্রায় পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে।

আমি শুরু থেকেই ‘শান্তি’ ও ‘শান্তিপূর্ণ উপায়ের’ কথা বলে আসছি। বিশেষ করে গত দুতিন বছর ধরে আরো জোর দিয়ে বলছি এ কারণে যে সংঘাত-সংঘর্ষ, পক্ষ-প্রতিপক্ষ, হিংসা-প্রতিহিংসা, অসহিষ্ণুতা এখন এতটাই বেড়ে গেছে, ওসব বললেই প্রবল শক্তিধর কায়েমি স্বার্থবাদীরা ঝাঁপিয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় একটু পেছনে গিয়ে শান্তি ও শান্তিপূর্ণ উপায়ের কথা বলা, জ্ঞানীগণের সঙ্গে আলোচনায় বসা খুবই জরুরি। আমি এগারো বছর ধরে ‘আটাশ দফা’ নামে একটা পুস্তিকা সংক্ষিপ্ত সংবিধান আকারে সংশোধন করে করে প্রচার করছি। আমি এর পর্যালোচনা ও সমালোচনা চাই।

আমি মনে করি, যদি কোনো দল বা নেতা স্বাধীনতা পরবর্তী এই সময়ে আমার ‘আটাশ দফা’ গ্রহণ বা প্রচার করতেন, তাহলে বুঝতেন এর মধ্যে কী বিরাট কল্যাণ নিহিত আছে। আমার যতটুকু সাধ্য আছে আমি চেষ্টা করছি। আমার বিশ্বাস, আটাশ দফা একটা বিশেষ কিছু। বর্তমানে এর একটা অতি সংক্ষিপ্ত রূপ বাজারে আছে। মাত্র কয়েক পাতা। আমি বিশ্বাস করি, গত পঞ্চাশ বছর ধরে আমি যা লিখছি, জাতি একদিন জাগ্রত হলে সেগুলো মূল্যায়ণ করবে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বেগম সুফিয়া কামাল, রোকেয়া সাখাওয়াত এবং অন্যান্য খ্যাতিমান লেখকগণও এসবই বলে গেছেন। তাদের নিয়ে আমাদের প্রচুর পড়াশুনা ও গবেষণা করতে হবে।

বৈদেশিক টাকায় যেসব সংস্থা-সংগঠন চলে- যেমন ইলেকশন ওয়াচ, ডেমোক্র্যাসি ওয়াচ ইত্যাদি। এসবই সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন। এগুলোর যারা সদস্য ও কর্তাব্যক্তি তাদের বোধ-বুদ্ধি চিন্তাভাবনা সংগঠন ও বাইরের দ্বারা নির্ধারিত, নিয়ন্ত্রিত। তাই এদের কথাবার্তা ও কাজ সময়ের দাবির সঙ্গে খাপ খায় না।

জাকির মাহদিন : আপনি যাদের নাম বললেন, তাদের সবাইকে জানা, পড়া ও গবেষণা করা কি আমাদের দেশের লাখ লাখ মানুষের পক্ষে সম্ভব? তাছাড়া এক কাজী নজরুল বা এক রবীন্দ্র রচনাবলীই তো পড়তে একজন মানুষের অর্ধেক জীবন চলে যাবে। আবার আপনার উল্লেখিত সেসব লেখকদের মধ্যে তো প্রচুর বিপরীতমুখিতা ও সাংঘর্ষিকতা বর্তমান। তাহলে সবাইকে মেনে কীভাবে সম্ভব? যদি বলেন তাদের শুধু মিল ও ভালগুলো গ্রহণ করার, তাহলে সেগুলো একত্রিত করে কংক্রিট বিষয়টা আপনি বলে ফেললেই তো হয়?

