শুক্রবার দুপুর ১২:১৫, ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং

ব্র্যাক আল্ট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন কর্মসূচির সহায়তায় জিন্নাতুনের উন্নয়নের ছোঁয়া

৫৫০ বার পড়া হয়েছে
মন্তব্য ০ টি

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার সালন্দর মোজাতিপাড়া জিন্নাতুনের পিতা : মনসুর আলী, মাতা সখিনা। স্বামী:হুরমত আলী।খানা নং২৫ জিন্নাতুনের পিতা অন্যের বাড়িতে দিনমজুরি করে সংসার চালাত।
তিনি গ্রামের একটি অতিদরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

জিন্নাতুনের পিতা অত্যন্ত দুঃখ কষ্টের মধ্যে সংসার চালাতো। কাজ না পেলে তাদের পরিবারের সবাইকে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাতে হতো। মাত্র ১৩ বছর বয়সে জিন্নাতুনের বাবা একই গ্রামের মোজাতিপাড়ার আলতাফ হোসেনের ছেলে হুরমত আলীর সাথে তার বিয়ে দেয়। হুরমতের পিতার পরিবার ছিল অত্যন্ত দরিদ্র।

অভাবী সংসার বলে বিয়ের কিছুদিন পরে আলতাফ হোসেন ছেলে এবং ছেলের বউকে আলাদা করে দেয়। পিতার সংসার থেকে পৃথক হয়ে যাওয়ার পর জিন্নাতুন এবং তার স্বামী দিশেহারা হয়ে পড়ে। পৃথক সংসার জীবনে তারা পিতার পরিবার থেকে কিছুই পায়নি।

শুরু হলো তাদের আরো কষ্টের জীবন। এরই মধ্যে জিন্নাতুনের গর্ভে সন্তান আসে। অভাবের তাড়নায় জিন্নাতুন গর্ভে সন্তান নিয়ে স্বামীর মতো সেও অন্যের বাড়িতে কাজ করতে থাকে। কিছুদিন পর জিন্নাতুনের কোলে আসে একটি ফুটফুটে পুত্র সন্তান।

অভাবের তাড়নায় সে তার সন্তানকে ঠিকমতো ভরণপোষণ দিতে পারে নাই। পর্যায়ক্রমে তার আরো দুটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। হুরমত আলী গ্যাসট্রিক ও কোমরে ব্যাথার কারনে ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। ফলে জিন্নাতুনকে একাই সংসারের আয়-উপার্জনের দায়ভার বহন করতে হয়। অন্যের বাড়িতে ধান সিদ্ধ করার কাজ, ঘর মোছার কাজ, কাপড়-চোপড় ধোয়ার কাজ, কাথা সেলাইয়ের কাজ ও আলু তোলার কাজের মতো কাজগুলি তাকে করতে হতো।

এদিকে ৩ সন্তানের জনক হুরমত আলীর শরীর আরো দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে জিন্নাতুন অন্যের বাড়িতে কাজ কর্ম করে দুঃখ কষ্টের সাথে দিনাতিপাত করতে থাকে। সংসার নামক সমুদ্রে জিন্নাতুন যখন কুল খঁুজে পায় না, ঠিক সেই মুহূর্তে ঠাকুরগাঁও সদর ব্র্যাক আল্ট্রা – পুওর গ্র্যাজুয়েশন কর্মসূচির মাধ্যমে ২০০৬ সালে একজন অতিদরিদ্র সদস্যা হিসেবে তাকে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত করা হয়।

ইউপিজি সদস্য হিসাবে চুড়ান্তভাবে নির্বাচিত হওয়ার পর জিন্নাতুনকে কর্মসূচির উদ্দেশ্য ও বিভিন্ন এন্টারপ্রাইজ সম্পর্কে খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে বুঝনো হয়।

জিন্নাতুন গাভী ও মুরগী পালনকে তার জীবনের উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেয়। ব্রাক প্রতিনিধি গোলাম মোস্তফা বলেন, কর্মসূচির নিয়ম অনুযায়ী জিন্নাতুনকে ৪ দিনের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। প্রশিক্ষণ শেষে তাকে ১টি গরু ও ১০টি মুরগী প্রদান করা হয়।

