বৃহস্পতিবার রাত ৯:১৪, ১৪ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ. ২৮শে মার্চ, ২০২৪ ইং

আলোর পথের সন্ধানে পর্ব-২

৪৪০ বার পড়া হয়েছে
মন্তব্য ০ টি

ধর্মকে ব্যবহার করে নিজের ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধার করার ইতিহাস পৃথিবীতে নতুন নয়। দেশে-দেশে, যুগে-যুগে, নানান ধর্মে এই শ্রেণীর লোক ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। কারণ মানুষ ধর্মভীরু, আর এক শ্রেনীর ভণ্ড, প্রতারক ও চতুর লোক মানুষের এই ধর্মভীরুতার সুযোগ নেবেই। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসব ভন্ডরা হারিয়েও যাবে।

ভারতের ধর্মীয় গুরু গুরুমিত রাম রহিম সিং এর ঘটনা আমরা জানি। তিনি “ডেরা সাচ্চা সৌদা” নামের একটি সম্প্রদায়ের নেতা ছিলেন। শিখ, হিন্দু, মুসলিম সব ধর্মের চেতনার মিশেলেই তৈরি হয়েছিলো তার এই ধর্মীয় সম্প্রদায়। ভারতের হরিয়ানা ও পাঞ্জাবে অন্তত ৫ লক্ষ সরাসরি ভক্ত আছে গুরমিত রাম রহিমের। তাদের দাবী, সারা বিশ্বে গুরু রাম রহিমের ছয় কোটি ভক্ত আছে। তাদের ভাষ্যঅনুযায়ী তিনি একাধারে ধর্মপ্রচারক, সমাজ সংস্কারক, গায়ক, সিনেমার নায়ক ও পরিচালক ছিলেন।

হরিয়ানা রাজ্যের সিরসায় ছিলো তার প্রকাণ্ড হাই-টেক আশ্রম। তাকে সব সময়ে ঘিরে থাকত সশস্ত্র ব্যক্তিগত রক্ষীর দল। চাক-চিক্যময় পোশাক-আষাক পরে গানের ভিডিওতে পারফর্ম করার জন্য তাকে অনেকে “রকস্টার বাবা” নামে অভিহিত করেছেন।এম.এস.জি-মেসেঞ্জার অব গড’ সিরিজের সিনেমাগুলোতে বাবা রাম রহিম নিজেই নায়ক গুরুজির অভিনয় করেছেন।

তার সুবিশাল আস্তানায় তিনি অত্যন্ত রাজকীয় জীবনযাপন করতেন। সেখানে তার বেশ কিছু গোপন আস্তানা ছিল। একটি আস্তানা আবিষ্কৃত হয়েছিল পানির নিচেও। সেসব আস্থানা পাহারা দিতেন সশস্ত্র রক্ষীরা। সেখানে প্রবেশ করতে লাগতো ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা পাসওয়ার্ড অর্থাৎ রাম রহিম সিং নিজে বা তার অনুমতি ছাড়া সেখানে আর কেউ প্রবেশ করতে পারত না। বিশ্বের সব মডেলের দামি গাড়ির কালেকশন ছিল তার কাছে। একটি মামলায় আদালতে হাজিরা দিতে এসেছিলেন ৬০০ গাড়িবহর নিয়ে। তার এত জনপ্রিয়তা ছিল যে ভারত সরকার তাকে বিশেষ “জেড প্লাস” নিরাপত্তা দিত।

অত্যন্ত প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় এই ধর্মগুরুর বাহির যতই জৌলুসময় তার ভিতরে দিক ততটাই কুৎসিত। হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনের, ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির অসংখ্য অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। এক সময়ের প্রভাবশালী এই মানুষটি বিরুদ্ধে কমপক্ষে দুই হাজার নারীকে ধর্ষণ ও তার নির্দেশে আশ্রমের ৪০০ সাধুকে নপুংসক করে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে।তার বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করায় সাংবাদিক সহ আশ্রমের সেবকদের হত্যার অভিযোগও আছে।

কিন্তু তার ভক্তরা এসব অভিযোগ মানতে চায়নি কখনো। ২০০২ সালে দুই নারী ভক্তকে ধর্ষণের অভিযোগে দীর্ঘ তদন্ত ও আইনী প্রক্রিয়া শেষে ২০১৭ সালে ভারতের একটি আদালত এই ধর্মীয় গুরু রাম রহিম সিংকে ২০ বছর কারাদণ্ডাদেশ দেন।

