শুক্রবার সকাল ৭:৫২, ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ. ২৯শে মার্চ, ২০২৪ ইং

রত্নগর্ভা কোনাউর গ্রামের নামকরণের ইতিহাস

৭৩১ বার পড়া হয়েছে
মন্তব্য ০ টি

আমাদের গ্রাম কোনাউর। ইহা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার ২১ নং উত্তর কাইতলা ইউনিয়নের অন্তর্গত একটি আদর্শ ও ঐতিহ্যবাহী সৌন্দর্যের লীলাভূমি।কালের পরিক্রমায় সবকিছুই বিলীন হয়ে যায়।যদিও কিছু কিছু সভ্যতার নিদর্শন থেকেই যায়।যদি ও লিখিত ইতিহাস এই সমতট জনপদ সম্পর্কে জানার তেমন উল্লেখযোগ্য তথ্য উপাত্ত নেই।

তবু ও কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া পুরানো তথ্য অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে অতীত ইতিহাস। ঠিক তেমনি আমাদের রত্নগর্ভা কোনাউর ও অতীতে অনেক পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে আজকের সুশীতল সুনিবিড় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আজকের বর্তমান অবস্থায়। কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস আর লোকমুখে শুনা কথা আজ জোড়াতালি দিয়ে পুর্নাঙ্গ ইতিহাস রচনা করতে চেষ্টা করেছি। তবুও যেন ফাঁক ফকর রয়েই যায়। তবু ও যেন এই রত্নগর্ভা কোনাউর এর ভূমি অনেক পুরানো। এই ভূমির সৃষ্টি হয় কালীদাহ সায়রের পরবর্তী সময়ে কালের বিবর্তনে।

রত্নগর্ভা কোনাউর এর নামকরনের ইতিহাস মূলত ২ টি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে আলোচনা করলেই ভাল হয়। এই দুইটি ক্যাটাগরি হল :১. পুরাতন গ্রন্থরাজির আলোকে। ২. জনশ্রুতির আলোকে। পুরানো গ্রন্থরাজির বিশ্লেষণই সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব বহন করে। যদিও জনশ্রুতির ও গুরুত্ব বহুলাংশে কম নয়।তাই দুটো ধারার বিবেচনা নিয়েই কোনাউর নামকরন এর ইতিহাস রচনা করতে চেষ্টা করেছি মাত্র।নিম্নে ক্যাটাগরি দুটোর ইতিবৃত্ত আলোচনা করা হল:

১. পুরানো গ্রন্থারাজীর আলোকে : হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন গ্রন্থরাজি গেটে প্রতীয়মান হয় যে,এই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা সেই ঐতিহাসিক সূচনালগ্নে কালিদাহ সায়র ছিল। যাহার বর্ণনা পাওয়া যায় মনসামঙ্গল কাব্যগ্রন্থে। যাহাতে বর্ণিত আছে চাঁদ সওদাগরের সপ্ত ডিঙ্গার বহর নিয়ে কালিদাহ সায়র দিয়ে বাণিজ্য করার দৃষ্টান্ত। কালের পরিক্রমায় ত্রিপুরা পাহাড়ের পাদদেশ আজকের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কিরাত ভূমি হিসেবে পরিচিত ছিল।

এই কিরাত ভূমিতে ত্রিপুরা পাহাড় থেকে পানি নেমে আসার সময় সাথে পলি মাটি বয়ে আনে। যাহার ফলে কালিদাহ সায়রে পলি জমে চর আকারে খন্ড খন্ড অংশ জেগে উঠে। কালের ধারাবাহিকতায় ধীরে ধীরে চরের বিশাল স্থলভূমি জেগে উঠে। প্রাচীন কালের এই অবস্থার সাথে একটি প্রবাদ বাক্যের মিল পাওয়া যায়, যা বাউনবাইরা বাসী বলে এখনও। গাঙ্গ গেলে ও গাঙ্গের রেখ থাকে। যদিও কালিদাহ সায়র কালের গর্বে হারিয়ে গেছে, তবু ও এখন ও তিতাস নামক নদীটি রয়েছে। এই কালিদাহ সায়রে জেগে উঠা বিশাল বড় চর, আজকের তিতাস নদীর পশ্চিম তীর গেসে কাইতলা, শিবপুর, নাটঘর, বিটঘর ইউনিয়ন গড়ে উঠেছে, জন লোকালয়ের পরিপ্রেক্ষিতে। ঐতিহাসিকদের ও গ্রন্থরাজি বিশ্লেষণ পূর্বক প্রতীয়মান হয় যে এই কালিদাহ সায়রের ছোট ছোট খন্ডে জেগে উঠা চরের একটি জেগে উঠেছিল আজকের রত্নাগর্ভা কোনাউর ও এর আশপাশের কয়েকটি গ্রামকে কেন্দ্র করে। এই কালিদাহ সায়রের চরের একটি কোনা সহ বেশ কিছু দূর পর্যন্ত স্থল ভূমি জেগে উঠে কোনাউরে। ঐতিহাসিক ও গ্রন্থরাজির ভাষ্যমতে হয়তো এই কালিদাহ সায়রের কোনা ভেসে উঠা থেকেই কোনা নামটি উৎপত্তি হয়। যাহা লোকমুখে উচ্চারিত হয়েই আজকের কোনাউর নামকরণ হয়।যদিও উর শব্দটি  আইর>আউর>উর এভাবেই উৎপত্তি ঘটে।

২. গ্রন্থরাজির ধারামতে অন্য উপশাখা মতে: প্রাচীন বৌদ্ধ যুগ শুরুর পূর্বে এই অঞ্চল কালিদাহ সায়র ছিল।যাহাতে চাঁদ,সওদাগর বাণিজ্য করতো। কালের পরিক্রমায় এই অঞ্চলে চর জেগে উঠে। ধীরে ধীরে চরের মধ্যে বন, ছোট ছোট গাছ জন্মায়।প্রাচীন বৌদ্ধ যুগে আজকের কোনাউর সমতট জনপদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তখন এ অঞ্চল বনভূমিতে পরিপূর্ণ আর জঙ্গলাকীর্ণ ছিল।যাহার কারনে কোন মানুষ  কিংবা জনগন বাস করেনি। সবাই ভয় পেত এই ভাটি অঞ্চলে বসবাস করার জন্য। আস্তে আস্তে বৌদ্ধ যুগের পরবর্তী যুগে আসে এিপুরা রাজাদের দখলে এই অঞ্চল। তাহার ধারাবাহিকতায় এক পর্যায়ে আসে মুগল শাসন ব্যবস্থা। তখন শের শাহ এই অঞ্চল কে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে পরগনা হিসেবে।যার মধ্যে আজকের কোনাউর পড়ে নূরনগর পরগনায়। সম্রাট আকবরের সময়ে রচিত গ্রন্থ আইনী আকবরী মতে, বাঙালার যে ওয়াসীল তুমর জমা সংযুক্ত রহিয়াছে, তাহাতে নূরনগর পরগনার নাম লিখিত হয় নাই।

প্রকৃতপক্ষে মুগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের অধিকারের পূর্বে এই পরগনা মুসলমান সাম্রাজ্য ভুক্ত হয় নাই।তৎকালে এই পরগনা হিউং বিউং ও কৈলারগড় এই তিনভাগে বিভক্ত ছিল।

১০০৯ হইতে ১০৩৫ ত্রিপুরাব্দের মধ্যবর্তীকালে মোগল গন ত্রিপুরার সমতল ক্ষেত্র অধিকার করেন। মুগলদিগের অধিকৃত প্রদেশ সরকার উদয়পুর আখ্যা প্রাপ্ত হয়।সরকার উদয়পুর ৪টি পরগনায় বিভক্ত হইয়াছিল। তদানীন্তন মুগল শাসনকর্তা হিউং বিউং ও কৈলারগড় নামক প্রদেশত্রয়কে সম্মিলিত করে স্বীয় নামানুসারে নুনগর পরগনা গঠন করেন। তৎকালে নুরনগরের অধিকাংশ ভূমি বনজঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল।এজন্য মুগল শাসনকর্তা নুরুল্লা খাঁ(বা নুরুল্লাবেগ) তালুকদারি প্রথা প্রবর্তন পূর্বক নুরনগরের আবাদ উন্নতির চেষ্টা করিয়াছিলেন।নুরুল্লা খাঁ কায়স্থ রামধর (প্রকাশ্য কায়েত রামধর) কে নুরনগরের চৌধুরীর পদে নিযুক্ত করেন।প্রাচীনকালে চৌধুরীগন স্বী পদের বৃতৃতিস্বরুপ নানকার প্রাপ্ত হইতেন। তদনুসারে তিনি নানকার প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। অনেকগুলি স্থান তিনি তালুক স্বরুপ প্রাপ্ত হন। তদ্ব্যতীত অন্যান্য স্থান বহুসংখ্যাক ব্যক্তিকে তালুকরুপে বন্দোবস্ত করিয়া দেওয়া হইয়াছিল। সেই সকল তালুকদার হইতে রাজস্ব আদায় পূর্বক রাজকীয় ধনাগারে অর্পণ করা রামধরের প্রধান কার্য ছিল।