গরুর ঘর তৈরি করার জন্য ৩ বান্ডিল টিন কিনে দেওয়া হয় এবং সহায়ক ভাতা হিসেবে মোট ২৭৩০ টাকা প্রদান করা হয়। ব্র্যাক কর্মী র্প্রতি সপ্তাহে বাড়ি পরিদর্শনের মাধ্যমে নাম লেখা শেখানো, সামাজিক ও স্বাস্থ্য বিষয়ক নির্ধারিত ১০টি ইস্যুর উপর শিক্ষা দান করে এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনা করতে শেখায়।

কর্মসূচিতে অন্তভুর্ক্তির ১৮ মাস পূর্ণ হওয়ার পর তাকে আবার অফিসে ডেকে এনে ৩ দিনের ‘মনোবল উন্নয়ন প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়।

মনোবল উন্নয়ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাকে উন্নয়নের মূল স্রোতধারার সাথে সম্পৃক্ত করা হয়। ব্র্যাক অফিস থেকে ১টি গরু ও ১০টি মুরগী এবং সহায়ক ভাতা সহ সকল ধরনের সহযোগিতা ও গ্রামদারিদ্র বিমোচন কমিটির সম্মিলিত সহযোগিতায় জিন্নাতুন তার জীবনে সুখের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে তখন।

সে তার প্রশিক্ষণ থেকে কারিগরি জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে ১টি গরু ও ১০টি মুরগী যত্নের সাথে লালন পালন করতে থাকে। ৩ মাস গরু পালন করার পর গরুটি গর্ভবতর্ী হয়। ২ মাস মুরগী পালন করতে থাকাবস্থায় মুরগীগুলো ডিম পাড়তে শুরু করে। ডিম বিক্রির মাধ্যমে জিন্নাতুনের সংসারে আয় শুরু হয়।

অপরদিকে ৯ মাসের ব্যবধানে তার গরুটির বাচ্চা হয়। তখন তার মনে সুখের স্বপ্ন বাড়তে থাকে। এদিকে মুরগীগুলো ডিম পাড়ে এবং বাচ্চা ফুটায়। কিছুদিন পর জিন্নাতুন ১২টি মুরগী ১৮০০ টাকায় বিক্রি করে। সে ৩০০ টাকা খাবার কাজে ব্যয় করে এবং বাকি ১৫০০ টাকা দিয়ে ১টি ছাগল ক্রয় করে। ৬ মাস পর ছাগলটির ২টি বাচ্চা হয়। এভাবে ১ বছর পর জিন্নাতুনের মুরগী বিক্রি করে আরো ২০০০ টাকা আয় হয়। যা সে বর্গা জমিতে ফসল উৎপাদনের কাজে ব্যয় করে।

জিন্নাতুন ছাগলের বাচ্চা দুটি ২৮০০ টাকায় বিক্রি করে এবং ২২০০ টাকার মুরগী ও ডিম বিক্রি করে মোট ৫০০০ টাকা পায়। এ সময় সে ব্র্যাক থেকে ১০০০০ টাকা ঋণ নেয়। মোট ১৫০০০ টাকা দিয়ে ১০ শতক জমি বন্ধক নেয়। ১০ শতক জমিতে সে পর্যায়ক্রমে ধান ও আলু চাষ করে। এদিকে জিন্নাতুনের ছাগলটি আবার গর্ভবতর্ী হয় ও বাচ্চা প্রদান করে এবং মুরগীগুলো পর্যায়ক্রমে ডিম ও বাচ্চা দেয়।

অন্যদিকে তার গরুর বাছুরটি বড় হয় এবং গরুটিও পুনরায় গর্ভবতী হয়। সে কিছু দিন পর ২টি গরু, ৩টি ছাগল ও কিছু মুরগী বিক্রি করে মোট ২৮,০০০/- টাকা দিয়ে বসত ভিটার জন্য ৩ শতক জমি ক্রয় করে। তারপর ১টি গরু, ৫টি ছাগল ও মুরগী বিক্রি করে মোট ২০,০০০/- টাকা দিয়ে তার স্বামীকে সালন্দর বাজারে একটি পানের দোকান করে দেয়।