আদালতে দোষী সাভ্যস্ত হওয়ার পর তার অন্ধঅনুসারীরা সারা ভারত জুড়ে ভয়ানক তান্ডব চালিয়ে ছিলো। রায় ঘোষণার পর ভারতের পাঁচ রাজ্যে রাম রহিম সিং এর ভক্তদের সহিংসতায় ৪১ জন নিহত হন। একসময়ের প্রভাবশালী এই ধর্মীয় নেতা ২০ বছরের সাজা নিয়ে বর্তমানে কারাগারে বন্দী আছেন।

ভারতের এই ধর্ম গুরু রাম রহিম সিংয়ের কথা আজকে আলোচনার আনার উদ্দেশ্য এইযে, সকল ধর্মের সকল ভণ্ড ধর্ম গুরু আর তাদের অনুসারীদের ভিতরের আর বাহিরের চরিত্র মোটামুটি একই রকম।

 ভারতের মতো বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনেক ধর্মীয় গুরুর, আস্তানা, আশ্রম, মাজার বা দরবার শরীফ রয়েছে।তাদের লক্ষ লক্ষ ভক্ত অনুরাগী আছেন।সকলে যে ভন্ড তা নয়, তবে মাঝে মাঝে কিছু ধর্মগুরুর নানা অপকর্মের খবর বিভিন্ন মাধ্যমে পাওয়া যায়।

অতিত থেকে বর্তমান বাংলাদেশের একদল আলেম –ওলামা, পীর মাশায়েখ, মাজার-দরবার শরীফের খাদেমরা নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সত্যিকারের ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসারের জন্য এবং মানুষের মাঝে ইসলাম ধর্মীয় মূল্যবোধ ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য।

অপরদিকে অরেক দল ধর্মব্যবসায়ী, ভন্ড, প্রতারক ব্যক্তি নিজের বা দলীয় স্বার্থে ধর্ম ব্যবহারকারী তথাকথিত আলেম–ওলামা, পীর মাশায়েখ, মাজার-দরবার শরীফের খাদেমদের প্রচন্ড জনপ্রিয়তা ও প্রভাব লক্ষণীয়। যারা মুহূর্তের মধ্যেই বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থা কে পরিবর্তন করে দিতে পারে।

বাংলাদেশ বর্তমান সময়ে অনেক ধর্মীয় গুরু ও নেতা রয়েছেন যাদের অন্ধ অনুসারীরা কখনো বুঝতে পারবে না তাদের নেতা ধর্মকে আশ্রয় করে শুধুমাত্র ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করে চলছেন। বুজতে না পারার কারণ তাদের নেতাদের পরনে ধর্মীয় পোষাক আর মুখে ধর্মীয় বানী। সামনে থাকে ধর্মীগ্রন্থ। নিজেদের অজ্ঞতা আর রাজনৈতিক কারণতো আছেই।

এসকল ধর্মীয় গুরু, আলেম ও রাজনৈতিক নেতারা ধর্মকে ব্যবহার করতে চান বা করেন ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে। আর ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন দেশের অন্যান্য আলেম-ওলামা, মাদ্রাসার ছাত্র, আর ধর্মপ্রাণ মানুষদের। তারা কে বুজে কেউ না বুজে তাদের জড়িয়ে পরেন। তাদের সাথে আবার যুক্ত হয়েছে ক্ষমতাসীন দল বিরোধী অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরাও । তাদের জনপ্রিয়তা যতটা ধর্মের জন্য, ততটাই বিপক্ষ দলীয় মনোভাব বা মতাদর্শের জন্য।

এসকল ধর্মীয় নেতাদের প্রায় সকল বক্তব্যই ইসলাম ধর্মের মহান শান্তির বানীর পরিবর্তে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে ছড়িয়েছে হিংসা, বিদ্ধেষ, উগ্রতা, ভাংচুর, জ্বালাও পোড়াও, গালী গারাজ আর নোংরা আক্রমণ।

তারা ইসলামের আর্দশকে অমুসলিমদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। মুসলমানের সাথে মুসলমানের শত্রুতা বাড়িয়েছেন। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ক্ষমতাসীনদের রোষানলে ফেলেছেন। মসজিদ-মাদ্রাসাকে প্রশাসনের নজরদারীতে আনতে বাধ্য করেছেন। আলেম-ওলামাদের শ্রদ্ধার জায়গাটুকু নষ্ট করতে চেষ্টা করেছেন। ইসলামী রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীর মাঝে পবিত্র জেহাদের নামে জঙ্গী আদল দিতে চেয়েছেন। সর্বপরি বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত করার প্রায়াস চালিয়েছেন।

