শুক্রবার রাত ৮:০৪, ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ. ২৯শে মার্চ, ২০২৪ ইং

স্মরণিকা: সম্পাদনা, লেখা সেট-আপ ও ইতিহাস

৭৫১ বার পড়া হয়েছে
মন্তব্য ০ টি

প্রথম পর্ব:

একটি সার্থক স্মরণিকা বা স্মারকগ্রন্থের প্যাটার্ন বা ধরন কেমন হয়? আর তার অভ্যন্তরে বা কী লিখতে হয়?

সদ্য সম্পাদনার দায়িত্ব পাওয়া যে কারোর কাছেই এগুলো মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছকবাঁধা পড়াশুনার মধ্যে ব্যাপক কিছু থাকলেও স্মরণিকার ধরন ও এতে লেখা সেট-আপের পদ্ধতি কিছুটা আলাদা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। গুগলে সার্চ দিয়ে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য না পেয়ে আমি মর্মাহত হয়েছি।আর এতদ বিষয়ে একটি ধারণা প্রদানের প্রয়োজনীতা থেকেই আজকের এই লেখাটি নিবেদন করলাম। আমার ভাবনা ও লব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে লিখছি। আপনি আমার সাথে একমত হবেন এমনটিও নয়।লেখাটি যেন কারো কারোর উপকারে আসে এমনটিই যেন হয়।

বিশেষ্য পদ স্মরণ [সং. √ স্মৃ + অন] থেকে স্মরণিকা শব্দের উদ্ভব।স্মরণ মানে স্মৃতি। মনে মনে পূর্বানুভূত বিষয়য়ের পুনরাবৃত্তি; ধ্যান বা চিন্তা।

স্মরণিকা হচ্ছে এমন একটি প্রকাশনা যা নির্দিষ্ট জায়গা,সৌধ, প্রতিষ্ঠান,উপলক্ষ বা ব্যক্তিকে স্মরণ করে মুদ্রিত হয়।
ইংরেজী souvenir শব্দের অর্থের সাথে এর চমৎকার মিল রয়েছে। souvenir মানে হলো স্মরণিক, স্মারকগ্রন্থ, স্মারক বা অভিজ্ঞান।

➤কেমন করে স্মরণিকা প্রকাশের রীতি চালু হলো?
ইদানীং প্রায়ই শহর-বন্দর-গ্রামের বিভিন্ন জনপদে কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা ঘটনা বা কোনো কিছু প্রতিষ্ঠার সময়কালের সূত্র ধরে জয়ন্তী বা জুবিলীর কথা শোনা যায়। এ প্রেক্ষাপটে যদি গোড়াতে যাই, দেখি এর আদি সূতিকাগার হলো রোমান সভ্যতার সময়কালভিত্তিক সূত্রপাত বা জন্মোৎসব। উৎসবমুখর পরিবেশে জন্মতিথি পালন করাকে বাংলায় বলা হয় ‘জয়ন্তী’।
ইংরেজি Jubilee শব্দটি এসেছে ফ্রান্স শব্দ Jubile-এর অপভ্রংশ থেকে। অবশ্য এর আদি ল্যাটিন শব্দ হলো ‘Jubilaeus’ মূলত কোনো ঘটনা বা ব্যক্তির যথাক্রমে সূত্রপাত ও জন্মকে ঘিরে সুনির্দিষ্ট সময়কাল পূরণ হওয়ার উপলক্ষ্য করে সম্মান প্রদর্শনপূর্বক স্মৃতিচারণের আবর্তে আনন্দঘন অনুষ্ঠান।
ইহুদিরা ৫০ বছরকাল পূরণ হলে উৎসব পালন করত এবং এটাকে ভিত্তি করে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান এবং ক্রীতদাসদের মুক্তিদান, দেনা মাফ প্রভৃতি পুণ্যকর্ম সম্পাদন করত। তৎপর দ্বিতীয় পর্যায়ে যেটা দেখা যায়, তা হলো, ২৫ বছরকাল পূরণের প্রাক্কালে রোমান ক্যাথলিকদের আনুষ্ঠানিক উৎসব বিশেষ। সময় ও ঘটনার পরিক্রমায় এ দুটির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে ‘ষাট বছর কাল পূরণ’ ভিত্তি করে আনুষ্ঠানিক উৎসব পালনের উদ্ভব হয়ে উঠে আসে আর একটি জয়ন্তী। আধুনিকতার ছোঁয়ায় ‘শত বছর কালকেও’ এর মধ্যে টেনে আনা হয়। এসব জয়ন্তী শুধু পালন করাই হয় না, যুগপৎ এর নামকরণও করা হয়। আর এভাবেই প্রতিটি জুবিলী বা জয়ন্তীকে ঘিয়ে ধীরে ধীরে স্মারকগ্রন্থ বা স্মরণিকা প্রকাশের রীতিও চালু হয়।