আবুল কাসেম ফজলুল হক : সব লেখকের সব লেখা না পড়ে অনেক লেখকের মাত্র পাঁচ পৃষ্ঠা করে পড়লেও চলে। এরপর যার যাকে ভালো লাগে, তা নিয়েই অগ্রসর হওয়া সম্ভব। এ লেখকগণের প্রত্যেকেরই কিছু বিশেষ গুণ-বৈশিষ্ট আছে। কারও লেখা যদি কঠিন লাগে তবে তার লেখা একটু বেশি পড়লেই সহজ হয়ে যায়। আর সেসব লেখকের যে মতভিন্নতা, আজ কিন্তু আমরা সে মতভিন্নতাগুলোও ঠিকমতো ধরতে পারছি না। ধরতে পারলে দেখব মনুষ্যত্ব ও মানবতার জায়গায়, প্রেম-ভালোবাসায় তারা সবাই এক। পৃথিবীর প্রধান ধর্মগুলোও সেখানে এক ও অভিন্ন। ধর্মের উদ্দেশ্য সর্বজনীন মানবকল্যাণ, দুঃখিত, বঞ্চিত, নিপীড়িতদের পাশে দাঁড়ানো। এসব ধর্মের উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাস একই।

জাকির মাহদিন : সর্বধর্মের পক্ষে এমন গোঁজামিল বক্তব্য দিলে কি জাতির সমস্যার সমাধান হবে?

আবুল কাসেম ফজলুল হক : না, এটা কোনো গোঁজামিল বক্তব্য না। ইসলাম ধর্ম প্রবর্তনের সময় হজরত মুহাম্মদ সা. কী করেছেন? তৎকালীন যতগুলো ধর্ম ছিল, সেসবের প্রধান প্রধান ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার সনদ তৈরি করেছেন। এবং বিদায় হজের ভাষণে মুসলমানদের উদ্দেশে নিজের ধর্মের ভেতরের ও বাইরের যে ঐক্য ও সাম্যের কথা নবি করিম সা. বলেছেন আমি সেসবের দিকেই ইঙ্গিত করছি।

আবুল কাসেম ফজলুল হক ও জাকির মাহদিন

জাকির মাহদিন : আপনি যদি ধর্মের পক্ষে, ইসলামের পক্ষে বলেন তাহলে কিন্তু এর বিপক্ষে অর্থাৎ জিহাদ, পর্দা, বিয়ে প্রভৃতির বিপক্ষে যেসব বৈশ্বিক প্রশ্ন আছে সেসবের যথাযথ উত্তর আপনাকে দিতে হবে।

আবুল কাসেম ফজলুল হক : অবশ্যই। সেগুলোই আলোচনা করতে চাই। গত পঁয়ত্রিশ বছর ধরে যে উগ্র এবং তথাকথিত নারীবাদী আন্দোলন চলছে তা আজ খুবই তীব্র। অথচ তারা ‘নারী-পুরষ সম্পর্ক’ বিষয়ে আলোচনা করতে মোটেই আগ্রহী নয়। এ উগ্রতায় যারা গা ভাসাচ্ছেন তারা নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলছেন। ক্ষমতায়ন মানে কী? বড় বড় পদ নেওয়া, অন্যের ওপর কর্তৃত্ব, প্রভুত্ব ও নির্যাতন করার সক্ষমতা? এসব ইসলাম সমর্থন করে না। কিন্তু গণতন্ত্রও কি সমর্থন করে? গণতন্ত্রে যদি আমরা লক্ষ্য করি তাহলে দেখি, যারা গণতন্ত্রের দার্শনিক, প্রবক্তা, আমেরিকায় জেফারসন, লিঙ্কন, ব্রিটেনে স্টুয়ার্ট মিল- এদের গণতন্ত্র কি এ রকম?