ধর্মীয় দিষ্টকোণ থেকে, রাজনৈতিক দৃষ্টিকোন থেকে এবং আইনের দিক থেকে তাদের এসব অপরাধ মোটেও নঘন্য নয়।  কিন্তু তাদের এসব বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে বলবে আমরা সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করছি।

এদের সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন-

আর যখন তাদেরকে বলা হয় যে, দুনিয়ার বুকে দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করো না, তখন তারা বলে, আমরা তো মীমাংসার পথ অবলম্বন করেছি। মনে রেখো, তারাই হাঙ্গামা সৃষ্টিকারী, কিন্তু তারা তা উপলব্ধি করে না। (সুরা বাক্বারা : আয়াত ১১-১২)

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ আরো ইরশাদ করেন, ‘ফেতনা (দাঙ্গা, বিশৃঙ্খলা ও গৃহযুদ্ধ) হত্যা অপেক্ষা গুরুতর পাপ।’ (সুরা বাকারা : ১৯১)।

‘পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে প্রয়াসী হইও না। নিশ্চয়ই আল্লাহ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীকে পছন্দ করেন না। (সূরা কাসাস, আয়াত ৭৭)।

এই প্রসঙ্গে তিনটি হাদিস উল্লেখ করা যায়—–

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমরের (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসকারী কোনো কাফেরকে (জিম্মিকে) হত্যা করবে, সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। অথচ জান্নাতের ঘ্রাণ চল্লিশ বছর দূরের পথ হতেও পাওয়া যাবে। (সহি বুখারি : ৩১৬৬)।

আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, প্রকৃত মুসলিম সেই, যার জিভ ও হাত থেকে সকল মুসলিম নিরাপদ থাকে। আর প্রকৃত মুহাজির (দ্বীনের খাতিরে স্বদেশ ত্যাগকারী) সেই, যে আল্লাহ যে সব কাজ করতে নিষেধ করেছেন, তা ত্যাগ করে।’’

[সহি বুখারি ১০, ৬৪৮৪, সহি মুসলিম ৪০, সহি নাসায়ি ৪৯৯৬, সহি আবু দাউদ ২৪৮১, সহি আহমদ ৬৪৫১, ৬৪৭৮, ৬৭১৪, ৬৭৫৩, ৬৭৬৭, ৬৭৭৪, ৬৭৯৬, দারেমি ২৭১৬]

অপর হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘মুসলমানকে গালি দেওয়া গুনাহর কাজ আর তাকে হত্যা করা কুফরী কাজের অন্তর্ভুক্ত (মুসলিম : ১১৬)।

পবিত্র কোরআনের এসব আয়াত ও হাদিসের বাণী গুলো কে পাশ কাটিয়ে কিছু সংখ্যক ধর্মীয় নেতাগণ জাতিকে বিভক্ত করেছেন। সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্রবাদীতার দিকে ধাবিত করেছেন। নষ্ট করতে চেষ্টা করেছেন দেশের শান্তি ও শৃঙ্খলা কে, সর্বোপরি তারা ইসলামী নীতি ও আদর্শকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।

বিশ্বের অন্যতম একটি মুসলিম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা ও ধর্মপালনে যথেষ্ট স্বাধীনতাপান। নিজের মত প্রকাশ ও প্রচারের সুযোগ পান। যা বিশ্বের অনেক দেশের মুসলমানরা পারেন না।

কিন্তু তাসত্বেও একটি তথাকথিত “ইসলামী আইন বাস্তবায়ন বা ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের জন্য” দেশের বিদ্যমান শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট করে, দেশের সম্পদ বিনষ্ট করে, মানুষে মানুষে সংঘাত সৃষ্টি করে, মানুষের সাভাবিক জীবন যাপন বা ধর্ম পালনে বাঁধা সৃষ্টি করে, যারা জিহাদের নামে উগ্রবাদীতাকে উসকে দেন! কেয়ামতের ময়দানে আল্লাহতালা তাদেরকে যদি প্রশ্ন করেন “আমিতো শান্তির ধর্ম ও শান্তির বানী পাঠিয়ে ছিলাম তোমরা পৃথিবীতে কেন অশান্তি সৃষ্টি করলে ???

তখন অশান্তি সৃষ্টিকারিরা মহান আল্লাহ তালার কাছে কি জবাব দিবেন তা একবার ভাবুন !!!

আলোর পথের সন্ধানে পর্ব-২

মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ

২৩ এপ্রিল ২০২১ খ্রি.

ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

Some text

ক্যাটাগরি: মতামত

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply

আমি প্রবাসী অ্যাপস দিয়ে ভ্যাকসিন…

লঞ্চে যৌন হয়রানি