১ বছর পূর্তিকে বলা হয় : প্রথম বর্ষ পূর্তি (One Year)
১২ বছর পূর্তিকে বলা হয় : যুগ পূর্তি
২৫ বছর পূর্তিকে বলা হয় : রজত জয়ন্তী (Silver Jubilee)
৫০ বছর পূর্তিকে বলা হয় : সুবর্ণ জয়ন্তী / স্বর্ণ জয়ন্তী (Golden Jubilee)
৬০ বছর পূর্তিকে বলা হয় : হীরক জয়ন্তী (Diamond Jubilee)
৭৫ বছর পূর্তিকে বলা হয় : প্লাটিনাম জয়ন্তী (Platinum Jubilee)
১০০ বছর পূর্তিকে বলা হয় : শতবর্ষ (Centenary jubilee)
১৫০ বছর পূর্তিকে বলা হয় : সার্ধশত (Sesquicentennial)
২০০ বছর পূর্তিকে বলা হয় : দ্বিশতবর্ষ (Bicentenary/ bicentennial)

➤প্রথমেই একটি স্মরণিকা কমিটি গঠন করতে হবে।যেখানে থাকবে
(ক) স্মরণিকা উপদেষ্টা মণ্ডলীর নামীয় তালিকা
(খ) আহবায়ক
(গ) যুগ্ম আহবায়ক
(ঘ) সম্পদনা পরিষদের সম্মানিত সদস্যদের নামীয় তালিকা (একাধিক)।
(ঙ) সদস্য সচিবের নাম।

➤স্মরণিকা কমিটিকে কী কী কাজ করতে হবে?
✪ স্মরণিকার জন্য একটি সুন্দর নাম বাছাই করতে হবে।
✪ একটি নান্দনিক প্রচ্ছদের পরিকল্পনা তৈরি করে তার দৃশ্যমান রূপ দিতে হবে।
✪ বাজেট ও পরিকল্পনা প্রণয়ন কমিটির কাছ থেকে স্মরণিকার জন্য বরাদ্ধকৃত বাজেট জেনে নিতে হবে।
✪ স্মরণিকাটি সাদা-কালো /চাররঙা/ কালারফুল তার কোনটি হবে তা নির্ধারণ করতে হবে।
✪ প্রিন্টিং এ কোন ধরনের এবং কোন সাইজের কাগজ ব্যবহৃত হবে তা নিশ্চিত করতে হবে।
✪ স্মরণিকাটিতে কোন ধরনের বিজ্ঞাপন থাকবে কীনা তা নিশ্চিত হতে হবে।
✪ সর্বোপরি স্মরণিকাটি কত ফর্মার হবে তা নির্ধারণ করতে হবে। [সাধারণত ১৬ পৃষ্ঠায় ১ ফর্মা। স্মরণিকার ক্ষেত্রে ৮ পৃষ্ঠা/৪পাতায় ১ ফর্মা হবে।]
✪ স্মরণিকায় মুদ্রণের জন্য প্রিন্ট/ অনলাইন/ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ায় লেখা আহবান করতে হবে।