বার্ট্রান্ড রাসেল, অগাস্ট কোঁতে, তারা কি গণতন্ত্রকে এভাবে দেখেছেন? আরো অনেকের কথাই বলা যায়। বার্ট্রান্ড রাসেল অনেক উদার ছিলেন। তিনি নর-নারী সম্পর্ক, বিয়ে ও পরিবার ইত্যাদি নিয়ে অত্যন্ত খোলামেলা আলোচনা করেছেন। কিন্তু তিনিও মনুষ্যত্ব ও মানসিক বিকাশের গুরুত্ব এবং মানুষ ও প্রাণীর বিশেষ পার্থক্যের জায়গাগুলো স্বীকার ও মূল্যায়ণ করেছেন। তিনি আজকের আন্দোলনকারীদের মতো ছিলেন না। এখন যদি আপনি ইসলামের কথা বলেন তাহলে আজকের পরিবর্তিত যে বাস্তবতা তার সঙ্গে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি ও নীতিগুলো কী হওয়া উচিত, কেমন হওয়া উচিত সেসব অগ্রসর করতে হবে। যেটা বার্ট্রান্ড রাসেল এবং আরো অনেকেই করেছেন। এমন কিছু আজ কোনো আলেম বা ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির কাছ থেকে আসছে না। আমি এসব নারীবাদী আন্দোলন, ব্রিটিশষড়যন্ত্রমূলক তথাকথিত মৌলবাদবিরোধী আন্দোলন, এসব একেবারেই সমর্থন করি না। আমি একজন মানববাদী।

জাকির মাহদিন : আপনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা বলেছিলেন। তো তিনি কিন্তু বাঙালি জাতিসত্তায় বিশ্বাস করতেন না। দ্বিতীয়ত, তিনি প্রেম, গান, কতিা, গল্প ইত্যাদি লিখেছেন সেসবের বিকশিত রূপই তো আজকের তিক্ত বাস্তবতা। লাখ লাখ তরুণ-তরুণী রবীন্দ্র-নজরুলে বুঁদ।

আবুল কাসেম ফজলুল হক : অবশ্যই না। রবীন্দ্রনাথ যে প্রেম-গান-কবিতা লিখেছেন তাতে মনুষ্যত্ব ও মানবতাবোধই প্রকট। তবে একজন দার্শনিক, সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী যেভাবে মানুষ ও মনুষ্যত্বের গভীর বিশ্লেষণ করেন কবি সেভাবে করেন না। কবি আবেগকেই প্রাধান্য দেন। মূলত সমাজবিপ্লব, জাতি ও রাষ্ট্রগঠনের জন্য দার্শনিক-সমাজবিজ্ঞানী-মনোবিজ্ঞানীগণই কংক্রিট নীতি তৈরি করতে পারেন। কবি তা পারেন না। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মূলত কবি।

জাকির মাহদিন : মানববাদ, মানবতাবাদ মানবাধিকার কর্মী- এসবে কোনো পার্থক্য আছে?

আবুল কাসেম ফজলুল হক : বিশাল পার্থক্য। মানবাধিকার কর্মীরা বিদেশি টাকায় পালিত ও পরিচালিত। আর মানববাদ একটা দর্শন। আইনস্টাইন, রাসেল, তারা মানববাদী। তাদের চিন্তা ও দর্শনে কিছু পার্থক্য থাকলেও মৌলিক পার্থক্য নেই।

জাকির মাহদিন : আপনি যাদের নাম বলছেন, তাদের কংক্রিট নীতিটাই আমরা আপনাদের কাছ থেকে চাই।

আবুল কাসেম ফজলুল হক : এই কংক্রিট নীতিগুলো আসলে আমাদের বের করতে হবে। পাঁচ-দশজন চিন্তাশীল বুদ্দিজীবী এসব নিয়ে একসঙ্গে বসতে হবে। আমি যে ‘আটাশ দফা’ দিয়েছি তা নিয়ে কারো কোনো আগ্রহ লক্ষ্য করছি না। অথচ পাকিস্তান আমলে এটা লেখা হলে আমার বিশ্বাস, আলোড়ন সৃষ্টি হতো। আমি বলছি না যে আটাশ দফা যেভাবে আছে সেভাবেই থাকবে। কিন্তু অন্তত দুচার জনের বসতে তো হবে। বসলে, আলোচনা করলে এর থেকেই আমাদের প্রয়োজনীয় এবং নতুন কিছু বের হবে। আমি একা, আমি এ পথে কাউকে পাচ্ছি না। একা একা আর করা যায়, কতটুকুইবা লেখা যায়? আজকাল পত্রিকাগুলোও আমাদের লেখা ছাপতে চাইছে না এবং গুরুত্ব দিচ্ছে না। আমি একজন মানববাদী ও গণতন্ত্রী হিসেবে এটা লিখেছি। এর সঙ্গে ধর্মীয় বিষয়ও যোগ করা যাবে।