পানের দোকানের বেচা-কেনা বেশ ভাল হতে থাকে। কিন্তু তার স্বামীর কোমড়ের ব্যাথার কারনে বেশিক্ষণ দোকানে বসে থাকতে পারে না। ফলে তার বড় ছেলে দোকানের কাজে নিয়মিত ভাবে সহযোগিতা করে।

জিন্নাতুন ব্র্যাক থেকে ২০,০০০/- টাকা বিষয় নিয়ে দোকানে বিনিয়োগ করে। দোকান থেকে অর্জিত আয় এবং ছাগল, মুরগী ও বন্ধকী জমির ফসল বিক্রি করা আয় থেকে ১,০০,০০০/- টাকা এবং আরও ৫০,০০০/-টাকা ব্র্যাক থেকে ঋণ নিয়ে মোট দেড় লক্ষ টাকা দিয়ে আবারও ১০শতক বসত ভিটার জমি ক্রয় করে। ফলে তার বসত ভিটার জমি পরিমাণ হয় ১৩ শতক। উল্লেখিত আয়ের খাত থেকে পরে আরও দুই লক্ষ টাকা আয় হয় যা দ্বারা সে পাকাবাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করে।

ইতিমধ্যে তার ৩ কক্ষবিশিষ্ট পাকাবাড়ি নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এখন সে ঐ বাড়িতে সুখে-শান্তিতে বসবাস করছে। বর্তমানে জিন্নাতুনের ৩টি গরু, ৮টি ছাগল, ২৫টি মুরগী, নিজস্ব ক্রয়কৃত ১৩শতক জমি, ১০শতক বন্ধকী জমি, ১টি পানের দোকান যার মুলধন প্রায় ৫০,০০০/-টাকা এবং ৩ কক্ষ বিশিষ্ট একটি পাকা বাড়ি আছে।

এ পর্যন্ত জিন্নাতুন ব্র্যাক থেকে ৭ বার ঋণ গ্রহণ করেছে। বর্তমানে প্রয়োজন না থাকায় ঋণ নেয় নাই। সঞ্চয় জমা আছে ২২৫০ টাকা। বর্তমানে সম্পদ ও সঞ্চয় থাকার কারণে সে নিজেকে স্বাবলম্বী মনে করছে।

আর্থিক উন্নয়নের পাশাপাশি জিন্নাতুনের সামাজিক ও মানসিক উন্নতিও হয়েছে। সে এখন সমাজের অবহেলিত মানুষ নয়। সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাকে দাওয়াত করে, গ্রামীণ বিচার শালিসে অংশগ্রহণ করে। তার এক ছেলে এইচ.এস.সি পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য চেষ্টা করছে।

আরেক ছেলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছে। ফলে তার মনোবল দৃঢ়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। জিন্নাতুন নাম লেখার পাশাপাশি সামাজিক ও স্বাস্থ্য বিষয়ক ১২টি ইস্যু শিক্ষার মাধ্যমে বাল্য বিবাহ ও যৌতুকের ক্ষতিকর দিক বলতে পারে।

স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতার কারণে বাড়ির আশপাশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখে। এখন সে স্বাস্থ্য সম্মত ল্যাট্রিন ব্যবহার করে ও গোড়া পাকা নলকূপের পানি পান করে। সে যে কোন সমস্যা দক্ষতার সাথে সমাধান করতে পারে। জিন্নাতুনের কাছে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে সে তার ছেলেকে উচ্চশিক্ষিত করে সরকারি চাকুরীজীবী হিসেবে দেখতে চায় এবং আরো জমি ক্রয় করে ফসল উৎপাদন করে সংসারের আয় বৃদ্ধি করতে চায়।

জিন্নাতুন গাভী ও মুরগী পালন করে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখেছে।সে নিজে স্বাবলম্বী হয়েছে এবং সন্তানদেরকে সুপরামর্শ দিয়ে দারিদ্রতার অভিশাপ থেকে মুক্ত রাখবে। জীবনের উন্নতির জন্য জিন্নাতুন ব্র্যাক নামক প্রতিষ্ঠানের নিকট চিরকৃতজ্ঞ।

নুরে আলম শাহ::ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি:

Some text

ক্যাটাগরি: খবর

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply

আমি প্রবাসী অ্যাপস দিয়ে ভ্যাকসিন…

লঞ্চে যৌন হয়রানি