➤একটি স্মরণিকাতে যে যে ক্যাটাগরির লেখা থাকতে পারে:
প্রযুক্তি
ইতিহাস
মুক্তিযুদ্ধ
ঐতিহ্য
আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী
সাহিত্য
রাজনৈতিক
বিজ্ঞান
চিকিৎসা
অর্থনীতি
সাম্প্রতিক বিষয়
গল্প
কবিতা-জীবনমুখী/ধর্মীয়/প্রকৃতির/প্রেমের/বিদ্রোহী/বিরহের/মানবতাবাদী/রূপক/বিবিধ।
কৌতুক
কৃষি
অনুবাদ গল্প
অনুবাদ কবিতা
গল্প নয় সত্যি
ক্যাম্পাস কার্নিশ
অধরা স্মৃতি

 

দ্বিতীয় পর্ব:

➤যদি কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জয়ন্তী কিংবা প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের পুনর্মিলনী উপলক্ষে স্মরণিকা প্রকাশিত হয় সেক্ষেত্রে একটি সার্থক স্মরণিকার সেট-আপ এমন হতে পারে।
১৫ ফর্মা/৬০পাতা/১২০ পৃষ্ঠার একটি স্মরণিকা সেট-আপ:
ফর্মা সংখ্যা বৃদ্ধি মানে ভিতরের কলেবর বৃদ্ধি, চাইলে বাড়ানো যায় আবার কমানোও যায়। তবে ১৮ ফর্মার অতিরিক্ত ম্যাগাজিন /স্মরণিকা চিন্তা করা ঠিক নয়; কারণ, তখন এর ওজন বেড়ে যায়,দেখতে ফোলানো ফাঁপানো ও কিছুটা দৃষ্টিকটু লাগে।
১। সম্পাদনা পরিষদের তালিকা,প্রচ্ছদ নির্মাতার নাম,পাবলিশার্স/প্রিন্টিং প্রেসের নাম ঠিকানা, কম্পোজার ও বাঁধাই ঘরের নাম পরিচয়, উৎসর্গ পত্র সব মিলিয়ে যাবে ৩ পাতা।
২। আহবায়কের কথা ও স্মরণিকা সম্পাদনা পরিষদের সদস্য সচিবের বক্তব্য সব মিলিয়ে যাবে ১ পাতা।
৩। প্রধান অতিথির বাণী এবং সর্বোচ্চ ১০ জন বিশেষ অতিথির শুভেচ্ছা বাণী সব মিলিয়ে যাবে ৫ পাতা।
৪। প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস ও পরিচিতি ১ পাতা।
৫। সম্মানিত উপদেষ্টামন্ডলির নামীয় তালিকা। আধা পৃষ্ঠা।
৬। সম্মানিত দাতা সদস্যদের নামীয় তালিকা। আধা পৃষ্ঠা
৭। আহ্বায়ক কমিটির নামীয় তালিকা। আধা পৃষ্ঠা।
৮। বিভিন্ন উপকমিটি সমূহের তালিকা। ২ পাতা।
৯। সেরা ১০ প্রাক্তন শিক্ষার্থীর (ছবি যুক্ত) সংক্ষিপ্ত পরিচিতি। আড়াই পাতা।
১০। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বর্তমান ও সাবেক প্রধান শিক্ষক / অধ্যক্ষ গণের নামীয় তালিকা ও কার্যকাল। ১ পাতা।
১১। বর্তমান ও সাবেক শিক্ষক /প্রভাষক বৃন্দের নামীয় তালিকা ও কার্যকাল। ২ পাতা।
১২। প্রতিষ্ঠানে সমাপনী শিক্ষাবর্ষ অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের (ছবিযুক্ত)নামীয় তালিকা। ১০ পাতা।
১৩। ইতিহাস ও ঐতিহ্য নির্ভর প্রবন্ধ ২টি। ২ পাতা।
১৫। মৌলিক গবেষণামূলক প্রবন্ধ ২টি। ২ পাতা।
১৬। রম্য রচনা ২টি। ২ পাতা।
১৭। ধর্মীয় প্রবন্ধ ৩টি। দেড় পাতা।
১৮। সামসময়িক প্রবন্ধ ২টি। ১ পাতা।
১৯। লোকজ সংস্কৃতি ও কৃষি বিষয়ক লেখা ৪টি। ৩ পাতা।
২০। স্মৃতিচারণ মূলক প্রবন্ধ ৬টি। ৬ পাতা
২১। কবিতা /ছড়া ২০টি। ৩ পাতা
২২ । মজাদার (এলাকা ভিত্তিক) রান্নার রেসিপি ১টি। ১ পৃষ্ঠা।
২৩। নৈতিক শিক্ষামূলক গল্প ১টি। ১ পাতা।
২৪। চিকিৎসা বিষয়ক প্রবন্ধ ১টি। ১ পাতা।
২৫। পেট ফাটানো হাসির কৌতুক ৪টি। ১ পাতা
২৬। বিজ্ঞাপন ২ পাতা।