গত পয়ত্রিশ বছর ধরে যে উগ্র এবং তথাকথিত নারীবাদী আন্দোলন চলছে তা আজ খুবই তীব্র। অথচ তারা ‘নারী-পুরষ সম্পর্ক’ বিষয়ে আলোচনা করতে মোটেই আগ্রহী নয়। এ উগ্রতায় যারা গা ভাসাচ্ছেন তারা নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলছেন। ক্ষমতায়ন মানে কী? বড় বড় পদ নেওয়া, অন্যের ওপর কর্তৃত্ব, প্রভুত্ব ও নির্যাতন করার সক্ষমতা? এসব ইসলাম সমর্থন করে না। কিন্তু গণতন্ত্রও কি এসব সমর্থন করে?

জাকির মাহদিন : আপনার আটাশ দফা আমরা অনেকবার পড়েছি, এর সঙ্গে আমরা একমত না। অনেক অনেক প্রশ্ন আছে এবং এটা স্রেফ কল্পনাবিলাস।

আবুল কাসেম ফজলুল হক : হ্যাঁ, সেই প্রশ্নগুলোই তো প্রয়োজন। এ প্রশ্নগুলো যদি কেউ লিখে প্রকাশ করে এবং এটা যদি ইন্টারেকশন অর্থাৎ মত এবং ভিন্নমতে যায় তবে এক সময় কেউ একজন সকলের কাছে গৃহীত বক্তব্য দিতে পারবে। দীর্ঘদিন ধরে আমাদের জাতিকে বিভক্ত করে রাখা হয়েছে। জাতিসত্তা নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। ছয় দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে আন্দোলন দানা বেঁধেছিল, আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল তা আবার ১৯৭২ সালেই লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছে। এরপর একে একে বিভক্তি বাড়ছে।

জাকির মাহদিন : আপনি বলেছেন, গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্র মানলে, ধর্মনিরক্ষতার কোনোই প্রয়োজন নেই।

আবুল কাসেম ফজলুল হক বার্ট্রান্ড রাসেল, অগাস্ট কোঁত, জেফারসন, লিঙ্কনও তাই মনে করতেন। তারা তাদের চিন্তা ও দর্শনে ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ যোগ করেননি। করলে তারাও একই বিপদে পড়তেন। এমনকি আমি নিশ্চিত, ব্রিটিশ-আমেরিকার সংবিধানেও এ শব্দটি থাকলে তারা সমস্যায় পড়তেন। ধর্মনিরপেক্ষতা গোড়া থেকেই বিতর্কিত। এটা সংবিধানে রাখাও উচিত না। যদিও আমি সংবিধান মানি এবং মানি বলেই সংবিধান আমাকে যে অধিকার দিয়েছে তার আলোকে বলছি। গণতন্ত্রে আন্তরিক হলে ধর্মনিরপেক্ষতা অর্থহীন এবং সমস্যাপূর্ণ।

জাকির মাহদিন : প্রচলিত সংবিধান পুরোপুরি মেনে সংবিধানের মূল সমস্যা ত্রুটিগুলো কি দূর করা সম্ভব?