উল্লেখিত ঘটনার পর মহারাজ কল্যাণমাণিক্য ত্রিপুরার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।তিনি নুরগরের তালুকদারগন সহিত কিরুপ ব্যবহার করিয়াছিলেন,তাহা আমরা অবগত নয়।কিন্তু নুরনগর পরগনার মধ্যে তিনি তাম্রশাসন দ্বারা নিষ্কর প্রদান করিয়াছিলেন।সেই সকল শাসনপত্র পাঠে প্রতিয়মান হইবে যে,এই বনাকীর্ণ পরগণায় আর্য উপনিবেশ সংস্থাপনে তাঁহার প্রধান অভিপ্রায় ছিল।
১৫৭৩ শকাব্দে ১৪ মাঘের তাম্রশাসনে লিখিত আছে যে, কোনাউর, বাউড়খাড় গ্রামের জঙ্গালাবৃত স্থানে ৭ দ্রোণ ভূমি মুকুন্দবিদ্যাবাগীশকে প্রদত্ত হইয়াছিল।অনুসন্ধান দ্বারা নির্ণীত হইয়াছে যে বিদ্যাবাগীশ মহাশয় রাঢ়দেশবাসী ছিলেন। মহারাজ কল্যাণমাণিক্য সেই মহামহোপাধ্যায় পন্তিতকে স্বীয় অধিকার মধ্যে সংস্থাপন করিবার জন্য নুরনগরের অন্তর্গত বাউরখাড় ও কোনাউর গ্রামে এই নিষ্কর প্রদান করেন।
মুকুন্দবিদ্যাবাগীশের ছিল তিন ছেলে।তারমধ্যে মধ্যম ছেলে ছিল কোনাল বন্দ্যেপাধ্যায়।অনেক ঐতিহাসিকদের মতে এই কোনাল থেকে কোনা নামটির উৎপত্তি ঘটেছে।কারন নিষ্কর জমির অর্ধেকাংশ তার ছেলে কোনাল এর অধীনে ছিল।যা তার নামানুসারে ই নানকরণ করেন কোনাউর।এই কোনাল মাটির আসবাবপত্র তৈরী করে বিক্রি করত। যাকে কুমার সম্প্রদায় হিসেবে আজকে পরিচিত। আজও আমাদের গ্রামের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ সংলগ্ন যে কবরস্থান রয়েছে, সেটা আজ ও অনেকের মুখে কুমাইরার মাঠ হিসেবে পরিচিত।সেখানে কবরস্থান খুড়তে গিয়ে মিলে আজ ও পাতিল ভাঙ্গা।যাহা অতীত ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়।এভাবেই রত্নাগর্ভা কোনাউর এর নামকরণ হয়েছে বলে ঐতিগাসিকগন মনে করেন।

২. দ্বিতীয় ধারা অনুসারে, জনশ্রুতি অনুযায়ী: ব্রিটিশ পরিয়ডে এসে এই গ্রামের নামকরণ করা হয় বলে জনশ্রুতি আছে।ব্রিটিশ পিরিয়ডে যখন নতুনভাবে বঙ্গদেশে মানচিত্র প্রণয়নের প্রয়োজন হয় তখন এই গ্রামের নামকরণ করা হয়। ব্রিটিশ পিরিয়ডে আজকের নেয়ামতপুর গ্রামের নওয়াব শাহ (রাহঃ) এর মাজারের আম গাছের নিচে এসে ব্রিটিশ মানচিত্র বিশেষজ্ঞ দাড়ায়।তখন কোনাউর গ্রামে কোন বাড়ি ঘর ছিল না।এই আমগাছের নিচ থেকে সুদূর দৃষ্টি ফেলে লক্ষ্য করিলেন ব্রিটিশ মানচিত্র বিশেষজ্ঞ বর্তমান সাব বাড়িতে, মধ্যপাড়ায় একটি, আর কনুই বাঁকা খাল সংলগ্ন একটি বাড়ি ছিল। যাহা তিন কেনায় ছিল।তখন এই কোনা, আর আমগাছের পাশেই ছিল পুকুর।পুকুরে ছিল আইর মাছ। আইর মাছের সৌন্দর্য  দেখে, আইর  মাছ থেকে কালক্রমে আইর>আউর>উর হয়। তখন কোনা এর সাথে  উর মিলে হয় কোনাউর।

যদিও কোনাউর গ্রামের নামকরণের ইতিহাস মোটামুটি কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে, তবু ও প্রাপ্ত তথ্য আর জনশ্রুতি অনুযায়ী ইতিহাস জুড়াতালি দিয়ে আস্ত ইতিহাস লিখার জন্য চেষ্টা করেছি।ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখিবেন। এই গবেষনা আমার বহু দিনের লালায়িত ও কষ্টের প্রতিফলন।

.গোলাম কিবরিয়া, ইতিহাস লেখকও প্রাবন্ধিক।

Some text

ক্যাটাগরি: নাগরিক সাংবাদিকতা, বিবিধ

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply

আমি প্রবাসী অ্যাপস দিয়ে ভ্যাকসিন…

লঞ্চে যৌন হয়রানি