বই বা স্মরণিকার মূল আকর্ষণই হচ্ছে প্রচ্ছদ এ কথা তো আমরা অনেকেই জানি। বই বা স্মরণিকা বের করতে হলে প্রচ্ছদের দিকে বিশেষ খেয়াল দেওয়া উচিত। এক্ষেত্রে প্রচ্ছদশিল্পী থেকে শুরু করে সব কাজেই প্রফেশনালদের ব্যবহার করতে হবে। মনে রাখা উচিত, প্রিন্টিং টেকনোলজি বেশ জটিল। গ্রাফিক্স ডিজাইনের মূল মন্ত্র প্রিন্ট আউটপুট / সিটিপি সেটিং।অন্যান্য কাজের আউটপুট সেটিং থেকে ম্যাগাজিন ও বইয়ের সেটিং টা একটু ভিন্ন। ইলাস্ট্রেটরে ম্যাগাজিন ও বইয়ের প্লেট সেটিং জানা লোক বেশী একটা পাওয়া যাবেনা। প্রতিটি কাজেরই সাইজ একটি বড় ফ্যাক্ট। সুন্দর একটি স্মরণিকার সাইজ আর মার্জিনের পরিমাপ মাথায় রাখলে ডিজাইনটা ভাল হয়।
একটি বই বা স্মরণিকা প্রকাশ করতে হলে লেখা নির্বাচনের পর যথাক্রমে এই কাজগুলো করতে হয়।

✔ কম্পোজ
✔ প্রুফ রিডিং এবং সম্পাদনা
✔ অলঙ্করণ ও প্রচ্ছদ ডিজাইন
✔ মেকআপ
✔ পেস্টিং অথবা কম্পিউটারে ফর্মা সেটিং
✔ ট্রেসিং ও পজেটিভ
✔ প্রচ্ছদের পজেটিভ
✔ প্লেট তৈরি
✔ ইনার ও প্রচ্ছদের জন্য কাগজ
✔ ছাপা
✔ লেমিনেশন
✔ বাঁধাই।

জেনে রাখি- ৫.৫ ইঞ্চি বাই ৮.৫ ইঞ্চি সাইজের কাগজের ১৬ পেজে ১ ফর্মা। আর বড় সাইজের ৮.৫ ইঞ্চি বাই ১১ ইঞ্চি বই বা ম্যাগাজিনের পৃষ্ঠা হলে ৮ পেইজে ১ ফর্মা।
১৬ পৃষ্ঠায় ফর্মার বই করতে হলে ডাবল ডিমাই কাগজ এবং ৮ পৃষ্ঠার বইয়ে ডাবল ক্রাউন কাগজ ব্যবহার করা ভালো। আমাদের দেশের এবং বিদেশের প্রকাশকরা অবশ্য এর বাইরেও বিভিন্ন সাইজের বই বের করে।

 

 

Some text

ক্যাটাগরি: বিবিধ

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply

আমি প্রবাসী অ্যাপস দিয়ে ভ্যাকসিন…

লঞ্চে যৌন হয়রানি