আবুল কাসেম ফজলুল হক : আমি আটাশ দফায় নতুন সংবিধান রচনার কথা বলেছি। নতুন সংবিধান রচনার উপায়ও বলেছি। গতানুগতিক ধারায় এ সংবিধানের সংশোধন হবে না।

জাকির মাহদিন : রবীন্দ্রনাথ এবং হুমায়ুন আহমেদের ভক্ত-অনুসারী প্রচুর। শিক্ষিত সমাজের অনেকেই। তো যদি এদের লেখা ও দর্শনে গঠনমূলক কিছু থাকতো তাহলে নিশ্চয় এসব অসংখ্য শিক্ষিত ছেলেমেয়ে গোল্লায় যেত না।

আবুল কাসেম ফজলুল হক রবীন্দ্রনাথ-হুমায়ুন আহমেদকে ব্যবসায়িকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাদের পেছনে ইনভেস্ট করা হচ্ছে। তাই ওসব ছেলেমেয়ের কর্মকাণ্ডে তারা দায়ি না। অবশ্য রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে হুমায়ুনের তুলনা চলে না, যদিও হুমায়ুন আহমেদ এ দেশে একজন জনপ্রিয় লেখক। রবীন্দ্রনাথের লেখায় ভালো-মন্দের পরিচয়, বোধ এবং ফলাফল অনেকটাই স্পষ্ট, কিন্তু হুমায়ুনের এ জায়গাটা বড় ঘোলাটে। সব মিলিয়ে হুমায়ুন আহমেদের লেখা আমার দৃষ্টিতে কোনো মূল্যবোধের পরিচয় দেয় না। রবীন্দ্রনাথ আন্তরিকতার সঙ্গেই মূল্যবোধ, মানববাদ, সর্বজনীন কল্যাণ চেয়েছেন।

জাকির মাহদিন : যদি অনুসারীদের কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতে অনুসরণীয়দের দায়ী করা না যায়, তাহলে আপনারা মুসলমানদের কর্মকাণ্ড দিয়ে ইসলাম ও নবিকে আক্রমণ করছেন কেন?

আবুল কাসেম ফজলুল হক আমি করছি না এবং যারা করছে তাদের আমি প্রচণ্ড বিরোধী। যারা নামাজ-রোজা করে না কিন্তু মুসলমান তারাও ওদের আক্রমণে ক্ষুব্ধ এবং আঘাতপ্রাপ্ত হয়, হওয়া স্বাভাবিক।

জাকির মাহদিন : ‘স্বদেশ চিন্তা’ সংঘের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ড. আহমদ শরীফ। এরপর হাল ধরলেন আপনি। দীর্ঘ তের বছরে এর মাধ্যমে বাঙালি জাতির মুক্তির পথ কতটুকু দেখাতে পারলেন?

আবুল কাসেম ফজলুল হক স্বদেশ চিন্তা প্রথম অবস্থায় ভালোই ছিল। কিন্তু পরে তিনি সাধারণ মানুষের ধর্মবোধকে ক্রমাগত আঘাত করেছেন। আমি তাকে এ বিষয়ে ব্যক্তিগতভাবে বোঝাতে অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু তিনি বিভিন্ন সভা-সমাবেশে তার মতেই কথা বলে গেছেন। ড. আহমদ শরীফের সঙ্গে আমার মতপার্থক্যের জায়গাটা বিশাল। ধর্ম নিয়ে বিরোধে আমি অনুৎসাহী। আমি ‘কালের যাত্রার ধ্বনি’ বইতে ধর্মের কিছু কথা বলেছি। কিন্তু তা নিয়ে কারো ক্ষুব্ধ বা অসন্তুষ্ট হওয়ার কিছু নেই। বিশেষ করে তিনি জীবনের শেষ দশ বছর যে মৌলবাদবিরোধী আন্দোলনের ষড়যন্ত্রে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন, এর সঙ্গে আমি শক্ত দ্বিমত পোষণ করি। এমন আরো অনেক বুদ্ধিজীবীই এ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন।

উল্লেখ্য: সাক্ষাৎকারটি ২০১৬ সালে গ্রহণ করা হয়েছিল

ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম,  সাক্ষাৎকার

ট্যাগ: জাকির মাহদিন

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply